
কয়েকটিতে অপচিকিৎসার অভিযোগ
জন্মভূমি রিপোর্ট : চলতি অর্থবছর শেষ হতে চললেও মহানগরী খুলনার বিভিন্ন প্রান্তের ১শ’২৫ টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ এখনও লাইসেন্স নবায়ন করেননি। এদের মধ্যে কোনোটি সাত, কোনো-কোনোটি ৫, ৪ ও তিন এবং কোনো-কোনোটির দুই অর্থবছরেও নবায়ন কাজ সম্পন্ন হয়নি। এতে সরকার লাখ-লাখ টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্প্রতি কয়েকটি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসায় মৃত্যু এবং রোগীর সাথে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।
খুলনা সিটিতে লাইসেন্সধারী ২শ’ ৫০ টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে ১শ’ ৪১ টি ডায়গনস্টিক সেন্টার। বাকী ১শ’ ৯ টি ক্লিনিক। কয়েকটি ক্লিনিকে রোগ-পরীক্ষা নিরিক্ষার কাজও চলে। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, গত সাত অর্থবছর একটি, ৫ অর্থবছর দুইটি, চার অর্থবছর ১০ টি, তিন অর্থবছর ১৩ টি, দুই অর্থবছর ৯ টি এবং বাকীগুলোর চলতি অর্থবছরের নবায়ন কাজ সম্পন্ন হয়নি।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ মোঃ মঞ্জুরুল মুর্শিদ দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, লাইসেন্স নবায়ন না করা ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের কোনো-কোনোটির মালিককে লিখিতভাবে নোটিশ করা হয়েছে। অন্যদের মোখিকভাবে নবায়ন কাজ সম্মন্নের জন্য বলা হয়েছে। ইন্সপেকশন চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লাইসেন্স নবায়ন না করা ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, প্রতিবছর জুন-জুলাই মাস থেকে নবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। পরববর্তী অর্থবছর জুন-জুলাই পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলে। ১০ বেড থেকে ৫০ বেডের ক্লিনিক গুলোর লাইসেন্সের সময় ৫০ হাজার টাকা এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এরপর প্রতি অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নবায়ন করতে হয়। ডায়াগনেস্টিক সেন্টারগুলোর অনুমোদনের সময় ২৫ হাজার টাকা এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। পরবর্তীতে প্রতি অছর্থবছরে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। পাঁচটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে কয়েক দফায় চিঠি দেয়া স্বত্তেও তারা লাইসেন্স গ্রহণ করছেন না।
সূত্রমতে, নগরীর বাবুখান রোডস্থ মনোয়ারা ডায়াগনস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ গত ২০১৪-১৫ সালের পর আর লাইসেন্স নবায়ন করেননি। শামসুর রহমান রোডস্থ রংধনু ক্লিনিকটির লাইসেন্স গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর আর নবায়ন হয়নি। একই অবস্থা রংধনু ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিরও। কেডিএ এভিনিউ এলাকায় গরীব নেওয়াজ ক্লিনিক ডায়াগনস্টেক লিঃ নামে দুইটি অনুমোদন রয়েছে। ক্লিনিকটির লাইসেন্স নাম্বার ২৪১ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নাম্বার ৪৬৮৫। এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের গত চার অর্থবছর ধরে লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। এমনিভাবে নবায়ন না হওয়া ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলো তাদের বাণিজ্যিক সেবা চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, যেসব চিকিৎসক পছন্দের ডায়গনস্টেক সেন্টারে রোগ পরীক্ষার জন্য রোগী পাঠান তারা ৫০ শতাংশ অথবা কথনও-কখনও তারও বেশি কমিশন পেয়ে থাকেন। পছন্দের ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরিক্ষা না করালে রোগী অথবা তাদের স্বজনরা কখনও-কখনও চিকিৎসকের তীর্যক মন্তব্যের স্বীকার হন।
সূত্র জানান, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগ পরীক্ষা করালে যে খরচ বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারে তা দ্বিগুন। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে রোগীদের আরও কয়েকগুন বেশি টাকা গুণতে হয়। নিম্ন আয়ের মানুষেরা ডায়গনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিকের ব্যয় বহন করতে যেয়ে কখনও-কখনও সহায় সম্বল বিক্রি করেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক কর্তৃপক্ষ দালাল নিযুক্ত করেছেন।
রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের মিলকি দেয়াড়া গ্রামের ভ্যান চালক মোঃ মোশারেফের অন্তস্বত্তা স্ত্রী সাজেদা বেগম (২৯) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকার আল সেবা ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে গত ১০ মে দুপুরে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পরদিন ১১ মে সকালে ক্লিনিকের লোকেরা রোগীর স্বামীকে বলেন- একজন ভালো ডাক্তার এসেছেন তাকে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা দিতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে ২৭শ’ টাকা দিয়ে তিনটি ইনজেকশন আনতে হবে। তার একটি ইনজেকশন পুশ করার পর ওই ক্লিনিকের লোকেরা এসে বলেন, নবজাতকের মায়ের প্রেসার একেবারে লো হয়ে গেছে, আপ করা যাচ্ছে না। তাকে অন্য কোনো চিকিৎসালয়ে নিতে হবে। তখন ভিকটিমের স্বজনেরা তাকে প্রথমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার আইসিইউতে ভোর রাত চার টার দিকে তার মৃত্যু হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা বলেন-ওই নারীর হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। নিহতের স্বামী দৈনিক জন্মভূমিকে এসব তথ্য জানান। এই অকাল মৃত্যুর জন্য তিনি ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে দায়ি করেছেন।
দাকোপ উপজেলার উত্তর বানিশান্তা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য রামমোহন মিস্ত্রির স্ত্রী শিবানী বিশ^াস (২২) কে সিজার করানোর উদ্দেশ্যে গত ২২ মার্চ নগরীর ময়লা পোতা মোড় এলাকায় বেস্ট কেয়ার ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোনো পরীক্ষা-নিরিক্ষা ছাড়াই ওই গর্ভবতীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তার স্বামী অভিযোগ করেন। যদিও এ ব্যাপারে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
রামমোহন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে ডাঃ সানজিদা হুদা সুইটি ওটিতে প্রবেশ করেন। সিজারের পর রাত ৮ টার দিকে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তখন ডাক্তার বলেন, প্রসুতির রক্তের প্রয়োজন দ্রুত যোগাড় করেন। ভিকটিমের স্বামীসহ স্বজনরা রক্ত যোগাড় করে এসে দেখেন- ডাক্তার চলে গেছেন। তখন ক্লিনিকের লোকেরা শিবানীকে দ্রুত এ্যামব্যুলেন্সে করে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে ভর্তি করেন। পরদিন সকালে ওই নারীর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। এই মৃত্যুর জন্য রামমোহন সংশ্লিষ্ট গাইনি ডাক্তারকে দায়ি করেছেন।
রূপসা উপজেলার শোলপুর গ্রামের খান মেহেদী হাসান (৪০) গত ১১ মার্চ পায়ে সামান্য ক্ষত নিয়ে টুটপাড়া মোড় এলাকার স্টার ক্লিনিকে যান। তখন ক্লিনিকের মালিক জনৈক ফেরদাউস হোসেন নিজেই রোগীর মিনি অপারেশন করে সেখানে ভর্তি করে নেন। এরপর ১৬ দিন ধরে ওষুধ এবং ড্রেসিং বাবদ মেহেদীর কাছ থেকে প্রতারণা করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরে আরেকটি ক্লিনিকে যেয়ে অপারেশন করান। এখনও তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ভিকটিম এসব তথ্য জানান।
পেটে ব্যথা জনিত কারণে দৈনিক জন্মভূমির স্টাফ রিপোর্টার মামুন খানের স্ত্রী শায়লা শারমিন (৩০) কে গত ১৩ মার্চ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডাঃ সানজিদা হুদা সুইটির প্রাইভেট প্রাকটিসের স্থান গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে নেয়া হয়। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার রিপোর্ট দেখে রোগীকে ওভারিয়ান সিস্টে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করেন। ১৪ মার্চ রোগীর পেটে ভীষন ব্যাথা শুরু হলে তাকে গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডা: সুইটি তাকে অপারেশনের আগের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র দেন এবং ১৫ মার্চ দুপুর দেড়টায় অপারেশনের সময় নির্ধারণ করেন। দুপুর একটার পর ওয়ার্ড বয় এবং একজন আয়া শায়লাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। এরপর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডাঃ দিলিপ কুমার কুন্ডু তাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেন। দুপুর দু’টা ১২-১৩ মিনিটের দিকে ডাঃ সুইটি ওটিতে প্রবেশ করেন এবং বেরিয়ে বলেন, রোগীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়েছে। পরে সেটা রিকভারি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন এবং তাকে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন শেষে আইসিইউতে রেখে চলে যান। সেখানে আট দিন এবং পরবর্তীতে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশাষায়িত হাসপাতালে তিন দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শায়লা মৃত্যুবরণ করেন।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, ভুল চিকিৎসায় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের কাছ থেকে অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে তদন্ত করে দোষিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।