
২০১৮ সালে ছিল ১৯৭ : চলতি ৫ মাসে ৪২, মৃত্যু ১৫ জনের
শেখ আব্দুল হামিদ : খুলনা বিভাগে এইচআইভি/এইডস’র ভয়বহতা রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। দিনের পর দিন এ ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। খুলনা, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা রয়েছে সব চেয়ে বেশী ঝুঁকির মধ্যে। ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিভাগের ১২ জেলায় এইচআইভি/এইডস’র পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ছিল ১৯৭ জন। এদের মধ্যে পূরুষ রয়েছে ১০৬ জন। ২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারী পর্যন্ত নতুন করে আরো ১০ জনকে এইডস পজেটিভ সনাক্ত করা হয়। আর চলতি বছর গত পাঁচ মাসে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারে ৪২ জনের নমুনায় এইচআইভির জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছে খুলনা জেলায়। একই সময়ে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের।
সমুদ্র ও স্থল সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবেশকারীদের রক্ত পরীক্ষা না করা, নিষিদ্ধ পল্লী ও ভাসমান যৌন কর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, কনডম ব্যবহারে অনিহার করণে দিনের পর দিন এ পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টেনদেনিং অফ এইচআইভি সার্ভিসেস প্রকল্পের দেয়া তথ্যে এসব কথা উঠে আসে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম এবং ইউনিসেফ এর কারিগরী ও আর্থিক সহযোগিতায় এ সব রোগীদের সেবা দেয়া হচ্ছে। খু’মেক হাসপাতালে ওই প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোল্যা মো: নুরুল আসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, তাদের এ সেবার আওতায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস সনাক্ত করা হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৩ জন করে এইডস পজেটিভ ব্যক্তি সনাক্ত হচ্ছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬ হাজার ২৬৯ জন গর্ভবতী মায়েদের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন গর্ভবতী মা ও একজন শিশু পজেটিভ পাওয়া যায়। এ ছাড়া এ সময়ের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এআরটি সেন্টার থেকে ১ হাজার ৬১ ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করে ৩৯ জনের শরীরে এইচআইভি সনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে শিশু রয়েছে ৬ জন। এসময়ে শিশুসহ ৭ জন মারা যায়।
সূত্রমতে, খুলনাসহ ১২ জেলায় ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ১৯৪ জন এইচআইভি/এইডস পজেটিভ সংখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় ৬৫ জন, যশোর ৫১ জন, সাতক্ষীরায় ২৬ জন, নড়াইল ২৬ জন, বাগেরহাটে ৯ জন, গোপালগঞ্জে ৪ জন, পিরোজপুরে ৩ জন, ঝিনাইদহে ৫ জন, ফরিদপুরে ৩ জন এবং বরগুনা ও চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে ১ জন করে। এছাড়া ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারী পর্যন্ত আরও ১০ জনকে এইচআইভি/এইডস রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে যশোর ১ জন, খুলনায় ২ জন, নড়াইলে ৩ জন, বাগেরহাটে ২ জন ও সাতক্ষীরায় ২ জন রয়েছেন। এ সব রোগীর মধ্যে এইডস পজেটিভ গর্ভবর্তী এক মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এ তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, খুলনা বিভাগে এইডস ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
খুলনায় মুক্তি সেবা সংস্থা কেএমএসএস) এর আয়োজনে এক মতবিনিময় সভায় উল্লেখ করা হয়, সমুদ্র ও স্থল সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশকারীদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা না করা, নিষিদ্ধ পল্লী ও ভাসমান যৌন কর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় এবং ট্রাক চালকদের অবাদে নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত, পুরুষ সমকামী (এমএসএম) বৃদ্ধি, কনডম ব্যবহারে অনীহার কারণে এ অঞ্চলে এইডস’র প্রকোপ বেড়েই চলেছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা: রবিউল হাসান বলেন, সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান গুলোকেও এচিআইভি সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়া মানুষদের সনাক্তকরণ সওজ হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দিবেশ ওঝা জানান, ছয় মাসে তাদের এ সেন্টার থেকে ৪৬০ জনের রক্ত পরীক্ষা করে ৪২ জনের শরীরে এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া যায়। এর মধ্যে পুরুষ ২৭ ও ১৫ জন নারী রয়েছেন। একই সময়ে বিভিন্ন জেলা থেকে এ সেন্টারে এইচআইভি পজিটিভ ৪৩ জনকে রেফার করা হয়। সে হিসাবে এ বিভাগে ছয় মাসে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮৫ জন। এ পর্যন্ত এআরটি সেন্টারে আইডিভুক্ত এইডস রোগীর সংখ্যা ৫৭৫ জন। এর মধ্যে নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন ৪৪০ জন। শনাক্তের মধ্যে খুলনা জেলায় সর্বোচ্চ বেশি। এ জেলায় শনাক্ত হয় ১৯ জনের। এছাড়া বাগেরহাটে ১০ জন, যশোরে ছয়, নড়াইলে তিন এবং বরগুনা, গোপালগঞ্জ, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় একজন করে এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। এর মধ্যে যশোরে ছয়, খুলনায় তিন, নড়াইল ও সাতক্ষীরায় দুজন করে এবং বাগেরহাট ও মেহেরপুরে একজন করে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, ‘খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এআরটি সেন্টার থেকে বিনামূল্যে এইডস রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এইডস বিষয়ে জ্ঞান কম থাকার কারণে মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নয়।’ তিনি এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘একমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই এইডস প্রতিরোধ সম্ভব।’
উল্লেখ্য, গত ২০১৬ সালে খুলনা জেলায় নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে ২৩২ জন এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো। এ সময়ে মারা গেছে ৫১ জন। এ ছাড়া জীবীতদের মধ্যে ৮০ জন পুরুষ ৬৮ জন নারী, হিজড়া ৩ জন ও শিশু ছিল ৩০ জন। এদের মধ্যে মেয়ে শিশু ১১ জন ও পুরুষ শিশু ১৯ জন। ২০১৭ সালের ১৬ মে পর্যন্ত নতুন করে ১৭ জন এইডস রোগী সনাক্ত করা হয়। যার মধ্যে পুুরুষ ৬, নারী, ৬, শিশু ৩ ও হিজড়া ছিল ২ জন। তাদের মধ্যে ২ জন পুরুষ ও ১ জন মহিলা মারা যায়।