শেখ আব্দুল হামিদ : যে সন্তান আজ অতি আদরে বাবা মায়ের কোল আলো করে পৃথিবীতে আসছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই শিশু নিশ্বাসের সাথে গ্রহণ করছে সিসা নামের মারাত্মক বিষ। যা একটি বিষাক্ত পদার্থ। খাবার, পানীয় ও শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করছে সিসা। এই বিষাক্ত পদার্থ শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যকৃৎ, কিডনি, হাড়সহ সবকিছুর ক্ষতি করে থাকে। দেহের কোমল পেশিতন্ত্রগুলোও সিসায় আক্রান্ত হয়।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই উচ্চ ক্ষতিকারক সিসার উপস্থিতি মিসে রয়েছে খুলনার শিশুদের রক্তে। এখানকার দুই থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের প্রায় শতভাগের শরীরেই সিসার উপস্থিতি ধরা পড়েছে। আন্তর্জাতিক শিশু সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনা, সিলেট, টাঙ্গাইল, ও পটুয়াখালী এই চার জেলার শিশুদের ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ঢাকা বাদে বাকি চার জেলা থেকে ৯৮০ শিশুকে গবেষণার আওতায় আনা হয়। এসব শিশুর প্রত্যেকের রক্তে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের শরীরে সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশী পড়ে। গর্ভবতী মায়েরাও সিসা দূষণের শিকার হয়। তাই বিকালঙ্গ শিশুরও জন্ম হতে পারে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. একেএম মনিরুজ্জামান বলেন, সিসার প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। প্রতিটি গ্লান্ড প্রায় নষ্ট করে দেয়, মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে এবং লেখাপড়ায়ও তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার আশঙ্কাও অনেক বেশি।
সম্প্রতি বটিয়াঘাটা উপজেলার মোহাম্মদনগর এলাকায় ২৪৭ জন শিশুর রক্ত পরীক্ষা করায় সকলের দেহে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। বটিয়াঘাটা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.মিজানুর রহমান বলেন, সিসার দূষণ প্রতিরোধে করনীয় শীর্ষক প্রশিক্ষণ চলছে। মাসব্যাপী প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ প্রশিক্ষণ সভার উদ্বোধন করেন।
খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ বলেন, সিসা একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক পদার্থ। যা বাতাসের সাথে মিশে মানবদেহে প্রবেশ করে। শিশুরাই বেশী সিসার দ্বারা ক্ষতির শিকার হয়। খুলনায় সিসার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশী। মিলকলকারখানার ধোয়ার সাথেও বাতাসে সিসা মিশতে পারে। ব্যাটারী তৈরীতে সিসার ব্যবহার হয়। আবার ব্যাটারী জ¦াল দিয়ে সিসা বের করা হয়। এসব কারণে সিসা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সবিজুর রহমান দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, সিসা মারাত্মক ক্ষতিকারক পদার্থ। এর প্রভাবে পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা হতে পারে। তিনি বলেন, সিসা একটি নিউরোটক্সিন যা শিশুদের মস্তিস্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধবংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মস্তিস্কের পুরোপুরিভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই ক্ষতিসাধন করে। এর পরে শিশুদের সারাজীবনের জন্য স্নায়বিক , মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে ফেলতে পারে। মারাত্মক সিসা দূষণ অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত সীসায় দূষিত হচ্ছে রাস্তার পাশের এবং রেষ্টুরেন্টের সব খাবার, খোলা বাজারের চাল, ডাল, মশলা, কাঁচা সবজি, মাছ, মাংস, আঁশ ছাড়া মাছ, গুঁড়ো মশলা, বিস্কুট সবটাই। ধুলা, মাটি, পানি, জলাশয়ে ব্যাটারি শিল্পের সীসা মিশছে। শুধু বাইরের খাবার নয়, ঘরের খাবারেও সীসা ঢুকে যাচ্ছে বিভিন্নভাবে। শিশুরা যেসব প্লাস্টিক খেলনা নিয়ে খেলা করে তাতে যে রং ব্যবহার হয় সেখানেও সিসা মিশে আছে। তিনি বলেন, একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, খুলনা জেলায় সিসা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত