
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : মুন্ডা সংখ্যা লঘু সম্প্রদায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় নৃ-গোষ্ঠি। মুন্ডা শব্দটি সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি। যার প্রকৃত অর্থ গ্রাম প্রধান।মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা ‘মুন্ডারি’। কিন্তু এর কোনো লিখিত রূপ নেই, কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বর্ণমালা। শুধু মুখে মুখে প্রচলিত কথ্য ভাষাও আজ বিলুপ্তির পথে।
প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের ঝাড়খণ্ড ও ছত্রিশগড় রাজ্যের ছোটনাগপুর, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গে এদের বসবাস৷ মুন্ডারা অস্ট্রো- এশিয়াটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত। দুইশ বছর আগে মুন্ডারা এদেশে এসেছে ভারতের উড়িষ্যা থেকে। বাংলাদেশের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন এলাকায়ও এদের আদি বসতির চিহ্ন মিলে। খুলনা জেলার কয়রা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, মুন্সিগঞ্জ, দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুন্ডাদের বসতি গড়ে ওঠে। সাড়ে পনেরো হাজার ভোটারসহ এ সম্প্রদায়ের প্রায় ৫ হাজারের বেশি জনবসতি রয়েছে এই দক্ষিণাঞ্চলে।জানা যায়, মুন্ডাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনপ্রণালি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। দক্ষিন-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তসীমায় খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী ও কয়রা সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে দুই হাজার মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে এই এই জনগোষ্ঠির মানুষেরা। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এই তিনটি ইউনিয়নে মাহাতো ও মুন্ডা জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব জীবন যাপনে অভ্যস্থ।
মুন্ডা মাহাতো সম্প্রদায়ের লোকেরা এখনও সমাজে নিম্নশ্রেণি হিসেবে পরিগনিত হয়। এই সমাজের সৃষ্ট শত-সহস্র অবজ্ঞা অবহেলায় পদে পদে প্রতিকূলতায় পদদলিত হচ্ছে তারা। মুন্ডারা সবাই গরীব। নিরক্ষর, সাদাসিধে আর সরল বিশ্বাসী হওয়ায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে এসব মুন্ডা পরিবারের সদস্যরা অনেকেই এখন নি:স্ব ও নিদারুণ জীবন যাপন করছে। এক সময় তাদের অনেক জমা-জমি ছিল, অক্ষর জ্ঞানহীন হওয়ায় মহাজনের ঋণ আর পেটের দায়ে জনমফাকি দিয়ে মুন্ডা ও মাহাতো সম্প্রদায়ের লোকদের এসব জমি হাতিয়ে নেয় সমাজের একশ্রেণির অর্থলোভী মানুষ। জন্ম থেকে মুন্ডারা খুবই পরিশ্রমী, এরা অলস জীবন যাপনে অভ্যস্ত নয়। শ্রম বিক্রি করে তারা সংসার চালায়। তবুও উপযুক্ত পারিশ্রমিক তারা পায়না, তাই অভাব তাদের নিত্য সঙ্গী। পারিশ্রমের মূল্য নিয়ে তাদের প্রতিবাদ করতেও দেখা যায়না। মুন্ডারা মনে করে, জন্ম হয়েছে খেটে খাওয়ার জন্য। মৃত্যু পর্যন্ত খেটে খেয়ে যেতে হবে। তাদের ভিটে মাটি-জমিও বেচাকেনার ক্ষেত্রে পায় না ন্যায্য মূল্য।বেঁচে থাকার তাগিদে এরা বেছে নিয়েছে বিভিন্ন পেশা। মৌসুমে মহাজনের জমিতে দিনমজুর, বনে জঙ্গলে মাছ ধরা, গৃহস্থের বাড়িতে কামলা খাটার পাশাপাশি এলাকায় যখন কাজ থাকে না তখন ধান কাটতে ও ইটের ভাটায় কাজ করতে তারা দেশের বিভিন্ন জেলায চলে যায়। মুন্ডা পরিবারের নারী পুরুষ সবাই পরিবারের জীবিকার তাগিদে ঘরে বাইরে কাজ করে। তার পরেও দুঃখ দৈন্য তাদের জীবন যুদ্ধের নিত্য সঙ্গী।
খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন প্রণা্লী ও সাংস্কৃতিক চর্চ্চার ভিন্নতাও তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মূল ধারার সাথে। মুন্ডাদের মধ্যে এখন অনেকে হাজার প্রতিকূলতাকে সাঁতরে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তথ্য সংগ্রহকালে উত্তর বেদকাশী বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুম্মীতার সাথে কথা হয়। সে জানায়, সীমিত গন্ডির মধ্যেই তারা ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্নও সে দেখে। সামাজিক বৈষ্যম্য ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, উচু নিচুর ভেদাভেদ এড়িয়ে সে এগিয়ে যেতে চায়।
