
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতির উপর ক্ষতি হয় গরিবের নানা মাতৃক । আর লাভবান হয় ঠিকাদার ও পাননিয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা । যার প্রমান সাতক্ষীরা জেলার গাবুরা ইউনিয়নের মেগা প্রকল্পে । সেখানে হাজার হাজার মানুষকে ঘরছাড়া হয়ে বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে আর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদাররা মেগা প্রকল্পের নামে হরি লুট করছে এক স্কয়ার ফুট মাটির মূল্য ১৩০ টাকা থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত । তাহলে লাভ কাদের এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে । কেবা বন্ধ করবে এই সীমাহীন দুর্নীতি অপকর্ম ঘুষ বাণিজ্য । পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা ও তাদের নিয়োজিত কিছু দালাল ঠিকাদাররা তাকিয়ে থাকে কখন উপকূলের বাঁধ ভাঙবে কখন তারা বরাদ্দ পাবে । কখন তারা হরি লুট করবে। এখন উপকূলের ১০০% মানুষের একটাই দাবি সামনে যে সরকারি ক্ষমতায় আসুক না কেন বন্ধ করতে হবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ও তাদের নিয়োজিত ঠিকাদারদের দুর্নীতি তাহলে উপকূলীয় মানুষের বসবাসের আস্থা ফিরে আসবে ,শান্তি পাবে জীবনে। আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এই সমস্ত অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী ও ঠিকাদারদের খোঁজ নিতে হবে তাদের অবৈধ অর্থের তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলীরা গাড়িতে জার্নিং করে ঢাকায় আসে না তারা ঢাকায় আসে বিমানে এত অর্থ তাদের কোথা থেকে আসে নজর দিতে হবে সরকার অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে।তাই উপকূলে মানুষের একটাই কথা বাঁধ ভেঙ্গে গরিবের ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব আর লাভবান হয় ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই দুর্নীতির প্রতিবাদ করবে কে।ঘুরেফিরে সকলের ওই একটাই কথা—নাজুক বেড়িবাঁধ সারানোর ব্যবস্থা হলে আইলার মতো আবারও ভাসতে হতো না। আইলা, ফণী, বুলবুলের পর কত আশ্বাসই না এলো; কই, কেউ তো ফিরেও তাকালো না। সবখানে শুধু জোড়াতালি। এভাবে কী বাঁধ টিকানো যায়?
আম্পানে ভেসে গেল বাড়িঘর, চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি—সবকিছু। মানুষগুলো আবার নিঃস্ব হয়ে পড়ল। একজন বললেন, কী দরকার ছিল তেল খরচ করে আমাদের কাছে এসে আশ্বাস বাণী শোনানোর! আরেকজন বললেন, বাঁধ সারানো হলে আমরা ঠিক বেঁচে যেতাম!
পশ্চিম উপকূলে খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির জনপদে কান পাতলে এখন এসব কথা ভেসে আসে। মানুষজন অনেক সমস্যার কথাই বলেন; তার মাঝে ঘুরেফিরে একই কথা। অন্য যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে; তার নেপথ্য কারণ এই নাজুক বাঁধ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রবল ধাক্কা থেকে বাঁধ রক্ষা করা গেলে তেমন কোন সমস্যা হতো না। বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম পানি ঢুকেছে। মানুষগুলোর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। হাজার হাজার মানুষ নেমে গেছে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতে। আম্পানের প্রভাব শেষ হওয়ার পর গত সপ্তাহখানেক ধরে চলছে মেরামতের কাজ। খুলনার কয়রা, সাতক্ষীরার গাবুরা, বুড়িগোয়লিনী, কাশিমাড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণের ছবি আসছে একের পর এক।
‘আমরা আর কতকাল আশ্বাস বাণী শুনে শুনে অপেক্ষা করবো? জীবন তো শেষ হয়ে গেল।’ -কথাগুলো বলছিলেন গাবুরার বাসিন্দা খান আবু হাসান। নিজ এলাকার বর্ণনা তুলে তিনি বলছিলেন, দেশের মানচিত্রে গাবুরা উপকূলীয় অবহেলিত অঞ্চল। চারিদিকে নদী বেষ্টিত ৩৩ বর্গ কিলোমিটারে দ্বীপ। এখানে ৪৫ হাজার মানুষ প্রতিবছর নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, নদী ভাঙন, জলাবদ্ধতার কবলে থাকে। মানুষজন জান ও মালের অনিশ্চয়তার মাঝে বসবাস করে আসছে বছরের পর বছর। উপর মহল এটা জানেন; তবুও কোন কাজ হয় না।
