খুলনায় আমন ধানের উৎপাদন বয়সে কোথাও শৈশব, কোথাও কৈশোর আবার কোথাও যৌবন কাল চলছে। কয়েকটি উপজেলায় দেরিতে রোপন কাজ হওয়ায় এবং জাতভেদের কারণে বয়সের এ তারতম্য তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ক্ষেতে পোকার আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। চাষীরা বালাইনাশক প্রয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। কেউ-কেউ জমিতে ডাল পুতে পোকা খাওয়ার পাখি বসারও ব্যবস্থা করেছেন। যদিও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ বলছেন-প্রকৃতিতে পোকার উপস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা। পরিস্থিতি ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌছায় নি।
চলতি মৌসুমে খুলনার নয় উপজেলাসহ মেট্রো অঞ্চলের দু’ থানা এলাকায় ৯২ হাজার ৫শ’২০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। এরমধ্যে উফশি ৬৫ হাজার ৮শ’ ৩৫ হেক্টর জমিতে, স্থানীয় জাতের ১৯ হাজার ২শ’ ৪৫ হেক্টর জমিতে এবং হাইব্রিড ১৭শ’ হেক্টর জমিতে চাষ হওয়ার টার্গেট ছিল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩শ’ ২০ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। আগাম বৃষ্টিপাত এবং ধানের লাভজনক বাজার দর থাকায় টার্গেটের তুলনায় অধিক জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, খুলনায় সবচে বেশি আমন চাষ হয় দাকোপ উপজেলায়। সবচে কম আবাদ হয়-তেরখাদায়। পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় অন্য উপজেলাসমূহের তুলনায় কিছুটা দেরিতে আমনের চাষ হয়। সেখানকার চাষীরা স্থানীয় জাতের ও বিআর-২৩ জাতের ধান বেশি আবাদ করেন।
দাকোপ উপজেলার পানখালি ইউনিয়নের খাটাইল গ্রামের কৃষক অজয় তরফদার (৩৮) স্থানীয় বিলে ৩২ বিঘে জমিতে আমন চাষ করেছেন। তিনি বলেন, রোপনের পর চারার বয়স প্রায় এক মাস। সপ্তাহখানেক আগে ধান ক্ষেতে লেদা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। আরেক প্রজাতির পোকা গাছের পাতার রস খেয়ে ফেলছে।
এতে পাতার রং ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। ওই পোকার নাম জানা নেই। বৃষ্টির কারণে জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। পোকা দমন করা না গেলে ফসলহানির শঙ্কা রযেছে।
অজয় বলেন, খাটাইল বিলে ৫শ’র বেশি কৃষক আমন চাষ করেছেন। অনেকের জমিতেই পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। মাঠ পর্যাযের কৃষি কর্মকর্তারা খোঁজ নিতে আসেন না। যে কারণে পোকার আক্রমণ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে না।
রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের যুগিহাটী গ্রামের ইব্রাহিম মল্লিক (২৪) পুটিমারী বিলে দেড় বিঘে জমিতে বিরি-৮৭ জাতের আমনের আবাদ করেছেন। ২০-২৫ দিন আগে তার জমির আগাছা পরিষ্কার ও শেষ ধাপের সার প্রয়োগের কাজ শেষ করেছেন। আগামী ১২-১৫ দিনের মধ্যে ক্ষেতে কাঁচ থোড় বেরাবে। তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে মাজরা পোকার উপদ্রব দেখা দেয়। কীটনাশক প্রয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হযেছে। তিনি বলেন, ওই বিলের অনেক কৃষকের ক্ষেতেই কারেন্ট পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার উপস্থিতি দেখা দিয়েছে। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে চাষিরা বালাইনাশক প্রয়োগ করছেন।
সরেজমিন ওই বিল এলাকা পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, কোনো-কোনো জমিতে ধান গাছে থোড় বেরিয়েছে। কোথাও-কোথাও থোড় বের হওয়ার অবস্থায় রয়েছে। অনেকের জমিতে পাখি বসার জন্য ডাল পোতা রয়েছে। সেখানে ফিঙ্গেরাজা বসছে। শিকারী ওই পাখি পোকা ধরে খাচ্ছে। কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি প্রকৃতিক এ পদ্ধতিতে পোকা নিধন করছেন।
রূপসা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ফরিদুজ্জামান বলেন, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ৩ হাজার ৯শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে আমান চাষ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে একশ’ হেক্টর বেশি। চাষীরা বিরি-৮৭, বিরি-৪৯, বিআর-১০ ও বিআর-২২ জাতের ধানের আবাদ বেশি করেছেন। বেশিরভাগ জমির ফসল থোড় অবস্থায় ও গর্ভাবস্থায় আছে। হাইব্রিড জাতে ধানের শিষ বেরিয়ে গেছে। যা এক-দেড় মাসের মধ্যে কাটা শুরু হবে। পোকার আক্রমণ দমনে আগাম ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে। আলোক ফাঁদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পোকার উপস্থিতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় বালাইনাশক প্রয়োগ ও প্রাকৃতিক উপায়ে পোকা-মাকড় নিধনের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সচেতনতামূলক লিফলেটও বিতরণ করা হচ্ছে।
পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের দারুন মল্লিক গ্রামের অনিল সরকার (৫৫) অপরের সাত বিঘে জমি বর্গা নিয়ে আমন চাষ করেছেন। আবাদ খরচ যোগাতে তাকে দু’টি এনজিও থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষেতে চারা রোপনের পর বয়স এখন প্রায় এক মাস। কিছুদিন আগে ফসলের ক্ষেতে লেদা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। তিনি কীটনাশক প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ওই বিলে উপজেলার দারুন মল্লিক, নোয়াই, হরিণখোলা ও দেলুটি গ্রামের কয়েকশ’ কৃষক চাষাবাদ করেন। অনেকের জমিতেই বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কারেন্ট পোকা ধান গাছের গোড়ায় অবস্থান নিয়ে রস খেয়ে ফেলে। ওই পোকার আক্রমণের শিকার হওয়া ক্ষেতের গাছ বেঁচে থাকলেও ধান চিটে হয়ে যায়। মাজরা পোকার বাচ্চা গাছের কাÐের ভেতরকার নরম অংশ খেয়ে ফেলে। সেখানে অবস্থান নিয়ে বড় হয়ে পূর্ণাঙ্গ পোকা হয়ে বেরিয়ে যায়। পাতা মোড়ানো পোকা গাছের সবুজ অংশ (প্রোটিন) খেয়ে পেলে। ঘাষ ফড়িং ও চুঙ্গি পোকা গাছের পাতার রস খেয়ে ফেলে।
কীটনাশক বিক্রেতাদের মধ্যকার সূত্র জানান, গত কিছুদিন ধরে প্লেনাম, সপসিন, মিপসিনসহ ইমিডা ক্লোরোফিড গ্রæপের বালাইনাশকের বিক্রি বেড়েছে। গত আমন মৌসুমের তুলনায় এবার অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে কীটনাশক বিক্রি হচ্ছে।
খুলানা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, দু’-এক জায়গায় পোকার উপস্থিতি দেখা দিলেও পরিস্থিতি এখনও ক্ষতির পর্যায়ে যায় নি। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি মৌসুমে আমনের বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।