জন্মভূমি রিপোর্ট : খুলনার শহর ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে খুন, জখম, ডাকাতি, দস্যুতাসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রায় নিয়মিত ঘটে চলেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জনমনে আতংক বিরাজ করছে। আইনজীবী সমিতির নেতা এবং নাগরিক নেতারা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সদস্য সচিব শেখ নূরুল হাসান রুবা দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, একটি মহল দেশে অরাজক পরিস্থিতি চাচ্ছেন এবং তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, পুলিশের দুর্বলতা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য তিনি পুলিশ প্রশাসনকে আরও বেশি সজাগ থাকার এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন। তিনি দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে এখনও পুলিশ মেরুদণ্ড সোজা করে দাড়াতে পারেনি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই সময়ের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী জামিনে মুক্ত হয়েছে। এছাড়া খুলনা একসময় চরমপন্থী অধ্যুসিত এলাকা ছিল। বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠেছে। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক কোন্দল, পূর্ব শত্রুতা, চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং মাদক কারবার কেন্দ্রীক বিরোধের জের ধরে খুন-জখমের ঘটনা বেড়েছে বলে তার ধারণা। পরিস্থিতির উন্নয়নে তিনি প্রশাসনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহবান জানান।
গত শনিবার রাত ১১ টার দিকে শহরের বাগমারা এলাকায় একটি চরমপন্থী দলের ক্যাডার শেখ শাহীনুল হক শাহিন ওরফে বড় শাহিনকে ঘাতকেরা গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুইটি গুলির খোসা আলামত হিসেবে জব্দ করেছে। এর মাত্র দুই ঘন্টা আগে নিরালা এলাকায় সন্ত্রাসীদের ধাঁরালো অস্ত্রাঘাতে মোস্তাকিম বিল্লাহ লনি নামে এক ব্যবসায়ী জখম হয়েছেন। যদিও তাকে লক্ষ্য করে শ্যুটারের করা গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
খুলনা সদর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শাহজাহান আহমেদ দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, নিহত শাহিনের মা সোমবার বিকেলে পাঁচ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫/৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে বলে তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, একই রাতে নিরালা হাজী বাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসিদের ধাঁরালো অস্ত্রাঘাতে টিসিবি ডিলার ও জ¦ালানি তেল ব্যবসায়ী মোস্তাকিম বিল্লাহ লনি নামে একজন জখমের ঘটনায় হত্যাচেষ্টাসহ কয়েকটি অভিযোগে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা হয়েছে। অভিযোগকারী হামলার কারণ হিসেবে এজাহারে পূর্ব শত্রুতার কথা উল্লেখ করেছেন। গত রাত ৯ টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মামলা দুইটির কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি। তাদের গ্রেফতারসহ খুন-জখমে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত বড় শাহীন খুলনার দৌলতপুরের বিবদমান ২টি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে আলোচিত টাইগার খোকনের বিশ্বস্ত সহচর ছিল। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় একটি বাড়িতে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে ব্রাশ ফায়ারে টাইগার খোকনসহ তার তিন সহযোগী নিহত হয়। এরপর টাইগার খোকনের ছোট ভাই জামিরকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। একই গ্রুপের হাতে নিহত হয় আড়ংঘটা এলাকার ৫জন। যারা সকলেই টাইগার খোকনের অনুসারী ছিলেন। এরপর থেকে খোকন গ্রুপের অনুসারীরা এলাকা ছাড়া হয়ে যায়। তবে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দৌলতপুরের চরমপন্থি গ্রুপের অন্যতম নেতা হুজি শহিদ নিহত হওয়ার পর ওই এলাকার বিবাদমান সকল সন্ত্রাসী গ্রুপ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের আসামি করা হয়। তখন থেকে নিহত বড় শাহিন আত্মগোপনে চলে যায়।
কেএমপি’র বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, গত ১০ মার্চ রাতে লবনচরা থানার হঠাৎ বাজার এলাকায় সাবেক যুবদল নেতা রফিকুল ইসলাম চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন। বিএনপি’র নব্য সদস্যদের ১০/১৫ জনের একটি দল হামলা চালিয়ে তাকে জখম করে। একই রাতে খালিশপুর থানা এলাকায় ছিনতাইকরীরা মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর নামে এক ইজিবাইক চালককে ছুরিকাঘাত করে তার বাহনটি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। জখম হওয়া ব্যক্তির আর্তচিৎকারে আশ-পাশের লোকজন ছুটে আসেন এবং ধাওয়া করে মশিউর রহমান সাগর নামে একজনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। যদিও ঘটনাস্থল থেকে তিন ছিনতাইকারী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৯ মার্চ রূপসা উপজেলা এলাকায় রাকিব মাহামুদ বন্ধন নামে এক যুবককে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে একই উপজেলার বাধাল গ্রামের একটি বাড়ীতে অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে দুই যুবককে গ্রামের কিছু মানুষ গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। সেখানে একটি ককটেল বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটেছে। গত ৪ মার্চ দৌলতপুর থানা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। যদিও এতে কেউ হতাহত হয়নি। থানা পুলিশ বলছে, সেখানে দুই রাউণ্ড ফাঁকা গুলি করা হয়েছিল। এ ঘটনায় মিলু নামে এক ব্যক্তি তিন জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
এদিকে, রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন এলাকায় গত ৯ মার্চ রাতে সন্ত্রাসীরা বন্ধন নামে এক যুবককে চাইানজ কুড়াল দিয়ে দুই হাটু, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তিনি খুমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনায় চার জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দুই-তিন জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চলছে বলে রূপসা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন।
তিনি দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, গত শুক্রবার রাতে দিঘলিয়া উপজেলার বাসিন্দা আলামিন তার স্ত্রীকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে বাধাল গ্রমের শ^শুর বাড়ীতে আসেন। এরপর স্থানীয় লোকজন তাদের ধাওয়া করে। তখন ওই যুবক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ভ্যান চালক এবং আরেক যাত্রী গণপিটুনির শিকার হন। তাদেরকে পরবর্তীতে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ চলে আসার পর সেখানে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। আহত দুই জনের বিরুদ্ধে ওই নারীর পরিবার অনধিকার প্রবেশের অভিযোগে মামলা করে। এছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
মাস খানেক আগে রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়ন এলাকা হতে পাঁচটি ছিনতাই করা ভ্যানসহ পুলিশ দুই জনকে গ্রেফতার করে। ওই এলাকায় একাধিক ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় অভিযোগ করতে যাননি বলে ভ্যান চালকদের সূত্রে জানা গেছে। ওই ইউনিয়নের যুগিহাটী গ্রামে এক প্রতিবন্ধী যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু পুলিশি তৎপরতার খবর পাওয়া জায়নি।
গ্রামীন জনপদের বিভিন্ন স্থানে চুরি, ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধ বেড়ে গেছে বলে কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানের কয়েকজন বাসিন্দার কাছ থেকে জানা গেছে। তারা বলেছেন, অনেক ঘটনা নিয়ে ভুক্তভোগীরা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে যাচ্ছেন না।
খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে জনমনে উদ্বেগ

Leave a comment