জন্মভূমি রিপোর্ট
খুলনায় হঠাৎ করে প্রতারক ও জালিয়াতি চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা পরিচয়ে বিকাশের মাধ্যমে গরীব শিক্ষার্থীর টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে র্যাব-৬, থানা-পুলিশ ও সিআইডি’র অভিযানে পৃথক দুইটি প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। একটি চক্র জাল সার্টিফিকেট ও এনআইডি তৈরিসহ ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে প্রতারণামূলক অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। অপর চক্রটি জ¦ীনের বাদশা, দরবেশ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে সহজ-সরল মানুষদের সর্বস্বান্ত করছিল।
গত ১৭ আগস্ট বিকেল ৫ টার দিকে ০১৬১০-৮৩৩৯৮৭ এবং ০১৮৬৫-১৫৫০৬৫ পৃথক দুইটি মোবাইল নাম্বার থেকে সৈয়দ আরশাদ আলী এ্যা- সবুরুন্নেছা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সুইটি আক্তার (১৮) কে ফোন করা হয়। মোবাইলের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি নিজেকে শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকার কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, আপনি সুইটি? সবুরুন্নেছা কলেজে পড়েন? আপনি তো করোনাকালে মোবাইল ফোন কেনার জন্য সরকারের কাছে অর্থনৈতিক সহযোগিতার আবেদন করেছিলেন, আপনার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। এর আগেওতো আপনি দুইবার উপবৃত্তির টাকা পেয়েছেন। আপনি মোবাইল কেনার জন্য ১২ হাজার দু’শ ৪০ টাকা পাবেন। তবে, টাকা নিতে হলে আপনাকে সমপরিমাণ টাকা নিজের বিকাশে ঢুকাতে হবে। একপর্যায়ে ওই ছাত্রীকে প্রতারক ছয়টি করে সংখ্যা বলে যোগফল জেনে বিকাশের গোপন পিন কোড হাতিয়ে নেয়। এরপর ওই ছাত্রী একটি বিকাশের এজেন্টের কাছে যেয়ে ১২,২৪০ টাকা লোড দেয়। এরপর এসএমএস আসলেও কিছুক্ষণ পরই ক্ষুদে বার্তাটি হারিয়ে যায়। তার বিকাশ এ্যাকাউণ্টে থাকা ৫শ’ টাকাও প্রতারক নিয়ে নেয়। ভুক্তভোগী শনিবার দুপুরে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, কোনো নগদ টাকা ছাড়াই বিকাশে লোড দিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর চরম বিপাকে পড়তে হয়েছিল। ভ্যানচালক পিতার পক্ষে অতগুলো টাকা একসাথে পরিশোধ করার সমর্থ ছিল না। স্থানীয় মসজিদের এক ইমামের মধ্যস্থতায় টাকা শোধ করার জন্য দু’ দিন সময় পাওয়া গেছে।
১৮ আগস্ট ভুক্তভোগীর পিতা মোঃ আবুল কালাম এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে যান। জনৈক পুলিশ সদস্য অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাবার ব্যাপারে তাকে নিরুৎসাহিত করেন। এরপর এক জনপ্রতিনিধির কথায় থানায় একটি জিডি হয়েছে। তবে, সেখানে ভুক্তভোগী হিসেবে ওই কলেজ ছাত্রীর কথা উল্লেখ না করে তার পিতার কথা লেখা হয়েছে। ভ্যানচালক কালাম বলছেন, সম্পূর্ণ ঘটনা বলার পরও পুলিশ জিডিতে তাকেই ভুক্তভোগী করেছেন।
রূপসা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে যে সাধারণ ডায়েরী লিখে আনা হয়, সেটাই নথিভুক্ত হয়। জিডির ব্যাপারে অনুসন্ধান সাপেক্ষ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে, জাতীয় পরিচয়পত্র, এইচএসএসসি’র সার্টিফিকেট জাল করাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরির মাধ্যমে প্রতারণা করে লাখ-লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রের দুই সদস্য গত ১৯ আগস্ট রাতে গ্রেফতার হয়েছে। নগরীর খালিশপুর থানাধীন গোয়ালখালী এলাকা হতে র্যাব-৬ এর একটি টিম তাদের গ্রেফতার করে। তারা হচ্ছে, মোঃ তরিকুল ইসলাম (৫২) এবং নাজমুল আলম (৩৬)। তাদের হেফাজত হতে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হওয়া দুইটি সিপিইউ ও দুইট হার্ডডিস্ক উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে সামরিক বাহিনীর ও একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ছয়টি ভুয়া নিযোগপত্র জব্দ করা হয়েছে। এর আগে গত ১৬ আগস্ট বৈকালী এলাকা হতে মোঃ আব্দুল হালিম, খান জাফর ইকবাল এবং এসকে নয়ন নামে চক্রটির তিন সদস্যকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। ওই তিন জনকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেছেন। এখনও রিমা- শুনানির জন্য দিন ধার্য হয় নি বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, নৌ বাহিনীতে চাকুরি দেয়ার আশ^াসে প্রতারক চক্রটি এক ব্যক্তির কাছে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। দু’ দফায় তারা এক লাখ ৩০ হাজার টাকা নেয়ার বিনিময়ে একটি ভুয়া নিয়োগপত্র হাতে তুলে দেয়। প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে ভুক্তভোগী তিন জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত চার-পাঁচ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক পিযুশ দাশ বলেন, চক্রের অন্য সদস্য কারা? এ পর্যন্ত কতজনকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে? পরিমাণ কত? তাদের হেফাজতে আর জাল কিংবা ভুয়া কাগজপত্র আছে কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে গ্রেফতার ও উদ্ধারের চেষ্টায় তিন আসামিকে রিমা-ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয়েছে। অন্য দু’জনকেও পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করার প্রস্তুতি চলছে।
অপরদিকে, গত ১৭ আগস্ট ভোর রাতে কয়রা উপজেলার নাকশা গ্রাম হতে মোঃ মফিজুল গাজী (৪৫) নামে একজন প্রতারকেকে পুলিশের আপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি’র একটি টিম গ্রেফতার করেছে। জ¦ীনের বাদশা, দরবেশ, মহিলা ইউপি মেম্বার, কোস্ট গার্ড কর্মকর্তা, বিকাশ অফিসারসহ নানা পরিচয়ে অসত্য ভয়-ভীতি দিয়ে তিনি এবং তার দলের সদস্যরা সহজ-সরল মানুষদের কাছ থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। গ্রামীন কয়েকজন নারী পারিবারিক সমস্যা সমাধানের আশায় চক্রের মূল হোতা দরবেশ খ্যাত মফিজুলের কাছে যান। তিনি তাদেরকে ফাঁদে ফেলে শারিরিকভাবে নির্যাতন করেছে। যদিও ভুক্তভোগীরা সংসার বাঁচানোর জন্য মুখ খোলেননি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানান, দিঘলিয়া উপজেলার একজন ব্যবসায়ীকে মামলা সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিপদ হতে উদ্ধার করার আশ^াসে চক্রটি তিন লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন।
মামলার (আইও) এস আই সাইফুল বলেন, এর আগে মাইনুল, মুকুল, আব্দুল্লাহ, বাকিরুল এবং বাকী নামে চক্রের আরও পাঁচ সদস্য গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা নগদ দুই লাখ টাকা, সাতটি মোবাইল ফোন ও ৫০/৬০ টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। চক্রের হোতা মফিজুল এবং তার সহযোগী আব্দুল্লাহ আদালতে অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। দুই জন নারীসহ প্রতারক চক্রটির আরও কয়েকজন সদস্য পলাতক আছে। তাদের গ্রেফতারসহ প্রতারণা করে অর্জন করা অর্থ-সম্পদ উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
খুলনায় বেড়েছে প্রতারক ও জালিয়াতি চক্রের তৎপরতা
Leave a comment