জন্মভূমি রিপোর্ট : খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টাকা ছাড়া মেলে না মরদেহ। ময়নাতদন্তের পর লোক বুঝে বিভিন্ন রকমের অর্থ চাওয়া হয় নিহতের পরিবারের কাছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ না দিলে মরদেহ না পাওয়ার সাথে-সাথে মেলে দুর্ব্যবহার। এর নেপথ্যে রয়েছে একটি চক্র। যার মূল হোতা হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আতাউর রহমান। খুমেক হাসপাতালের মর্গে মরদেহ আটকে রেখে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানকালে এর সত্যতা মিলেছিল। যার কারণে ওই সময়ে ওয়ার্ড মাস্টারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পরিচালক ডা. এটিএম মঞ্জুর মোর্শেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করেছিলেন।
গত ৩ মে দুপুরে দাকোপের অগ্নিদগ্ধ রাহেলা বেগমের মরদেহ ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে স্বজনরা পড়েন মহাবিপত্তিতে। লাশঘর থেকে মরদেহ ছাড়াতে তাদের কাছে ৩ হাজার টাকা দাবি করা হয়। না হলে পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) ছাড়া মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। অবশেষে অনেক কাকুতি-মিনতি করে ২ হাজার ৫শ’ টাকায় মরদেহ ছাড়ানো হয়।
শুধু শহিদ উদ্দীন নন, হাসপাতালের মর্গে যতগুলো মরদেহ যায়, তাদের স্বজনরা টাকা ছাড়া মরদেহ ছাড়াতে পারেন না বলে জানান গোয়েন্দা বিভাগ। আর এর নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করে ওয়ার্ড মাস্টার আতাউর রহমান। মরদেহপ্রতি দাবি করা হয় ৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ওয়ার্ড মাস্টারের যোগসাজশে জাহাঙ্গীর নামে যে ব্যক্তি টাকা গ্রহণ করেন, তিনি হাসপাতালের কোনো কর্মী নন। ওয়ার্ড মাস্টার তাকে ফ্রি সার্ভিস কর্মী নামে নানা কাজে নিয়োজিত রাখেন।
হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানা যায়, আন্ত:বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫শ’ জনের মতো রোগী ভর্তি থাকে। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ জনের মতো রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া, আত্মহত্যা করা, আগুনে পোড়া, পানিতে ডুবে যাওয়া মরদেহ সরাসরি রোগীর স্বজনের কাছে হস্তান্তর করে তা মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে রোগীর স্বজনরা হয়তো পোস্টমর্টেমের পরে বা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র এনে মরদেহ নিয়ে যান। তবে কিছু মরদেহ, যেমন নিজ ঘরে আগুনে পোড়া, ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া ও পানিতে ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে বা জেলা প্রশাসকের অনাপত্তি না নিয়েও হাসপাতাল থেকে মরদেহ ছাড় করা হয়। মৃত্যুর কারণ ও পরিবারের অভিযোগ না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মরদেহ ছেড়ে দিতে আপত্তি করে না। এই সুযোগটাই ব্যবহার করেন ওয়ার্ড মাস্টার আতাউর রহমান।
ওয়ার্ড মাস্টার মো: আতাউরের সম্পর্কে হাসপাতালের কিছু নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। সেই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে অন্য নামে খুমেক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে তিনি পথ্য ঠিকাদারি কাজ করছেন এবং মালামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম করছেন। এছাড়া ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে চতুর্থ শ্রেনি কর্মচারী ও আউটসোর্সিং কর্মচারীর ডিউটি রোস্টার করে বিভিন্ন কর্মচারীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। সে সময় তাকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় থেকে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে বদলী করা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই প্রভাব খাটিয়ে তিনি ফের খুমেক হাসপাতালে যোগদান করেন।
ওয়ার্ড মাস্টার মো: আতাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাসপাতাল তো আমি একা চালাই না। এখানে পরিচালক আছেন, উপ-পরিচালক আছেন, তত্ত্বাবধায়ক আছেন। তারা হাসপাতালের মূল দায়িত্বে, আমি তো শুধু ছোট একটি দায়িত্ব পালন করি। আমি অনিয়ম করলে তারা কি আমাকে ছেড়ে দেবেন?’ আগের পরিচালকের ব্যাপারে তিনি বলেন, ওই পরিচালক নিজেই একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি অবসরে যাওয়ার আগে ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ দেবেন? তিনি মরদেহ জিম্মি করে টাকা নেয়ার ব্যাপারে বলেন, এটা আমি করি না। গত ৩ মে’র ঘটনাটা ডোমরা করেছিল। পরে সেই টাকা তারা ফেরৎ দিয়েছে। এখানে আমার কোনো দোষ নেই।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, ‘ওয়ার্ড মাস্টার মো. আতাউর রহমানকে একাধিকবার মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। তবে তার দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। অভিযোগ নিয়ে তিনি বদলি হলেও কিছুদিনের মধ্যে আবারও এই হাসপাতালে ফিরে আসেন। কয়েক দিন আগের মরদেহ আটকে টাকা নেয়া ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টির ঘটনাটি পরিচালককে জানানো হয়েছে। বাকি ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব তার।
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক রবিউল হাসান বলেন, মরদেহ আটকে টাকা দাবি করা একটি জঘন্য ঘটনা। সে যদি এটা করে, তবে শাস্তি পেতে হবে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত