সোহেল আহমেদ, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দাপনা গ্রাম এখন কেঁচো আর কম্পোস্ট সারের গ্রামে পরিণত হয়েছে। শতভাগ বাড়িতে এখন সার উৎপাদন হচ্ছে। গ্রামের ৬০ ঘর পরিবার এখন আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে না। নিজেদের উৎপাদিত পরিবেশ বান্ধন কম্পোস্ট সার দিয়েই জমিতে চাষাবাদ করছে। মাসে তারা ৫০ হাজার টাকার সার ও কেচো উৎপাদন করছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এখানকার কম্পোস্ট সার সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে। আর এই কাজটি যারা করছে তারা সবাই গৃহিনী। বাড়ির প্রয়োজনীয় কাজের শেষে তারা বাড়তি কাজ হিসেবে এই কাজটি করছে। এই কাজে তাদের সহযোগীতা করেছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম দাপনা। এই গ্রামের নারীরা খুবই পরিশ্রমী। প্রত্যেকের বাড়িতেই ২ থেকে ৮টি পর্যন্ত গরু আছে। তারা তাদের গরুর গোবর কাজে লাগিয়ে সার তৈরি করছে। যে সার পরিবেশ বান্ধব। এই গ্রামে শতভাগ বাড়িতে কম্পোস্ট প্লান্ট বানাতে পরামর্শ ও সহযোগীতা দিয়ে আসছেন রেবেকা ও সোনাভান নামের দুই গৃহবধু। তারা প্রথম পর্যায়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগীতায় এই কাজ শুরু করেন। এর পর সারা গ্রাম। রেবেকার ঘরের মধ্যে,রান্নাঘরে,বারান্দায়,গোয়ালঘরে,বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় কাচা,পাকা বেশ কয়েকটি কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছেন। প্রতি মাসে তিনি প্রায় ৪০০ কেজি কম্পোস্ট ও প্রায় ১০ কেজি কেচো উৎপাদন করছে। এক কেজি কম্পোস্ট সার ১০ টাকা আর এক কেজি কেচো ১৫০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন। একই গ্রামের কৃষানী আতিয়ার রহমানের স্ত্রী শাহনাজ, মশিয়ার রহমানের স্ত্রী সোনাভান,শওকত আলীর স্ত্রী সুখজান, আঃ কুদ্দুসের স্ত্রী হাজেরা বেগম, জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আহরনসহ ৬০টি পরিবারের সকল গৃহিনীরা তাদের বাড়িতে কেউ মাটির রিং স্লাব, কেউ বা পাকা করে কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছে। প্রতি মাসেই তাদের প্লান্ট থেকে সার উৎপাদন হচ্ছে। তারা উৎপাদিত কম্পোস্ট সার নিজেদের জমিতে ব্যবহার করে বাকিটুকু বিক্রি করছে। দেশের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ট্রাক ভরে সার ও কেচো ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে পরে সেগুলো প্যাকেটিং করে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই,সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। কেচো কম্পোস্ট সার বিশেষ করে ধান, পান ,পাট, সবজী জাতীয় চাষাবাদে প্রয়োগ করে চাষীরা বেশি উপকার পাচ্ছে।
কৃষানী সোনাভান জানান, আমি এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার সার ও ১০ হাজার টাকার কেচো বিক্রি করেছি। কেচো কম্পোস্ট সার উৎপাদন করতে বেশি টাকা খরচ হয় না। দরকার আগ্রহ। গরুর গোবর, লতাপাতা,কলাগাছ আর কেচো এই দিয়েই প্রতি তিন মাস অন্তর সার উৎপাদন করা হয়। এই সারের গুনগত মানও ভাল। যশোর মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রে তারা এ জৈব সার পরীক্ষা করে দেখেছেন বাজারের যে সব টিএসপি পাওয়া যায় তার মান ৪৫% অন্যদিকে কম্পোস্ট সার বা অর্গানিক সারের মান ৮৫%(সার্বিক)। শুধু তাই না এই গ্রামের কৃষাণীরা সবাই মিলে একটি মহিলা সমবায় সমিতি করেছেন। সার বিক্রির একটি অংশ তারা সমবায় সমিতিতে জমা রাখেন। এই সমিতির বর্তমান মুল ধন প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। তারা ইতিমধ্যে সমিতির মাধ্যমে একটি পাওয়ার ট্রিলার, ২টি গরু ক্রয় করেছে। আর নগদ টাকা সমিতির সদস্যদের মধ্যে ঋণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় গ্রামের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের তারা লেখা পাড়ার জন্য বিভিন্ন সময় সহযোগীতা করেন। সফল কৃষাণী ও মহিলা সমিতির সভানেত্রী রেবেকা বেগম জানান, আমি এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার টাকা কম্পোস্ট সার ও প্রায় ১৫ হাজার টাকার কেচো বিক্রি করেছি। তিনি আরো জানান,আমাদের স্বপ্ন আর যেন কেউ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জমি গুলো নষ্ট না করে । আমরা সারা বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিতে চাই নিজেদের তৈরি সার জমিতে ব্যবহার করেই স্বাবলম্বী হওয়া যায়। তিনি আরো জানান, আমাদের স্বামীরা আমাদের অনেক সহযোগীতা করে। এই গ্রামের প্রত্যেক নারীর হাত খরচ, চিকিৎসার টাকা স্বামীদের কাছ থেকে নিতে হয় না। বরং আমরা আরো স্বামীদের টাকা দিই। আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা হল এই সারগুলো নিজেরাই প্যাকেট জাত করে মার্কেটে ছাড়া। এর জন্য প্যাকেটিং মেশিন দরকার এবং সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন।নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজেদুল হক লিটন জানান, দাপনা গ্রামের নারীরা যে উদ্যোগ গ্রহন করেছে তাতে খুব শ্রীঘ্রই এই গ্রামে দারুন পরিবর্তন আসবে। আমি দারুন খুশি আমার ইউনিয়নের একটি গ্রামের নারীরা এতদুর এগিয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মোশাররফ হোসেন জানান, কম্পোস্ট সার পরিবেশ বান্ধব। এই সার জমিতে পরিমানে বেশি লাগে তবে ফসল ভাল হয়। এই গ্রামের কৃষানীরা যে নিজেদের উৎপাদিত সার জমিতে ব্যবহার করছে এটা ভাল উদ্যোগ।