বাড়ছে সকল প্রধান নদ-নদীর পানি
জন্মভূমি ডেস্ক
সুনামগঞ্জ শহরের দক্ষিণ নকংনপাড়ার রমিজ উদ্দিন বললেন, দোকানে গিয়ে মোমবাতি পাচ্ছি না, রান্না করার জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার নেই, ঘরে এখনো গলাসমান পানি। দুুই টাকার মোমবাতি ১০ টাকা, চালের কেজি একশ টাকারও বেশি, ম্যাচ, চিড়া, গুড়, মুড়িও দ্বিগুণ তিনগুণ দামেও পাওয়া যাচ্ছে না। চলাচল করতে ২০ টাকার রিকশা ভাড়ার স্থলে নৌকায় ২০০ টাকায়ও যাওয়া যাচ্ছে না।
মহল্লার অন্য বাসিন্দারাও এই প্রতিবেদকের বাছে একই ধরনের মন্তব্য করলেন। বানভাসিদের কষ্ট শেষ হচ্ছে না। বন্যাদুর্গতদের এ যেন ‘বাড়তি দুর্যোগ’ বয়ে এনেছে। যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা সুনামগঞ্জের বানভাসিদের।
শহরতলির বুড়িরস্থলের বারকি চালক শ্রী চরণ দাসকে সামান্য অংশ যেতে এতো টাকা নিচ্ছ কেন প্রশ্ন করতেই, উল্টো শ্রী চরণের মন্তব্য, আমরারটা দেখরা, দোকানি অকলতে কিতা করের দেখরানি, ১৫০০ টেকার সিলিন্ডার তিন হাজার টেকা, কয়েল লাকরি আগের দামের থাকি চাইর গুণ, দুই টেকার মোমবাতি ১০ টেকায়ও পাওয়া যার না, হটা গিয়া আপনারা দেখলে ভালা অয়।
আন্তঃজেলা বাসের (সুনামগঞ্জ-চট্টগ্রাম) এক চালক চার দিন ধরে বাস নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের আব্দুজ জহুর সেকংর উপরে অবস্থান করছিলেন। সোমবার যাত্রী ওঠানো শুরু করেন এই চালক। ভাড়া দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হাঁকেন তিনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমরান শাহরিয়ার ভ্রাম্যমাণ আদালত চালানোর সময় ওই চালককে জরিমানা করেন।
আরেক ট্রাকচালক সিরাজ উদ্দিন বললেন, চার দিন সুনামগঞ্জে টাকা দিয়েও খাবার পাইনি, বিস্কুট আর পানি খেয়ে বেঁচে আছি, দুই লিটারের এক বোতল পানি শহরের জামতলার মুখের একটি দোকান থেকে ৭০ টাকায় কিনেছি।
সুনামগঞ্জ শহরের সব এলাকায় সোমবার পর্যন্ত এভাবেই জনগণের জন্য যেন সবকিছু ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোৃ. জাহাঙ্গীর হোসেন অবশ্য বলেছেন, কঠোরহস্তে কেনা কাটায় এমন আচরণ দমন করা হবে। মানুষের বিপদের সময় অমানবিক আচরণ যারা করছে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার পর থেকে সকল ফোনের নেটওয়ার্ক অচল হয়ে যাওয়ায় এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হওয়ায় প্রলয়ংকরী বন্যায় হতাহতের খবর জানা যায়নি। তবে সোমবার ফোনের নেটওয়ার্ক কিছুটা সচল হতেই হতহতের নানা তথ্য গণমাধ্যমকে জানাচ্ছেন বানভাসি মানুষ।
শহরতলির ওয়েজখালির সুশীল ঘোষ সোমবার বিকালে জানালেন, গ্রামের ফিরোজ মিয়ার ছেলে কারচালক আলাল মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুক্রবার বিকালে ওই চালক সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঢল দেখতে সড়কে হাঁটছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাবার সময় দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলার নুরুল ইসলামের দুই ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও জরিফ মিয়ার মৃত্যু ঘটেছে। একই দিনে দোয়ারাবাজারের মান্নারগাঁওয়ের পাশে সড়কে মোটর সাইকেলসহ ঢলে ভেসে আবুল কাসেম (২৭) নামের একজনের মৃত্যু ঘটেছে।
পানিবন্দি এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট
॥ বাড়ছে নদ-নদীর পানি ॥
দেশের সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার নদ-নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পারে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপদসীমার কাছাকাছি অথবা উপরে অবস্থান করতে পারে।
সোমবার (২০ জুন) নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের স্থানসমূহে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। ভারতের মেঘলালয় প্রদেশে ভারী বর্ষণের প্রবণতা কমে এসেছে।
পূর্বাভাসে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে হবিগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামে ২৪২ মিলিমিটার। এছাড়া সীতাকু-ে ১৮৫ মিলিমিটার, রাঙ্গামাটিতে ১৭৫ মিলিমিটার, টেকনাফে ১৬২ মিলিমিটার, ফেনীতে ১২৬ মিলিমিটার এবং সন্দ্বীপে ১২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
॥ সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল ॥
হবিগঞ্জ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। সোমবার সকালে ৯টি নদ-নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।