জন্মভূমি রিপোর্ট : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়ার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে তিনটিতে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং একটি আসনে নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। রোববার (৭ জানুয়ারি) ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
এসময়ে চারটি সংসদীয় আসনে বেশ কয়েকটি জায়গায় পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর, হামলা, মারপিট, অগ্নিসংযোগ ও হুমকিধামকির ঘটনা ঘটেছে। হামলা করে প্রায় ১৫ জনকে রক্তাক্ত জখম করা হয়। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে গুরুত্বপূর্ণস্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের মৃত জসিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রশিদ (৫০), একই গ্রামের মৃত আমদ মন্ডলের ছেলে ছাবেদ আলী মন্ডল (৪৫), শহিদুল বিশ্বাসের ছেলে রিংকু বিশ্বাস (২৫)।
কুমারখালী উপজেলার বাঁশগ্রাম পূর্বপাড়ার মৃত জহির উদ্দিনের ওলিদুর রহমান জোয়াদ্দার (৪৪), একই উপজেলার পিতম্বরবশী গ্রামের মৃত আজাহার উদ্দিন শেখের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (৫০) ও মনিরুজ্জামান (৪৫), আদাবাড়িয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে আক্তারজ্জামান (৪০), রামদিয়া কাঁঠাল বাগান এলাকার ইলিয়াস মোল্লার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (১৯)। পান্টি গোরস্থানপাড়ার আব্দুল আওয়ালের ছেলে রায়হান (২৫), দক্ষিণ ভবানীপুর গ্রামের মোকাদ্দেস মোল্লার ছেলে আলামত মোল্লা (৩৬), চাপড়া পূর্বপাড়ার এস এম রাশেদুল ফরহাদের ছেলে রাজিব হোসেন (২৭), দক্ষিণ মনোহরপুর কালুপাড়া গ্রামের মৃত মনছুর আলী বিশ্বাসের ছেলে আলাউদ্দিন বিশ্বাস(৬০)। খোকসা উপজেলার উথলী গ্রামের ইউনুছ আলীর ছেলে রুহুল ইসলাম (২৫), পূর্ব গোপালপুর গ্রামের মৃত আকবর আলী সরদারের ছেলে আইয়ুব আলী (৫৮), একই গ্রামের চতুর আলীর ছেলে সবুজ (৩০), চতুর প্রামানিক (৫৫), বানাত আলী সরদারের ছেলে হাবিল হোসেন (৩০)।
জানা গেছে, কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মনোহরপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে ভোটগ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে নৌকার সমর্থকরা ট্রাক মার্কার পোলিং এজেন্ট অহিদুল ও সমর্থক তেফাজ্জেল বিশ্বাস, মানিক বিশ্বাস, শুভ ও আব্দুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন সমর্থকদের ওপর দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এতে গুরুতর আহত হন তারা। তাদের ৫ জনকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে তোফাজ্জেলের শরীরে ১৫টি সেলাই ও মানিকের ৬টি সেলাই দেওয়া লেগেছে। এ ঘটনায় কুমারখালী থানায় মামলা হয়েছে। অপরদিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর জয়ী প্রার্থী আব্দুর রউফের সমর্থকরা নৌকার সমর্থক রাজ্জাক হোসেন (চুকা), উম্মত আলী, জয়নাল, আজিজ, হাফিজের বাড়িতে ও দোকানে হামলা করে।
রোববার রাতে ট্রাকের সমর্থক ইসরাইল শেখের প্রায় ৭ শতাংশ জমির পেঁয়াজের চারা কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ইসরাইল যদুবয়রা ইউনিয়নের ছাতিয়ান গ্রামের মৃত হারু শেখের ছেলে। এছাড়া চাঁদপুর ও চর সাদিপুর ইউনিয়নে ট্রাক ও নৌকা উভয় পক্ষের বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা) আসনের বিজয়ী প্রার্থী আবদুর রউফ (ট্রাক প্রতীক) ও পরাজিত প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের (নৌকা প্রতীক) সমর্থকেরা নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় প্রায় ১০ জন আহত হয়েছেন। এসময় বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন, নির্বাচনী অফিস ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়েছে। পরাজিত ঈগল প্রতীকের প্রার্থী নাজমুল হুদা পটলের সমর্থক জগন্নাথপুর গ্রামের আবু হানিফের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে বিজয়ী ট্রাক প্রতীকের প্রার্থী রেজাউল হক চৌধুরীর সমর্থকরা তার বাড়ি ঘরে আগুন দেয়। সোমবার সকাল ১০টার দিকে দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দৌলতপুর থানায় মামলা হয়েছে।
এদিকে সোমবার সকালে রেজাউলের সমর্থক একই এলাকার সালামত ফকির, একা ফকির, মুন্না ফকিরসহ বেশ কয়েকজন আবু হানিফের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। খবর পেয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহেতেসাম রেজা ও পুলিশ সুপার আব্দুর রাকিবসহ প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে যান। এ ব্যাপারে আবু হানিফের ভাই আব্দুর রহিম বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় একটি মামলা করেছে।
অপরদিকে সোমবার সকালে দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর মধ্যপাড়ায় পরাজিত নৌকার প্রার্থী সরোয়ার জাহান বাদশার সমর্থক আব্দুল রহিম ফকিরের বসতবাড়িতে অতর্কিত হামলা চালায় ও আগুন দেয় নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যের কর্মী-সমর্থকরা। এতে অন্তত ৩জন রক্তাক্ত জখম হন। গুরুতর আহতাবস্থায় তাদেরকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তুফান ফকিরের অবস্থা অবনতি হলে তাকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে।
একই সময় উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্ববাত বাজার এলাকায় নৌকা প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হয়। একই সময় উপজেলার সোনাইকুন্ডি এলাকায় নৌকার কর্মী শ্রমিকলীগ নেতা মাহি বিশ্বাসের সোনাইকুন্ডি বসতবাড়িতে ইট পাটকেল ছোঁড়া ও নিরাপত্তা প্রাচীর ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে ট্রাক মার্কার কর্মীদের বিরুদ্ধে।
এদিকে একই উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের শাদীপুরে বাজার এলাকাতেও অন্তত ১০টি দোকানঘরে ভাঙচুর করে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরীর কর্মী-সমর্থকরা। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে ব্যবসায়ীরা। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
কুষ্টিয়া-১ আসনের নব নির্বাচিত সাংসদ জানান, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন।
রোববার রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর পরই কুষ্টিয়া পৌরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কুমারগাড়া এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের সমর্থক রজব আলীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে কাউন্সিলর এজাজ আহমেদ ও তার লোকজন। অস্ত্রের আঘাতে রজব আলীর হতের দশটি আঙ্গুল, বুক, পিঠ, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়। তাকে বাঁচাতে ভাতিজা বেলাল হোসেন এগিয়ে এলে তাকেও কুপিয়ে আহত করা হয়। এতে বেলালের মাথায় ছয়টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সোমবার সকালে সদর উপজেলার গোস্বামী দূর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দবির উদ্দিনের নেতৃত্বে একাধিক বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। এসময় বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। এসময় তারা স্থানীয় খালেক, খেদ আলী, বানাত মালিথা ও সেন্টুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত সাংঘর্ষিক কারচুপির ঘটনা ছাড়া সারাদেশে ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এই মতের সাথে আমি একমত। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি যে, বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত যে কারচুপির ঘটনা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তার ভেতরে দুর্ভাগ্যজনক হলেও কুষ্টিয়া-২ আসন আমার এলাকার অন্তর্ভুক্ত। যে আক্রমণ হুমকিধামকি অত্যাচার শুরু হয়েছে। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগ বনাম জোটের শরিক দলের সাংঘর্ষিক অবস্থা এলাকায় থাকা উচিত না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখানে বেশিরভাগ তারা নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছে। আমি জনগণের ভোটে নই, কারচুপির ভোটে পরাজিত হয়েছি। আশা করি এটা সবাই তদন্ত করে দেখবেন। এর প্রতিকার এবং বিহিত করবেন।
আওয়ামী লীগ বনাম জোটের শরিক দলের সাংঘর্ষিক অবস্থা এলাকায় থাকা উচিত না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখানে বেশিরভাগ তারা নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছে। আশা করি এটা সবাই তদন্ত করে দেখবেন। এর প্রতিকার এবং বিহিত করবেন। যে আক্রমণ হুমকিধামকি অত্যাচার শুরু হয়েছে। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এ এইচ এম আবদুর রকিব জানান, নির্বাচনী পরবর্তী ভিত্তিক এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় জড়িত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এই অভিযান অব্যহত থাকবে। সবাইকে সহিংসতা এড়িয়ে চলার জন্য আহ্বান জানান তিনি।