খান আবু হাসানের এই ক্ষোভ ঝরানো কথাগুলো কতটা সত্যি? তার কথার সূত্র ধরে খানিক পেছনে ফিরে গেলেই এর প্রমাণ মিলে। ২০০৯ সালের ২৫ মে। দিনটি ছিল সোমবার। সেদিন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা প্রলয়ে গাবুরার ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। আইলার পরে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন- বাঁধ হবে; সাইক্লোন শেলটার হবে। কিন্তু হয়নি। গত বছর এই এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রলয়। তখন বাঁধ ছিঁড়েনি বটে; কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ একেবারে কম ছিল না। ফণী চলে গেল; এলেন মন্ত্রীদ্বয়। একইভাবে আশ্বাস দিলেন তারাও। এই আশ্বাসের ফলোআপও আছে; অক্টোবরে এলাকা ঘুরে এসেছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্যরা। এতকিছুর পরেও আজ পর্যন্ত সে আশ্বাস গল্পই রয়ে গেছে। আর তারই ফল আম্পানের প্রলয়। এটা আম্পানের ছোট ধাক্কাই বলা যায়; কেননা ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি কমিয়েই পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনেছে।
আম্পানের আঘাতের আগে বহুবার এই দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ঘুরে দেখেছি নাজুক পরিস্থিতি। কোথাও বাঁধ আছে অর্ধেক; কোথাও মোটরবাইক তো দূরের কথা; পায়ে হেঁটে যাওয়াও কঠিন। কোথাও আবার দেখেছি স্থানীয় জনসাধারণ নিজেদের উদ্যোগে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এই ইউনিয়নের ধ্বসে যাওয়া যে স্থানগুলোর নাম বার বার সংবাদ মাধ্যমে উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলো আমার চেনা পথ। পারশেমারী, চাঁদনিমুখা, নাপিতখালী, নেবুবুনিয়াসহ আশপাশের এলাকাগুলো কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর; তার ছবি আমার ফটোফোল্ডারে ঠাসা। স্বাভাবিক জোয়ারেও এসব স্থান জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়। কোথাও বাঁশের পাইলিং, তার ভেতরে আবার পুরানো টিনের টুকরো দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা। দৃশ্যমান সব ছবি। বলা যায় নাজুক বাঁধগুলোও টিকে আছে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ টিকানোর উদ্যোগের মধ্যদিয়ে। এলাকার মানুষেরা বছরের পর বছর প্রকৃতির সঙ্গে অনেকটা লড়াই করেই বাঁধ টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আম্পান তাদের সর্বনাশ করে দিয়ে গেল।
এতো গেল শুধু গাবুরার কথা। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, পদ্মপুকুর কাশিমাড়ী, আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া, শ্রীউলা, প্রতাপনগর, খাজরা, খুলনার কয়রা উপজেলার কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী, মহারাজপুর, পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি, সোলাদানা, লস্কর এবং বাগেরহাটের রামপাল ও শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় গ্রাম, জনপদ, চিংড়ির ঘের, ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। পশ্চিম উপকূল ছাড়াও দক্ষিণের পটুয়াখালী, ভোলা জেলায়ও বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এরফলে এই সময়ের সকল ফসল নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে চিংড়ির ঘেরে।
সূত্র বলছে, ষাটের দশকে নির্মিত পশ্চিম উপকূলের বাঁধগুলো ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছিল। আশির দশকে এই এলাকায় চিংড়ি চাষের শুরুতে বাঁধ আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এরসঙ্গে লবণপানির ধাক্কা, জোয়ারের পানির প্রবল চাপ এই বাঁধকে নাজুক করে তোলে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে এইসব বাঁধ মেরামতের কাজ হলেও যথাযথভাবে কাজ না হওয়ায় বাঁধের এই বেহাল
এ প্রসঙ্গে পানি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, উপকূল অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। এর উচ্চতা অনেক কম। এক স১৫ ফুট উচ্চতার বাঁধ করা হয়েছে। তখন ঘূর্ণিঝড়ের এই প্রভাবের চিন্তা বিবেচনায় ছিল না। আগামীতে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়বে কীনা বলা মুশকিল; তবে জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা বাড়বে; এটা বলা যায়। সে কারণে বাঁধের উচ্চতা অন্তত তিন মিটার বাড়াতে হবে। সমুদ্রের দিকে বাঁধ করতে হবে। এক সময় বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে পানি কমিটি করা হয়েছিল। এখন তা সেভাবে কার্যকর নয়। একে কার্যকর করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, উপকূলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার বাঁধ আম্পানের মত ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয়। প্রতি অর্থ বছরে বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যে অর্থ বরাদ্দ হয়; তা পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি বিদেশি সাহায্য নিয়ে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নাজমুল আহসান দাবি করেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজে যেসব দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ আছে; তা আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে। দুর্নীতি রোধে নানামূখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন স্বচ্ছতার সঙ্গেই সকল প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ের ঝুঁকি মোকাবেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ‘কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ গ্রহন করে; যা সংক্ষেপে সিইআইপি নামে পরিচিত। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ২০১৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু জমি না পাওয়া, নদীর ভাঙন ইত্যাদি কারণে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। এ প্রকল্পের আওতায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ব্যয় হচ্ছে ৬৯৬ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে কোস্টাল এমব্যাকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, সিডর ও আইলা পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় এলাকায় যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে; তা কমিয়ে আনাই এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। আমরা কাজ করছি। কোন স্থানের কাজ শেষ হয়েছে, কোন স্থানের কাজ কিছু বাকি রয়েছে। বাগেরহাটের শরণখোলায় প্রকল্পের আওতায় নির্মানাধীন একটি বাঁধ আম্পান আঘাতের আগেই ধ্বসে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদীর ভাঙনের কারণে আগে থেকেই সেখানকার অবস্থা নাজুক ছিল। প্রকল্প প্রণয়নের সময়ে নদী শাসনের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল না। সে কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বিলম্বিত হচ্ছে। সময় এ বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে; আরও এক বছর বাড়াতে হতে পারে।
সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে দেশের দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রম। ২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য বিশেষায়িত এলাকা থেকে অনেক বড়। ডেল্টা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চলের বিদ্যমান পোল্ডারের কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঝড়বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ও লবনাক্ততার অনুপ্রবেশ মোকাবেলা করা হবে; পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে উপকূলীয় বাঁধ শক্ত ও উঁচু করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অথচ বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রকল্প পরিকল্পনা, আবেদন, অনুমোদন এবং বাস্তবায়নেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাঁধ সংস্কার প্রকল্পগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
বাঁধের মালিকানা জনগণকে দেওয়ার দাবি তুলেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও দুর্যোগ ফোরামের আহবায়ক গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, দেশের মালিকানা জনগণকে না দিলেও মানুষের জীবন বাঁচাতে অন্তত বাঁধের মালিকানা জনগণকে দিতে হবে। বাঁধ কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে; সেটা জনগণই ঠিক করবে। ভোলার চরফ্যাসনে জনঅংশগ্রহণে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে সুফল পাওয়া গেছে। আর এখন জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ ভেঙে যেসব স্থান দিয়ে পানি ঢুকেছে; অবিলম্বে সে পানি সরাতে হবে। তা না হলে বাঁধের ভেতরের কৃষি নষ্ট হয়ে যাবে। মানুষ চরম সংকটের মুখোমুখি হবে। কৃষিকে আমাদের মূল কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।
উপকূল অঞ্চলে বিদ্যমান বাঁধগুলোর সংস্কার এবং নতুন বাঁধ তৈরিতে কমিউনিটির নেতৃত্বাধীন বাঁধ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ক্লাইমেট ফিন্যান্স এনালিষ্ট এম. জাকির হোসেন খান।
তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে বাঁধ সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হলে একদিকে যেমন খরচ অনেক কমবে; একইসাথে মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পাবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে তদারকির দায়িত্ব দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড শুধুমাত্র বাঁধের ডিজাইন প্রণয়ন ও স্থানীয় নাগরিকদের কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে। যেকোন দুর্যোগে স্থানীয় কমিউনিটিই পারে শত বছরের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কার্যকর প্রাণ ও প্রকৃতি বান্ধব দুর্যোগ সহিষ্ণু টেকসই উন্নয়ন তথা কার্যকর জলবায়ু অভিযোজন নিশ্চিত করতে।
বাঁধ বিপন্ন এলাকার মানুষেরা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে বাঁধের ওপর। বাঁধের ক্ষতি হলে তাদের সব ভেসে যায়। ফসল নষ্ট হয়, বাড়িঘর নষ্ট হয়। জরুরি খাবার না দিয়ে বাঁধটা শক্ত করে বানিয়ে দেওয়ার দাবিটাই তাদের কাছে প্রধান। বাঁধের ফাঁদ জনজীবন বিপন্ন করে তুলেছে।
জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় ষাটের দশকে উপকূলে মাটির যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, তার কার্যকারিতা অনেকখানি হারিয়ে যাওয়ায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জোরাল হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাঁধ দীর্ঘদিন ধরে জোয়ারের ধাক্কায় যেমন ক্ষয়ে গেছে, তেমনই কমেছে উচ্চতাও। তার বিপরীতে বেড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আবার জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় মাটির বাঁধও ভাঙছে অহরহ।
ফলে রেমালের মত ঘূর্ণিঝড়ে প্লাবিত হচ্ছে উপকূল। তাতে লবণাক্ততার বিস্তার হওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ।
অর্ধশতাব্দীর পুরনো এই বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ঠিকমত হয় না বলে উপকূলের বাসিন্দারা বহু বছর ধরেই বলে আসছেন। এবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে যে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে, তাতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার দক্ষিণ কাইনমারী গ্রামেও।
সেই গ্রামের বাসিন্দা রত্না এমিলিয়া শেখ বলছিলেন, পুরনো এ বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর ঠিক করা হয়; কিন্তু সেটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো উপযোগী নয়।
“এত বড় ঝড়ে মাটির বেড়িবাঁধ টিকতে পারে না। আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের জন্য যদি বেড়িবাঁধটা টেকসই করে দেয়, তাইলে আর কিছু লাগবে না।”
ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে উপকূলের বেড়িবাঁধের অন্তত ৮৮০টি স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই দুর্যোগের সময় সুন্দরবনের কোথাও কোথাও ৬-১০ ফুট উচ্চতায় প্লাবিত হয়। সেখানে গাছগাছালির তেমন ক্ষতি না হলেও হতাহত হয়েছে বন্যপ্রাণী। আর জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটেছে বনের বিভিন্ন অংশে।
সমুদ্র উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প: কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এ প্রকল্পের অবস্থান।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে দুই পর্বে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৮৮ সাল থেকে দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সংস্কার কর্মসূচি চলছে।
জোয়ার থেকে ভূমিকে রক্ষা করতে বেড়িবাঁধ কার্যকর; কিন্তু বাঁধের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়া জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে তা রক্ষা করতে পারে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের সাবেক প্রকৌশলী সাইফুল হোসেন বলেন, “ষাটের দশকের বেড়িবাঁধগুলো মাটির বেড়িবাঁধ। যে বিবেচনায় তখন করা হয়েছিল, সেটা এখন বদলে গেছে। বাঁধের উচ্চতা ২০-২৫ বছর ধরে… এখন আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
“বেড়িবাঁধগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণও হয়নি। বেড়িবাঁধে মানুষ বসবাস করা শুরু করেছে। গরু-ছাগল লালন-পালন থেকে ফসলাদি রাখা হয়েছে। সোজা কথা- বেড়িবাঁধের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৪০-৫০ বছরে, সেই পরিমাণে রিপেয়ারিং হয়নি।”
সাইফুল হোসেন বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণে যেভাবে প্রটেকটিভ মেজার নেওয়ার কথা, সেটা সেভাবে পারেনি। মেনটেইনেন্স হয়নি। চিংড়ি ঘেরের প্রভাব তো রয়েছে।”
তিনি জানান, গত কয়েক দশকে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বেড়েছে। তাতে বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সাইফুল বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। মানসম্মত রক্ষণাবেক্ষণও দরকার, সেটা হয় না। বাস্তবে রক্ষণাবেক্ষণও সেভাবে হয় না।
“বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে একসময় ৫-৭ কিলোমিটারের জন্য একজন পাহারাদারও ছিল। সে পদও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে পোল্ডার (উপকূলীয় বাঁধের একাংশ) রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে সাইফুল হোসেন বলেন, “বেড়িবাঁধগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের, সরকারের। এ কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
“মেইটেইনেন্সটা সরকারই করবে। কিন্তু ওনারশিপ ফিলিং থাকতে হবে, এ বাঁধ আমাকে রক্ষা করতে হবে। এ বাঁধ রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। বাঁধ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে আমাকে রক্ষা করবে, সুতরাং এ বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের করতে হবে।”
ডাচ শব্দ পোল্ডার (Polder) অর্থ বন্যা নিরোধের জন্য নির্মিত দীর্ঘ বাঁধ (ডাইক) বেষ্টিত এলাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৪টি উপকূলীয় জেলায় ১৩৯টি পোল্ডারের সমন্বয়ে ৬ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করে, যায়১২ লাখ হেক্টর কৃষি জমি ও উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার কথা।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সারাবছরই চলে বাঁধ ভাঙা আর গড়ার খলা। নদীভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও খুলনা জেলার নদীর পাড়ের মানুষের আতঙ্ক এখন সেই বাঁধ। সামান্য জোয়ারের পানিতে এখন বাঁধ ভাঙনের ভয়ে থাকে উপকূলের জনপদ।
বিশেষ করে কয়রা, পাইকগাছা এবং দাকোপ অঞ্চল জুড়ে মানুষের মধ্যে বছর জুড়ে একটা আতঙ্ক থাকে। বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি বেড়ে গেলে উপকূলীয় এ অঞ্চলগুলোর নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে নদীভাঙন আতঙ্ক তৈরি হয়। সাগরের উত্তাল ঢেউ এবং নদীর গতি বদলের ফলে এলাকাগুলোতে ভাঙনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর। অন্যদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংশ্লিষ্টরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, ফুলতলা, দিঘলিয়া, রূপসা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা জেলা। নদীর ভাঙন ঠেকাতে জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৭টি পোল্ডার রয়েছে। এসব পোল্ডারের দৈর্ঘ্য মোট ১ হাজার ১৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। যার মধ্যে ৬ দশমিক ৭৭১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় রয়েছে ৯টি পোল্ডার। যার মোট দৈর্ঘ্য ২৯৯ দশমিক ০৬ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় রয়েছে ১৮টি পোল্ডার। যার দৈর্ঘ্য ৭১৪ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার। উপজেলাগুলোর মধ্যে দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা এবং কয়রায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ণ দুর্বল রয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরা জেলা শ্যামনগর আশাশুনি আরঅন্যদিকে পাইকগাছা এবং কয়রায় নদী ভাঙনের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার। বাকি তিনটি পোল্ডার জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে কেউই এ রক্ষণাবেক্ষণ করছে না।
আরও জানা যায়, উপজেলাগুলোতে বাঁধ মেরামত ও সংরক্ষণে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রায় ৭১ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রায় ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রায় সাড়ে দশ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের মধ্যে রয়েছে কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকা, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকা, মহারাজপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবাদ, মঠেরকোনা, মঠবাড়ি, দশহালিয়া এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে গণেশ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার এবং মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল এলাকা, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকা, পাইকগাছার আলমতলার হাট থেকে পাইকগাছা ব্রিজ পর্যন্ত এক কিলোমিটার বাঁধ, দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা, বটবুনিয়া এলাকা, সুতারখালী ও বাণীশান্তা ইউনিয়নের একাধিক পয়েন্ট।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত