রাজনৈতিক শেল্টারে আসার চেষ্টা
অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি
শেখ আব্দুল হামিদ : বৃহত্তর খুলনায় নির্বাচনী বাতাস বইতে শুরু করায় অশিক্ষিত কিশোর সন্ত্রাসীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। উজ্জীবিত হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র গুডবুকে সক্রিয় হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশলে তারা দৌড় ঝাপ শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার উঠতি বয়সী অপরাধী এবং দাগী কথিত নিষ্ক্রিয় সন্ত্রাসীদের তালিকা তৈরী করে নজরদারি বাড়িয়েছে। অনেক নিষ্ক্রিয় সন্ত্রাসীরা এখন ফের সক্রিয়। কাছে টানছে টিনএজ সন্ত্রাসীদের। আর রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে লালিত কিশোর সন্ত্রাসীরা অধিকাংশই অশিক্ষিত। যাদের পারিবারিক কোন ভাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। নির্বাচনের হাতিয়ার হিসেবে এরা এখন মার্কেটে। ডিমান্ড হাই। অথচ বস্তিতে থাকা কিম্বা গ্রাম থেকে উঠে আসা এসব অপরাধীদের সামান্যতম অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত নেই। পোষাক পরিচ্ছদে বোঝারও উপায় নেই। এরা স্বশস্ত্র এবং ভয়ংকর।
রাজপথে মার্কেটে অফিস আদালতে কিম্বা ভোট রাজনীতির মাঠে এরা সন্ত্রাসের বিষ্ফোরণ ঘটায়। আতংকিত করে তোলে নিরীহ জনপদ। অস্ত্রের মহড়ায় প্রকম্পিত করে তোলে নির্বাচনী মাঠ। মহানগর থেকে গ্রাম গ্রামান্তরে সকল শ্রেনী পেশার মানুষ এদের কাছে জিম্মি। এদের বন্দীদশা থেকে মুক্তি চায় নিরীহ সাধারণ মানুষ। র্যাব, পুলিশ সহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বিভিন্ন সময়ে সাড়াশি অভিযান চালিয়েছে। ধরা পড়েছে অস্ত্র সহ এসব সন্ত্রাসীদের অনেকেই। তারপরও থেমে নেই এদের কার্যক্রম। সরকার প্রতিবছর এই সন্ত্রাস দমনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। অনেক সন্ত্রাসীদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করছে। গোয়েন্দা সংস্থা তালিকার পর তালিকা করছে। এই সন্ত্রাসীদের কাছে রাজনীতিক, ডাক্তার, সাংবাদিক, আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কোন শ্রেনী পেশার মানুষ নিরাপদ নয়।
র্যাব, পুলিশ সহ অন্যান্য সংস্থা দফায় দফায় এ্যাকশন নিচ্ছে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসীদের নির্মূলে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে রাজনৈতিক শেল্টার। তাই সুযোগ বুঝে কিশোর সন্ত্রাসীরা অস্ত্রবাজিতে মেতে উঠছে। মাদকের মত মরননেশা সেবনসহ ক্রয় বিক্রয় এখনও থেমে নেই। দফায় দফায় র্যাবের অভিযানে আটক এবং ক্রস ফায়ারে নিহত হলেও যেন থমছে না তাদের মিশন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও উর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে বর্তমানের হটকেক কিশোর সন্ত্রাসীদের মাঝে বামপন্থী মতাদর্শ খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তার এদের মূলমন্ত্র। পাশাপাশি মাদক সেবন ও বিক্রি তাদের অর্থ যোগানের অন্যতম মাধ্যম। এরা ভাড়াটিয়া কিলারও বটে। গত ১৬ জুলাই দুদকের আইনজীবী লুৎফুল কবীর হত্যার লাশ উদ্ধার হলে খুলনার বিভিন্ন মহলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আগস্ট মাসে চার দিনের ব্যবধানে বটিয়াঘাটার কাজিবাচা নদী থেকে ২ লাশ উদ্ধার হয়। গত ৩ অক্টোবর দিন দুপুরে লবণচরা থানার নিজখামার এলাকায় সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেল যোগে সাকিল (৩৮) নামে এক যুবককে গুলি করে আহত করে। ঠিকতার পরের দিন ৫ অক্টোবর রাত আটটার দিকে সোনাডাঙ্গা থানার গোবরচাকা এলাকায় ইমন শেখ (২২) নামে এক রং মিস্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ জানায়, এসব অস্ত্রের ঝনঝনানির পিছনে রয়েছে মাদক ব্যবসা এবং পূর্ব শত্রুতার জের।
একই ভাবে ২০১৮ সালে খুলনা জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মিঠু হত্যাকান্ডে চরমপন্থী কিশোর সন্ত্রাসীরাই অংশ নেয়। খুলনায় একাধিক যুবলীগ নেতা ও রায়েরমহল মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হত্যাকান্ডে কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছিল কিশোর সন্ত্রাসীরা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাহিদ হোসেন মোল্যাকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ জানায় এ হত্যাকান্ডেও কিশোর সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। ২০১৮ সালে জেলার বটিয়াঘাটায় দাউনিয়াফাদ গ্রাম থেকে মাথা বিহিন পুরুষের লাশ, আন্ধারিয়া বিলে মাছের ঘেরে যুবতীর মরদেহ উদ্ধার, কিসমত ফুলতলা গ্রামে দিনদুপুরে দু’দফায় ২১ লাখ টাকা ছিনতাই, স্কুল ছাত্রী ধর্ষণসহ সুরখালী গ্রামে বলরামের মৃত্যু এবং তেতুলতলা গ্রামে মিঠু মন্ডলের রহস্যজনক আত্মহত্যা, এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে।
সূত্রমতে, খুলনা জেলায় চরমপন্থী এবং অস্ত্রধারীর সংখ্যা প্রায় ৩ শতাধিক। আর বৃহত্তর খুলনায় এর সংখ্যা প্রায় ৫ শতাধিক । চরমপন্থী বলে স্বীকৃত উল্লেখযোগ্য সংগঠনগুলো হচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল), নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মৃণাল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ) ও কৃষক সংগ্রাম পরিষদ। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রমতে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ) বুরুজ মোল্লা, তৌহিদ শেখ, তারিকুল ইসলাম বারকী মোড়ল, জামাল হোসেন, জহির শিকদার, নজরুল ইসলাম, রাজু মোল্লা, মুরাদ শেখ অশিক্ষিত এবং সাইফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন তৃতীয় শ্রেনী, কাজল অষ্টম শ্রেণী পাশ বলে দাবি করেছে। ৯৯ সালে আত্মসমর্পণ শেষে আনসারের চাকরি নিয়ে পালিয়ে যাওয়া লালন শেখ, মুসা মোল্লা, শাহাবুদ্দিন, মুজাম গাজী, অধিকাংশের অক্ষর জ্ঞান নেই। নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিহত শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে পুলিশের কোন রেকর্ড নেই। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ)’র সাবেক প্রধান হারুন শেখ অশিক্ষিত বলে পুলিশের নথিভূক্ত হয়েছে। র্যাব পুলিশের অভিযানে সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দিয়ে আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা র্যাবের হুঁশিয়ারি উচ্চারনের কারনে অনেক রাজনৈতিক নেতা সন্ত্রাসীদের শেল্টার দিতে সাহস পাচ্ছে না। অপরদিকে, গডফাদাররা চুপসে গেছে। টেন্ডারবাজিতে ইতোপূর্বে চরমপন্থী ও অস্ত্রধারীদের অংশগ্রহন ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি হলেও সেখানে প্যাটার্নটি পাল্টিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক টেন্ডারবাজি গুলোতে ছাত্র যুবসংগঠনের উঠতি নব্য ক্যাডারদের শোডাউন পরিলক্ষিত হয়। তবে সুযোগ পেলেই চরমপন্থীরা এসব সেক্টরে আগের মত মাথাচাড়া দিতে পারে বলে আশংকা সুধিজনের। বিভিন্ন সময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-জনযুদ্ধ) কমরেড মাও-সে-তুঙের ছবি সম্বলিত নানা লিফলেট প্রকাশ করে। অপরদিকে ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে র্যাব-পুলিশের সাথে চরমপন্থীদের বন্দুক যুদ্ধে একাধিক জলদস্যু, সন্ত্রাসী ও অবৈধ অস্ত্রধারী, মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়।