
মূলধনের অভাব
ভারতীয় সিন্ডিকেটের পুজি লগ্নি
শেখ আব্দুল হামিদ : কোরবানি আসন্ন। মূলধনের অভাব আর ভারতীয় সিন্ডিকেটের পুজি লগ্নিতে খুলনা চামড়া পট্টির এক প্রকার অবসান হয়েছে। খুলনা শেরে বাংালা রোডের চামড়া পট্টি সংকুচিত হয়ে এখন আর কোন দোকান নেই। প্রায় ৫০ জন ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে পেশার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ইজিবাইক চালিয়ে, আমড়া বিক্রি করে, অন্য কোন দোকানে কর্মচারী হয়ে, আবার কেউ বা বড় বাজারে কাঁচামালের দোকান দিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। শেখপাড়া চামড়া পট্টিতে এখন গড়ে উঠেছে লেদমেশিনের দোকান। তারপরও কোরবানীর সময় এলে দু’একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত ভাবে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসে চামড় কিনে থাকেন।
খুলনার সীমান্তগুলো দিয়ে ভারতীয় গারু আসা বন্ধ হলেও ভারতের ব্যবসায়ীরা চামড়া নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এই মুহুর্তে চরম সক্রিয়। কলোবাজারি চামড়া ব্যবসায়ীরা তাই নড়েচড়ে বসেছে। ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা, লবনের মূল্য বৃদ্ধি, পুজি সংকট, ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির টাকা সম্পূর্ণ না পাওয়াসহ নানা কারণে খুলনার ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা থেকে দূরে সরে গেছেন। সে সুযোগে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বৃহত্তর খুলনায় চামড়া বাজারের নিয়ন্ত্রন নিতে মোটা অংকের টাকা লগ্নি করার চেষ্টায় আছেন। এ কারণে এবারের কোরবানির চামড়া খুলনার ব্যবসায়ী ও টেনারি মালিকদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতীয় ফড়িয়াদের চক্রান্ত এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্নসহ নানা কারণে খুলনার অর্ধশতাধিক চামড়া প্রতিষ্ঠান এখন মাত্র ১টিতে নেমে এসেছে। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে সীমান্তে নজরদারি ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে কালোবাজরিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে লবনের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা হতাশায় আছেন।
কোরবানী এগিয়ে এলেও মুখে হাসি নেই চামড়া ব্যবসায়ীদের। তারা বাকিতে কেনাবেচা করেন। আর এ বাকি টাকা মহাজনদের কাছ থেকে আদায় করতে হিমশিম খেতে হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। ঈদের জন্য এখনও চামড়ার প্রতি বর্গফুটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। খুলনা শেখপাড়া চামড়া পট্রি মোড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো: আব্দুস ছালাম ঢালী বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছর চামড়ার ব্যবসায় আছি। ঢাকা এবং নাটোরের বিভিন্ন ট্যানারিতে আমাদের প্রায় দেড়কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ২০০০ সালেই আমার বাকী হয় ২০ লাখ টাকা। তারা ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে টাকা দিচ্ছে না। খুলনার বহু চামড়া ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে পেশার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। চামড়া পট্টিতে এখন আর একটি ঘরও নেই। এ ব্যবসা করার জন্য আলাদা কোন জায়গা নেই। আধুনিক জবাইখানার পাশাপাশি চামড়ার পৃথক বাজার একান্ত প্রয়োজন। একইভাবে জুলফিকার আলী, মোঃ মহাসিন, আমানুল্লাহ, ইয়াছিনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এখন আর ব্যবসা করেন না। দোকান ঘরও নেই। অনেকেই দেনা হয়ে এখনও পালিয়ে আছেন। মহাজনরা জোরপূর্বক এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে রেখেছেন যাতে তারা কোনো আইনগত সাহায্য নিতে না পারেন। কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, প্রতি বছর কোরবানীর ঈদের সময় পশুর চামড়া কেনার জন্য কোন ঋনের সুবিধা পায় না। প্রতি বছরই পুজি সংকট দেখা দেয়। এবার এ সংকট তীব্র আকার ধারন করেছে। আর এ সুযোগে পুজি বিনিয়োগ করে ফেলেছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। কারণ ভারতের বাজারে প্রায় দ্বিগুন দামে বাংলাদেশের চামড়া বিক্রি হয়। তাই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চোরাকারবারীরাও চামড়া ব্যবসায় পুজি বিনিয়োগ করেন দ্বিগুন লাভের আশায়। খুলনার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দাবি চামড়ার চোরাচালান বন্ধ করতে হলে অবশ্যই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সরকারী লোন দেয়ার সুব্যবস্থা করতে হবে। সীমান্ত এলাকাগুলোর চামড়া ক্রয়ের জন্য ভারতীয় টাকা এখন প্রবেশ করছে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে। ফলে কোরবানির চামড়ার বাজার খুলনা অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও টেনারি মালিকদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, ভারতের টেনারি শিল্প মালিকরা সিংহভাগ চামড়া অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে।
সূত্রমতে, ভারতীয় ফড়িয়া ও দালালরা বৈধ অবৈধ পথে বৃহত্তর খুলনায় আসতে শুরু করেছে। এ দেশীয় কালোবাজারী ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তাদেরকে শেল্টার দিচ্ছে। খুলনা বড়বাজার কেন্দ্রীক হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ভারতীয় ফড়িয়াদের সকল প্রকার সহযোগীতা করে থাকে। দেশে- বিদেশে চামড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অমিত সম্ভাবনা রয়েছে শিল্পটির। ঈদুল আযাহা উপলক্ষেই প্রতি বছর চামড়ার সবচেয়ে বড় যোগান সৃষ্টি হয়। এই মহেন্দ্রক্ষনকে সামনে রেখেই প্রতি বছর কালোবাজারীরা তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের ফাঁদ পাতে। আর সেই ফাদেই পা দিয়ে থাকেন প্রান্তিক চামড়া ব্যবসায়ীরা।
এ ব্যাপারে খুলনার নাগরিক নেতা এ্যাডঃ বাবুল হাওলাদার জানান, সরকারকে এই কালোবাজারীদেরকে রুক্ষতে হবে। খুলনা সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন সীমান্তের চোরাঘাট দিয়ে প্রতি বছর চামড়া পাচার হয়ে থাকে । এ বছরও তারা থেমে নেই। এ জন্য প্রয়োজন জন সচেতনতা ও সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। নইলে এ শিল্পটিও ভবিষ্যতে চরমভাবে অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে।