আলকামা রমিন, খুবি : স্বতন্ত্র জলবায়ুতে স্থানীয় চাহিদার জন্য স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ, ধান চাষের সবচেয়ে অভিযোজিত উপায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের নয়জন শিক্ষার্থী এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লোকজের (LoCOS) সহযোগিতায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কৃষকদের জন্য ১০০ অধিক ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা। শত’র অধিক ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করা যা এই অঞ্চলের জন্য প্রথম।
আমন ধানের কোন ভ্যারাইটিজ বা জাত থেকে কৃষকরা উপকৃত হবে তার পরীক্ষামূলক চাষের কার্যকারিতা অনুসন্ধানের জন্য ২০২৪ সালের জুলাই থেকে খুলনা বটিয়াঘাটায় মাঠ পরীক্ষা করেছেন এই গবেষক দল। তারা হলেন- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল ওয়াটার এন্ড এনভারমেন্ট ডিসিপ্লিন এর সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম এর নেতৃত্বে একই ডিসিপ্লিনের সাবেক শিক্ষার্থী মোঃ রাকিব হাসান, মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আব্দুল খালেক সরকার রাব্বানী, চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আশা আক্তার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রিমা আক্তার ও নীরব সরকার এবং এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের তৃতীয় ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইসরাফিল হোসেন ও মোঃ মাহফুজ।
এ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আমন মৌসুমে কৃষকদের জন্য বালাম জাতের ভিতর বাঁশফুল, জটাই, চরো, কার্তিক, চরবলেশ্বর, চিনি কানাই, আঁশফল ও মঘাই বালাম জাতগুলো অনেক ভালো ফলন দিয়েছে। পাশাপাশি, রাণী স্যালুট, কুমড়াগোড়, মরিচশাইন, সাহেব কচি, বজ্রমুড়ি, মন্তেশ্বর, তুলশীমালা, কাঁচড়া ও লোনাকচির জাত সংগ্রহে ও চাষে এই অঞ্চলের কৃষকরা দাম ও মানে লাভবান হবেন।
বার্ষিক ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত, খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে স্থানীয় কৃষকদের সংগঠন এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লোকজ (LoCOS) দ্বারা প্রতি বছর আয়োজিত “বীজ মেলা”তে খুবির গবেষক দল তাদের পরীক্ষিত বীজ বিনিময় করেন।
লোকজের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর দেব প্রসাদ সরকার বলেন, সরকারি পর্যায় থেকে উপসী বা হাইব্রিড জাত লাগানোর জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু উফসী ও হাইব্রিড জাতে বীজ সংরক্ষণ করা যায় না।
আমাদের মনে হলো দেশিও জাতের বীজ এবং ধানের জাত ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকদের নিয়ে আমরা গবেষণা করে দেখেছি স্থানীয় কোন কোন ধানে জাত কৃষকরা জন্য লাভবান এবং উপকৃত হবেন। আমরা বেশ কিছু ধানের জাতের বীজ সংগ্রহ করেছি এবং পরীক্ষামূলকভাবে কৃষকদের দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমরা কৃষকদের ফ্রিতে এগুলো দিয়ে থাকে। এই বীজ সংরক্ষণে এবং ধান চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন এবং তারা নিজেরাও বীজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। একই সাথে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করছেন এবং সেই ফসল থেকে বীজ সংরক্ষণ করে আবার আমন মৌসুমে নিজরা ধান উৎপাদন করছেন। এ থেকে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।
গবেষক সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম জানান, আমরা এখানে ধান লাগানোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল প্রকার ডাটা সংগ্রহ করে কৃষকদের জন্য বেস্ট ধানের জাতগুলো নির্বাচন করেছি। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কৃষকরা কম খরচ ও পরিশ্রমে বেশি তাদের বেস্ট ধানের মানটা যেন সংগ্রহ করতে পারে। মাঠ দিবসে আমাদের গবেষণা করা বীজ সংগ্রহ করে, কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। আমরা ৯০টির উপরে আমন জাত এবং মোট ১১৪টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করেছি। বন্যা ও খরার সময় জাতগুলো ফসল উৎপাদনে কোন বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। এমনও সব ধানের জাত নিয়ে গবেষণা ও তার বীজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ১০০ অধিক দেশীয় জাতের ধান নিয়ে গবেষণা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আর কারোর নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুবির অ্যাগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘এই গবেষণা নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ। আবহমান কাল থেকে দেশীয় ধানের জাত আমাদের আবহাওয়ার সাথে খাওয়াতে সবচেয়ে সক্ষম। দেশীয় ধান চাষে পরিবেশের বিপর্যয়কারী এগ্রো কেমিক্যাল তেমন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। উফশী এবং হাইব্রিডে পরিশ্রম দেওয়া হয় তার বিপরীতে কম পরিশ্রম দিয়েও এর ফলন ভালো হয়। এর বীজ সংরক্ষণ করা যায়। এই ধানের ভাত খুবই সুগন্ধি হয়। এমন কিছু কিছু জাত আছে যাতে তরকারি না ব্যবহার করেও ভাত শুধু খাওয়া যায়। দেশীয় ধানের জাতে বাহারি ধরনের পিঠাপুলিও তৈরি করা যায়। এর পুষ্টি উপাদান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। প্রতিকূল পরিবেশেও কিছু কিছু ধানের জাত তার সঠিক ফলন দিতে সক্ষম। আমার মনে হয় দেশীয় ধানের জাত এবং বীজ সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে কারণ এগুলোই আমাদের সোনার খনি।’