মুন্ডা পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা যেন দারিদ্র্যের অভিশাপের এক চলমান চিত্র। অনাহারে-অর্ধাহারে, অপুষ্টিতে অশিক্ষায়, অনাদরে অনিশ্চিত ভবিস্যতের দিশাহিন প্রজন্ম। শতকরা ৫-১০ জন শিশু স্কুলে গেলেও ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা সর্বাধিক। অভাবের সংসারে আয়ের সহায়ক হিসেবে শিশুশ্রমে জড়িয়ে গেছে এসকল অধিকার বঞ্চিত শিশুরা। প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের সময় এমনই কিছু হৃদয়বিদারক চিত্র ফুটে উঠেছে মুন্ডা শিশু শ্রমিকদের বক্তব্যে। ৬নং কয়রা গ্রামে ইট ভাঙ্গার কাজ করছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু মুন্ডা শিশু। নাম ও কেন এ বয়সে কাজ করছে জিজ্ঞাসা করতেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে তারা। এসকল শিশু ৬নং কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। অভাব অনটনের সংসারে পিতা-মাতাকে সাহায্যের জন্য এত পরিশ্রমের কাজ করছে। ইট ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তাদের হাতে ফোসকা উঠলেও ইট ভাঙা তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা এসব শিশুদের চোখে মুখে পেটের ক্ষুধা আর কষ্টের রেখা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। রোজগার করেই তাদের দুমুঠো ভাত মুখে দিতে হয়।
এই এলাকায় এখনোও প্রসূতি মা সন্তান জন্মদান দেন সেই মান্ধাতার আমলের ধাত্রীর দেখভালে। তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ক্লিনিক বা হাসপাতাল। ফলে মা ও শিশু মৃত্যুর হার এখানে বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি মা ও শিশু জন্মের আগে ও পরে মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভোগে। নিতান্তই যেন প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত হয় শিশুরা। পরিসংখ্যান বলছে, পর্যাপ্ত খাবার, পুষ্টির অভাবে, চিকিৎসার সংকটে মৃত্যু হার ঊর্ধ্বমুখী।আশার বাণী হলো, এই অঞ্চলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ সকলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনে তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রদান অব্যাহত রয়েছে৷ সরকারি সহায়তায় গৃহ নির্মাণ, আদিবাসী কোটায় চাকরির নিশ্চয়তা সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। মা ও শিশুর মৃত্যু হার রোধে স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চলমান আছে। তাদেরকে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ।
কয়রা সদরের তরুণ মুন্ডা বলেন, আমাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে। শিশুদের জন্য নেই আলাদা স্কুল বা পাঠ্যবইয়ের ব্যবস্থা। স্কুলে অন্যরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ভাল হবে নেয় না। সরকারি সুযোগ সুবিধাও কম পাই আমরা। আমাদের অধিকাংশ পুরুষ ও মহিলারা দিন মজুরের কাজ করে জিবিকা নির্বাহ করে। কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। ভাষা রক্ষায় তাঁদের শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিসহ ভাষা সংরক্ষণ, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি’র ) প্রতিষ্টাতা আশিকুজ্জামান
বলেন, মুন্ডা সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বাবা-মা নিরক্ষর হওয়ায় তারা শিশুদের পড়ালেখার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না। সমাজে পিছিয়ে পড়া মুন্ডা সম্প্রদায়ের শিশুদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সরকারি ও বেসরকারী ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের এসব মানুষকে ঝুকিমুক্ত করতে হলে তাদের জন্য জলবায়ুসহনশীল বিভিন্ন কর্মসূচি ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং এসকল কার্য্ক্রম বা উদ্যোগে এসকল প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকারি যে সকল প্রণোদনা বরাদ্দ থাকে সেগুলো প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষদের প্রাপ্তিতে সংশ্লিষ্ঠ সকলকে অন্তভুক্তিমুলক ও সংবেদনশীল হতে হবে।
এই অঞ্চলের মুন্ডা সম্প্রদায়ের এহেন দশা নিয়ে কথা হয় কয়রা সদরের বার বার নির্বাচিত সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আহম্মেদের সাথে। তার ভাষ্য মতে, সমাজের শিক্ষিত মানুষের উচিৎ তাদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে সভ্য ও সুন্দর জীবনের পথে আনা। তাদের মাঝে শিক্ষা, দীক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মুন্ডা সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের সরকারের সাথে সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। তাহলে তাদের জীবনমান উন্নয়ন সহ সার্বিক দিক দিয়ে উন্নতি সাধিত হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুলী বিশ্বাস বলেন, কয়রার আদিবাসি মুন্ডা ও মাহাতো পরিবারের সদস্যদেরকে স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বে-সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাদেরকে সহযোগিতা করা হচ্ছে।ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে তিনি যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলে জানান।

