মামুন খান
নগরবাসীকে মানববর্জ্যরে দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে ছয় বছর আগে গড়ে ওঠা পয়ঃ বর্জ্য শোধনাগার থেকে জ্বালানি তৈরির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তুষকাঠ সাদৃশ্য ওই জ্বালানির নাম দিয়েছেন-চিফ ব্রিকেট। খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) কর্র্তৃপক্ষ গত ১৫ মে এ ব্যাপারে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বদ্ধ হয়েছেন। আগামী দু’-এক মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদিত জ্বালানি বাজারজাত শুরু করতে যাচ্ছেন।
যদিও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছেন, মানুষের মল দিয়ে তৈরি জ্বালানি ব্যবহারে অনেকের অনীহা রয়েছে। যে কারণে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। ভোক্তাদের মাঝে ওই জ্বালানি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রথমদিকে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রচারণামূলক বিভিন্ন কাজ করতে হবে।
সিটি কর্পোরেশনের কনজারভেন্সি শাখা ও মানববর্জ্য অপসারণ কাজে সহায়তাকরা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জানা গেছে, নগরীর ৩১ টি ওয়ার্ডে ৬৮ হাজার ২শ’ ৭৭ টি পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। জেলার নয় উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ শহরে আসা-যাওয়া করেন। প্রতিবছর ৭শ’ ১০ হাজার লিটার মানববর্জ্য তৈরি হচ্ছে। খুলনা সিটির ৭৮ হাজার হোল্ডিং, বেশ কিছু বস্তি এবং গণ শৌচাগারগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ হাজার লিটার বর্জ্য সংগ্রহ করে শোধনাগারটিতে পরিশোধন করা হচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসারে প্রতিবছর সেফটি ট্যাংকি পরিষ্কার করার নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ ট্যাংকি ভরে যাওয়ার পর কেসিসি’র কনজারভেন্সি শাখায় অবহিত করেন। এরপর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ওই বর্জ্য সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে, অবিবেচক মানুষেরা টয়লেট ট্যাংকির পাইপ বিভিন্ন ড্রেন ও খালে সংযুক্ত করে পরিবেশ দূষণ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন।
সূত্রমতে, খুলনা সিটি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে বটিয়াঘাটা উপজেলার রাজবাঁধ এলাকায় এক দশমিক ০৩ একর সম্পত্তির উপর ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নামের প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বিল এ্যান্ড মিরিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এবং কেসিসি’র তত্বাবধায়নে প্রকল্পটি চালু হয়। সহযোগিতা করে- এসএনভি নেদারল্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
শোধনাগারটির প্রবেশ দ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সবুজের সমারোহ। নানা প্রজাতির ফুল, ফলসহ দৃষ্টি নন্দন বৃক্ষ প্লান্টের শোভা বাড়িয়েছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করতে প্রায় দিনই ছাত্র-ছাত্রীসহ নানা শ্রেডু পেশার মানুষ ঘুরতে আসেন। খুলনা বিশ^বিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক শিক্ষার কাজে সেখানে আসেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরাও পরিদর্শনে আসেন। প্রধান ফটকের অদূরেই দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে একটি সতর্কতামূলক সাইন বোর্ডে সাটানো রয়েছে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা উপকরণ ব্যবহার, মানববর্জ্যরে সরাসরি সংস্পর্শ থেকে দূরত্বে থাকাসহ পাঁচ দফা নির্দেশনা পালনের কথা তাতে উল্লেখ রয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শন এবং শোধনাগারে কর্মরতদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কেসিসি’র প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল আজিজ বলেন, সাত হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি, পাঁচ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি এবং দুই হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি ভ্যাকুটাগ মানববর্জ্য অপসারণে ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার লিটার মানুষের বর্জ্য সংগ্রহ করে ওই প্লান্টে পরিশোধন করা হচ্ছে।
শোধনাগারটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। যেখানে কোনো রকম রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার ছাড়াই প্রতিদিন ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। সেখানকার ছয়টি প্লান্টেড ড্রাইবেড থেকে (ফ্রিক্যাল) মানববর্জ্য এবং তার তরল অংশ আলাদা হচ্ছে। তরল বর্জ্য পুণরায় পরিশোধন করার জন্য হরাইজেন্টাল প্লান্টেড গ্রাভেল ফিলটার ব্যবহার করা হয়। ওই বর্জ্য শেষ ধাপে পরিশোধনের জন্য পলিশিং পন্ডে নেয়া হয়। ওই পুকুরের পরিশোধিত পানি বর্জের বক্স পরিষ্কারে ব্যবহার হয়ে থাকে। শোধিত তরল বর্জ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান আছে কিনা? তা খুঁজতে কুয়েটের ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। পলিশিং পন্ডে অতিরিক্ত জল জমে গেলে অটোমেটিক ভাবেই পাশর্^বর্তী জয়খালী খালে নিষ্কাশন হচ্ছে, এরপর খালের পানির সাথে শোলমারি নদীতে চলে যাচ্ছে। পরিবেশ উপযোগী শতভাগ গুণগত মান নিশ্চিত হওয়ার পর পলিশিং পন্ডের পানি প্রকৃতির জলাধারে নিষ্কাশন হয় বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন।
এসএনভি’র টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম অফিসার শেখ শাকের আহমেদ বলেন, ফ্রিক্যাল বর্জ্য আন-প্লান্টেড ড্রাই বেডে চলে যাচ্ছে। সাদা প্লাস্টিকের সেডে তৈরি ওই ড্রাই বেডগুলো থেকে শুকনো বর্জ্য সংগ্রহ করে কর্মীরা পাশর্^বর্তী জ্বালানি তৈরির স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। কার্বোনাইজেশন ব্রিকেট প্রকল্প নামের ওই জ্বালানি তৈরির কারখানাটি ১০ কাঠা জমির উপর গড়ে উঠেছে।
সূত্রমতে, শুরুতে নগরীর পরিবেশ মানববর্জ্যরে দূষণমুক্ত রক্ষার লক্ষ্যে শোধনাগারটির যাত্রা শুরু হলেও ২০১৯ সালে কর্তৃপক্ষ পরিশোধিত সলিড বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখন জ্বালানি তৈরিতে আশানুরূপ সফলতা মেলেনি। ওই বছরের জুনে কেসিসি’র কনজারভেন্সি শাখার এবং কার্যক্রমে সহযোগিতাকারী প্রতিষ্ঠান এসএনভির সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত টিম প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের জন্য কেনিয়ার একটি মানববর্জ্য শোধনাগার পরিদর্শন করেন। সেখানে যেয়ে তারা দেখতে পান-২শ’ ৫০ থেকে ৩শ’ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পুড়িয়ে বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি হচ্ছে।
এসএনভি’র সিটি কো-অর্ডিনেটর মোঃ ইরফান আহমেদ খান বলেন, জ্বালানি তৈরির কাজ শুরুর জন্য গত মাসে কেসিসি’র সাথে চুক্তি বদ্ধ হওয়া গীতা ইঞ্জিনিয়ারিং নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি এখন বিভিন্ন যন্ত্রাংশ স্থাপনের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মানুষের মলে কার্বনের পরিমাণ কম থাকায় ৫০ শতাংশ পরিশোধিত বর্জ্যের সাথে ৫০% কাঠের গুড়া, তুষ এবং চিটেগুড়ের মিশ্রণে ওই জ্বালানি তৈরি হবে। প্রাথমিকভাবে প্রতিদিন ৭০ থেকে ১শ’ কেজি চিফ ব্রিকেট উৎপাদন হবে। পর্যায়ক্রমে এর পরিমাণ বাড়বে।
খুলনায় বাজারে আসছে মানববর্জ্য থেকে তৈরি জ্বালানি
Leave a comment