আওয়াল শেখ, খুলনা : স্বাস্থ্য শিক্ষার জন্য দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি খুলনা মেডিকেল কলেজ। তবে শিক্ষক সংকটে সেখানে শিক্ষাব্যবস্থার রুগ্ণ দশা এখন। ৩৩ বছরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার গুণ হলেও বাড়েনি শিক্ষকের পদ। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
এদিকে হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করতে না পেরে ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে ৫ বছরের এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি) কোর্স শেষ করতে অনেক শিক্ষার্থীর ৭ বছরও ব্যয় করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য শিক্ষার এমন জোড়াতালি পাঠদান দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শিক্ষক সংকট: খুলনা মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা যায়, ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্সে ৮টি মৌলিক ও ৩টি ক্লিনিক্যাল বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন করানো হয়। এর মধ্যে প্রথম দেড় বছরে মৌলিক বিষয় অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রির ওপর হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। পরবর্তী ২ বছর বাকি ৫টি মৌলিক বিষয় প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন ও ফার্মাকোলজির ওপর পড়ানো হয়। শেষ দেড় বছরে ক্লিনিক্যাল ৩টি বিষয় সার্জারি, মেডিসিন ও গাইনি অ্যান্ড অবসের ওপর ব্যবহারিক (প্র্যাকটিক্যাল) সহকারে অধ্যয়ন করানো হয়।
কলেজ প্রশাসন জানায়, ৮টি মৌলিক বিষয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক কলেজে নেই। এই বিষয়গুলোর জন্য শিক্ষকের মোট ৬৭টি পদ রয়েছে। তবে শিক্ষক আছেন ৫১ জন। যার মধ্যে এনাটমি বিভাগের একটি অধ্যাপক পদ, ফিজিওলজিতে একটি করে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক এবং বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে একটি বায়োকেমিস্টের পদ ফাঁকা রয়েছে। এ ছাড়া প্যাথলজি বিভাগে একটি প্রভাষক পদ, মাইক্রোবায়োলজিতে ২টি, কমিউনিটি মেডিসিনে একটি অধ্যাপক, ২টি করে সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক, ফরেনসিক মেডিসিনে একটি করে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং ফার্মাকোলজিতে একটি করে অধ্যাপক ও ফার্মাকোলজিস্টের পদ ফাঁকা রয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম বলেন, ‘১৯৯১ সালে যখন এই কলেজটি হয়েছিল, তখন প্রতি বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হতো ৫০ জন। ৫ বছরে ২৫০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হতো। সে সময়ে শিক্ষকদের যে অর্গানোগ্রাম ছিল, তা এখনো বহাল রয়েছে। যদিও এখন প্রতি বর্ষে ভর্তি করা হয় ১৮০ জন শিক্ষার্থী। আগামী বর্ষে আসন আরও ২০টি বাড়িয়ে ২০০টি করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে আমাদের ২৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতের শিক্ষক দিয়ে এক হাজার শিক্ষার্থী পড়াতে হবে। এ ছাড়া রয়েছে মৌলিক বিষয়ে চিকিৎসকের সংকট।’
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, শিক্ষক স্বল্পতার কারণে প্রায়ই তাদের ব্যবহারিক ক্লাস হয় না। হাতে-কলমে শিখতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস পরীক্ষাসহ প্রফেশনাল পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন।
কলেজের ফলাফল থেকে দেখা গেছে, ২০২২ সালের মে মাসে প্রথম বর্ষে প্রফেশনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১৮৭ জন। এর মধ্যে পাস করেছিলেন ১৪৮ জন। এ ছাড়া ২০২১ সালে প্রথম বর্ষে ১৬৯ জন অংশ নিয়ে পাস করে ১২৫ জন ও ২০২০ সালে ১৬২ জন অংশ নিয়ে পাস করে ১৩২ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘৫ বছরের কোর্সে প্রথম সাড়ে তিন বছর আমাদের মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানো হয়। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ও শিক্ষক সংকটে থাকায় বেশির ভাগ সময়ে আমাদের শুধু পড়া দেওয়া ও ক্লাস টেস্ট নেওয়া হয়। এনাটমি বা ফিজিওলজির মতো বিষয়গুলো হাতে-কলমে শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ খুবই কম থাকে।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করে এখন খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন সাইফুল্লাহ মানসুর। তিনি বলেন, ‘শিক্ষক সংকটের কারণে প্রফেশনাল পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে এ সংকট চলে আসছে। ছাত্রাবস্থায় ২০১১ সালে আমরা একবার এ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন করেছিলাম। তবে কোনো কিছুরই সমাধান হয়নি।’
আবাসন সংকট: কলেজের আবাসিক হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মোট ৪৬২ জন ছাত্রীর বিপরীতে আবাসিক সুবিধা পান ১৮৮ জন। অর্থাৎ, অর্ধেক ছাত্রীও এ সুবিধা পাচ্ছেন না। আর ৩৬০ জন ছাত্রের বিপরীতে আবাসিক সুবিধা পাচ্ছেন মাত্র ১৮০ জন।
বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ: এ পরিস্থিতিতে দেশে অদক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘বিষয়টা অত্যন্ত উদ্বেগের। এটা আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রতিটি স্তরে জানিয়েছি। তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভৌত অবকাঠামোও বাড়াতে হবে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে হঠাৎ করে বারবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এতে দেশে নিম্নমানের চিকিৎসকের জন্ম হচ্ছে এবং শিক্ষার মান ভালো থাকছে না। এতে পরে দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবে দুর্নাম ছড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা আর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসব না। আমরা এর পরে আন্দোলনে নামব।’
উত্তরণের উপায়: এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাইলে খুলনা মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. দীন-উল-ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক মাসে শিক্ষক সংকটের একটি তালিকা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাচ্ছি। এর মধ্যে আবার শিক্ষার্থীর আসনও বাড়ানো হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত নিয়ে নতুন করে অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হচ্ছে। ওটা চূড়ান্ত হলে নতুন করে শিক্ষক পদায়ন করা হবে। তখন আর শিক্ষক সংকট থাকবে না।’
আবাসন সংকটের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন দুটি আবাসিক হল অনুমোদন পেয়েছে। বর্তমানে মাটি পরীক্ষার কাজ চলছে। নতুন দুটি হল নির্মাণ হলে আবাসন সংকট কেটে যাবে।’
-১২ জানুয়ারি ২০২৪ ইং তারিখে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত।