
জন্মভূমি রিপোর্ট : বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের চিকিৎসা সেবা ভেঙ্গে পড়েছে। দালালদের দৌরাত্ম, অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দলবাজি, কর্তব্যে অবহেলা, ডায়াগনোসিসে ভুল রিপোর্ট আর ডাক্তারদের বাণিজ্যিক মনোভাবে তৃণমূলের স্বাস্থ্য সেবা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে উঠছে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ, রোগীর প্রতি মনোযোগের অভাব, পরিকল্পিত ভাবে উন্নত চিকিৎসার নামে রোগী অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে পড়েছে। আইসিইউতে রোগী রেখে চিকিৎসার নামে অর্থবাণিজ্যে দিশেহারা রোগীর স্বজনেরা। প্রতিবাদ করলেই চিকিৎসক ধর্মঘট।
পুলিশের শিশু কন্যাকে চিকিৎসার নামে তার আঙ্গুল ফেলে দেয়ার ঘটনায় গোটা খুলনায় তোলপাড় শুরু হয়। এবার সাংবাদিক পত্নিকে চিকিৎসার নামে অবহেলায় মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না ভুক্তভোগী পরিবার।
সম্প্রতি দুইটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কারণে একজন রোগী এবং এক প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের শোলপুর গ্রামের গৃহবধু শায়লা শারমিন (৩০) গত ১২ মার্চ হঠাৎ পেটে ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই দিন সন্ধ্যায় তাকে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখে দেন। রোগীর স্বজনরা জানান, তাতে তার অবস্থার উন্নতি না হলে পরের দিন ১৩ মার্চ গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে ডা: সানজিদা হুদা সুইটির কাছে নেয়া হয়। তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র দেন। রাতে পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে তিনি বলেন, রোগী ওভারিয়ান ছিস্টে আক্রান্ত। দ্রুত অপারেশন না করা হলে ছিস্ট ফেটে ইনফেকশন হয়ে যাবে এবং বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। তিনি এন্টিবায়োটিক ওষুধ লিখে দেন। তার একটি রোগী রাতে সেবন করেন। ১৪ মার্চ রোগী ভীষনভাবে ব্যাথা অনুভব করলে গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে ভার্তি করা হয়। আবারও পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা হয় এবং তাকে অপারেশনের আগের প্রয়োজনীয় ওষুধ-ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। ১৫ মার্চ দুপুর দেড়টায় তার অপারেশনের জন্য চিকিৎসক সময় নির্ধারণ করেন। একটার পরেই তাকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেয়া হয়। সেখানে এনেস্থিসিয়া চিকিৎসক দিলিপ কুন্ডুসহ ওয়ার্ডবয় এবং অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। রোগীর সাথে তার স্বামী সাক্ষাৎ করে কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে ডা: দিলিপ বলেন, আর থাকা যাবে না তুমি বেরিয়ে যাও। দুপুর দুইটার পরেই চিকিৎসক সুইটি আসেন। একটু পরেই ওটি থেকে বেরিয়ে বলেন- রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন, সম্ভাবত কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়েছে। দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করেন। রক্ত যোগাড় করাকালীন বিকল্প ব্যাকআপ হিসেবে তিনি দুইটি ইনজেকশন পুশ করেন। ওটির জানালার গ্লাস দিয়ে দেখা যায়- রোগীর পেট ফুলে উঠেছে। পাশে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ডবয় ও উপস্থিত অন্যান্যরা কি যেন বলাবলি করে হাসছেন। রক্তের যোগাড় হলে চিকিৎসক বলেন- তার সিস্ট লিক হয়ে ব্লিডিং হচ্ছে, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। আইসিইউ সাপোর্ট আছে এমন জায়গায় নিতে হবে। তখন ডা: সুইটি, এনেসথেসিয়া চিকিৎসকসহ ওই ক্লিনিকের কয়েকজন এ্যাম্বুলেন্স যোগে দ্রুত খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ওটিতে নিয়ে অপারেশন করেন। পরে অপারেশন সাকসেসফুল বলে রোগীকে আইসিইউতে রেখে চলে যান।
সূত্রমতে, সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে আট দিন রাখার পর তাকে শহীদ শেখ আবু নাসেন বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ মার্চ ভোর ৬টায় তার মৃত্যু হয়।
ডা: সানজিদা হুদা সুইটি: রোগীটিকে অপারেশন করার উদ্দেশ্যে আমি গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে যাই। ঢুকেই দেখি এনেস্থিসিয়া দেয়ার প্রসেসিং চলছে। এনেস্থিসিয়া দেয়ার সময় সংশ্লিস্ট ডাক্তার থাকার প্রয়োজন আছে। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এনেস্থিসিয়া দেয়ার পরেও ডাক্তার এলে অসুবিধা হয় না। এ রোগীর ক্ষেত্রে আমার উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল, তাই আমি যথাসময়ে উপস্থিত ছিলাম। তবে এনেস্থিসিয়া জটিলতার কারণে অনেক সময় রোগীর অসুবিধা হতে পারে। তিনি বলেন, খুলনা মেডিকেলের ডা: দিলিপ একজন ভালো এনেস্থিসিয়া চিকিৎসক। তার ক্ষেত্রে এমন হবার কথা নয়। কিন্তু এনেস্থিসিয়া দেয়ার পরেই রোগীর কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। পরে সেটা রিকভারি করে। রোগীর ভিতরে বড় ধরণের কোন সমস্যা থাকলে সাধারণত এমন হয়। সব কিছুই এত দ্রুত পরীক্ষা করা সম্ভাবও হয় না। তার ইসিজিসহ অন্যান্য পরীক্ষায় কোন সমস্যা ধরা পড়েনি। রোগীকে ঠিকমত অক্্িরজেন প্রয়োগের জন্য এ্যামরোব্যাগ দিয়ে পাম্প করা হয়। টিউমার ছিদ্্্র হয়ে যাওয়ায় ব্লিডিংএর কারণে তার পেট ফুলে ওঠে। আমি রোগীর অপারেশন করতে চাইছিলাম না। তার স্বামীর সম্মতিতে দায়িত্ব নিয়ে ছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল ভালো হয়ে যাবে। তাই গরীব নেওয়াজে ঝুঁকি না নিয়ে খুলনা সিটি মেডিকেলে নিয়ে যাই। টিউমার অপারেশনের পর আইসিইউতে রাখা হয়। পরে রোগী রিসপন্ড করলেও আর ফেরেনি।
ডা: দিলিপ কুন্ডু: খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনেস্থিসিয়া বিভাগের প্রধান ডা: দিলিপ কুন্ডু বলেন- আমরা রোগীর রিপোর্ট দেখে যে পরিমাণ ওষুধ প্রয়োগ করা প্রয়োজন, ততটাই দিয়ে থাকি। তবে এনেস্থিসিয়া করার সময় ডা: সুইটি আমার সামনেই ছিলেন। পরীক্ষা রিপোর্টে রোগীর বামপাশের ওভারিতে সামান্য সিস্ট দেখা যায়। তখন বুঝা যায়নি ভিতরে এতবড় একটি টিউমার হয়ে গ্যাংরিলে পরিণত হয়েছে এবং ফেটেও গেছে। খুলনা সিটি মেডিকেলে নিয়ে অপারেশন করার সময় এটা ধরা পড়ে। তিনি আরও বলেন, মেডিকেল রিপোর্টে সঠিকটা এলে চিকিৎসায় ভুল হয় না। এ রোগীর রিপোর্টে এতটা ভুল তাকবে আমরা ধারণাও করতে পারিনি। গরীব নেওয়াজ ক্লিনিক থেকে প্রদত্ত ডা: রেহনুমা নাজনিন স্বাক্ষরিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে সিম্পিল সিস্ট। তারই প্রেক্ষিতে অপারেশন করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এ মাসে ডা: সুইটির বেশ কয়েকটি রোগী মারা গেছে।
এদিকে দাকোপ উপজেলার বানিশান্তা ইউনিয়নের উত্তর বানিশান্তা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য রামমোহন মিস্ত্রির স্ত্রী শিবানী বিশ^াস (২২) সিজার করানোর উদ্দেশ্যে ২২ মার্চ নগরীর বেস্ট কেয়ার ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সন্ধ্যা ৭টার দিকে শিবানীকে ওটিতে নেয়া হয়। রামমোহন বলেন, সাড়ে ৭টার দিকে ডা: সুইটি ওটিতে প্রবেশ করেন। সিজারের পর রাত ৮ টার দিকে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তখন ডাক্তার বলেন, প্রসূতি মায়ের রক্তের প্রয়োজন দ্রুত রক্ত যোগাড় করেন। রক্তযোগাড় করে ফিরে এসে দেখেন ডাক্তার চলে গেছেন। ক্লিনিকের লোকেরা তাকে এ্যাম্বুলেন্সে দ্রুত শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করেন। পরের দিন সকালে প্রসূতির মৃত্যু সংবাদ জানান হয়। তিনি এব্যাপারে ডা: সুইটিকে দায়ি করেন।