
মুজুরী কম, শ্রম দেয় বেশী, আইনের প্রয়োগ নেই
শেখ আব্দুল হামিদ : বৃহত্তর খুলনায় সম্প্রতি শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। নগরীর মোড়ে-মোড়ে, দোকানে, পরিবহনের গেটে, স্বর্ণের গহনা তৈরীর কারখানা, হোটেল, লেদ মেশিন কারখানা, ইটভাটা, ভ্যান, ইজিবাইকসহ সর্ব ক্ষেত্রেই শিশু শ্রমিকদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। হালকা-ভারী, কম ঝুঁকিপূর্ণ, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সব ধরণের কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে শিশু শ্রম। নগরীর সন্ধ্যা বাজার, গল্লামারী কাঁচা বাজারসহ বিভিন্ন পাইকারী বাজারের মাল বোঝাই ভ্যান-ঠেলা গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে ছোট্র কাঁধে ভারী ভারী চাল ডালের বস্তা বোঝাইয়ের কাজ করছে শিশু কিশোররা। একদল সুযোগ সন্ধানী দোকান মালিক কম দামে শিশু শ্রম পাওয়া যায় বলে এদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করছে কষ্টসাধ্য কাজে। আইন থাকলেও কার্যকর না থাকায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
খুলনা লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনাল, ট্রাক টার্মিনাল, রূপসা নদীতে খেয়া মাঝি, ট্রেন স্টেশনসহ সর্বত্রই মালামাল পরিবহনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক থাকে শিশু কিশোর। এদের কেউ বস্তায় করে ভারী মাল পরিবহন করছে, কেউবা ট্রাকে দাঁড়িয়ে অন্যের মাথায় বস্তা তুলে দেয়ার কাজ করছে। আবার কেউ সরাসরি বস্তা মাথায় করে মালামাল দোকানে নিয়ে যাচ্ছে। দোকানের মালিককে শিশু শ্রমিক নিয়োগের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি উল্টে যুক্তি দেখান মানবতার। বলেন, এরা অতিব গরিব ঘরের এতিম সন্তান। কাজের বিনিময়ে যে সামান্য পয়সা পায় তা দিয়েই এদের সংসার চলে। এখন যদি এদের কাজ না দেয়া হয় তাহলে এরা না খেয়েই থাকবে। মারাও যেতে পারে। তাছাড়া এরা কাজের জন্য প্রতিদিন যে ভাবে ধর্না দেয় ফিরিয়েও দিতে পারি না। এসব যুক্তিকে নিজেদের সুবিধাবাদিতা মনোভাবকে কুটকৌশলে আড়াল করার চেষ্টা বলে মনে করেন খুলনা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য ভুক্ত একাধিক শ্রমিক। একজন শ্রমিক তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, এ নগরীতে অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন, যারা নানা কৌশলে শিশু শ্রমিকদের ব্যবহার করেন। কারণ একজন পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিককে দিনের শেষে যে মুজুরি দেয়া লাগে, একজন শিশু শ্রমিককে সেক্ষেত্রে দিতে হয় অর্ধেকেরও কম। শিশু শ্রম হলো সস্তা, তাই টাকা বাঁচানোর জন্য অনেক সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা শিশু শ্রমকে আস্কারা দিচ্ছে।
অন্যদিকে খুলনা শ্রমিক কল্যাণ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বলছেন, ইউনিয়নে ১৮ বছরের কম বয়সী কোন শ্রমিক নিবন্ধনের আওতায় আসে না। শিশু শ্রমিক এখানে আসলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। নগরীর প্রায় সবখানেই এখন শিশু শ্রমিকদের যথেচ্ছা ব্যবহার করছে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী মহল। যে বয়সে শিশু-কিশোরদের বই হাতে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, সে বয়সে তারা সারা গায়ে কালি মেখে, জীর্ণ শীর্ণ বস্ত্রে শুধুমাত্র দুমুঠো ভাতের আশায় কলকারখানায় কাজ করে চলেছে। নগরীর খানজাহান আলী রোডের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ওয়েল্ডিং কারখানায় সর্বদা মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। এখানে এক লেদ মেশিনের দোকানে কর্মরত ১০ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক জয়নাল মৃধা জানায়, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজের বিনিময়ে বেতন দেয় দৈনিক মাত্র ৩০০ টাকা। অথচ ওর চেয়ে অনেক কম সময় কাজ করে পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিককে দেয়া হয় ছয়শ’ থেকে সাতশ’ টাকা বা ততোধিক। স্বর্ণের গহনা তৈরীর কারখানায় বিষাক্ত গ্রাসের মধ্যে বসে তাদেরকে কাজ করতে হয়। খুলনা হেলাতলা এলাকায় বেশ কয়টি স্বর্ণের দোকানের কারখানায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিশু শ্রমিকরা কাজ করে থাকে। মালিকরা সামান্য বেতন ধরিয়ে দিয়ে কাজ করায়। শিশুদের বুঝানো হয় কাজ শিখে তুমি বড় হয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হতে পারবে।
এ সম্পর্কে কারখানা মালিকদের অনেকেই বলেন, শিশু শ্রমিককে সকালে নাস্তা এবং দুপুরে ভাতও দেয়া হয়। শিশু শ্রম নিয়ে খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির সভাপতি আবু হেনা মুক্তি বলেন, শিশু শ্রম সমাজে যেন একটা ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক শ্রেণির অসাধু মালিক তাদের স্বার্থে এবং মুজুরী কম দেয়ার মানসিকতায় শিশু শ্রমিক কাজে নেয়। আবার কারণে অকারণে দুর্ব্যবহার করে এমনকি কৌসলে হত্যাও করে থাকে। আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে এ ব্যাপারে জোরালো কোন পদক্ষেপও নেয়া যায় না।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, শিশু শ্রম আইনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। বিভিন্ন মালিকরা তাদের স্বার্থে শিশুদের ব্যবহার করে থাকেন। নাম মাত্র মুজুরী দিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করিয়ে নেয়। এদিকে সরকারের গুরুত্ব দেয়া খুবই প্রয়োজন।