জন্মভূমি রিপোর্ট
খুলনা-যশোর তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এক সময় ছিল চরমপন্থি বা নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলের অভয়ারণ্য। একের পর এক হত্যাকাÐের ফলে তছনছ হয়ে যায় গোটা জনপদ। সৃষ্টি হয় নানা চরমপন্থি সংগঠন। এ সময় জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি হত্যাকাÐের শিকার হয়। গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম জনপদ হয়ে ওঠে সন্ত্রাসের রাজত্ব। যা ৯০’ এর দশকের শুরু থেকে যাত্রা করে এবং ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভয়াবহ রূপ নেয়। এ সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (জনযুদ্ধ), বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, লাল পতাকা বাহিনী, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)সহ অসংখ্য চরমপন্থি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যারা পরস্পরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র খুন-খারাবীতে মেতে ওঠে। এসব চরমপন্থি সংগঠনের নেতারা পরে অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটিয়া খুনী হিসেবে ব্যবহার হয়। যাদের অধিকাংশই ইতোমধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের কিছু ব্যক্তি তাদের আধিপত্য ও প্রভাব ধরে রাখার জন্য নেপথ্যে থেকে এসব চরমপন্থি অস্ত্রধারী খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করত। গত এক যুগেরও বেশি সময় তাদের তৎপরতা না থাকলেও চলতি বছরে খুলনা-যশোরের কয়েকটি হত্যাকাÐ ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনসহ সাধারণ মানুষকে। যে হত্যাকাÐগুলোর ধরণ সেই পুরানো দিনের স্টাইলে সংঘটিত হয়েছে। বিশেষ করে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত ইউপি সদস্যকে কথিত নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডার কর্তৃক গুলি করে হত্যা, গত ১২ মে (বৃহস্পতিবার) খুলনা-যশোর সীমান্তে কপালিয়া ব্রিজে খুলনার ফুলতলার ব্যবসায়ী ও একাধিক মামলার আসামি রফিকুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা এবং গত ৭মার্চ সন্ধ্যায় নগরীর হামিদ নগর ¯øুইচ গেটে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হত্যা মামলার আসামি রাজু শেখকে গুলি করে হত্যাকাÐের ঘটনায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ বলেছে এসব হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িত অস্ত্রধারী ভাড়াটিয়া খুনী।
খুলনার একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনের নজরে এসেছে এবং পুলিশ বসে নেই। পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।
\ নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য উত্তম সরকার হত্যা \
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যশোরের অভয়নগরের সুন্দলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত সদস্য উত্তম সরকারকে কথিত ‘নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট’ পার্টির সদস্যরা হত্যা করেছে বলে পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে। চাঁদার টাকা না পেয়ে ১০ জানুয়ারি রাতে স্থানীয় হরিশঙ্করপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ প্রেস ব্রিফিং করে হত্যারহস্য ও গ্রেফতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে ওই সময়।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার রুদাঘরা গ্রামের ইসাহাক গোলদারের ছেলে ইকরামুল গোলদার, একই উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের মৃত বিষ্ণুপদ মÐলের ছেলে বিজন কুমার মÐল ওরফে বিনোদ, চুকনগর এলাকায় বসবাসকারী সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দক্ষিণ কদমতলা গ্রামের মৃত শিবপদ মÐলের ছেলে প্রশান্ত মÐল, যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী গ্রামের মৃত নিতাই বিশ্বাসের ছেলে প্রজিৎ বিশ্বাস ওরফে বুলেট ও মণিরামপুুরের সুজাতপুর গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে পল্লব বিশ্বাস।
তাদের কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, একটি এয়ারগান, তিন রাউন্ড গুলিসহ হত্যা মিশনে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
যশোর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি রুপন কুমার সরকার ওই সময় জানান, আসামিরা কথিত ‘নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট’ পার্টির সক্রিয় সদস্য। তারা দলীয় ছদ্মনাম ব্যবহার করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে হত্যাকাÐ ও চাঁদাবাজি করে চলেছে। এর আগে আত্মসমর্পণ করলেও পুনরায় তারা সংঘবদ্ধ হয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুরসহ আশপাশের জেলায় মাছের ঘের দখল, চাঁদাবাজি ও হত্যাকাÐ ঘটাচ্ছে। গত ১০ জানুয়ারি অভয়নগরের হরিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য উত্তম সরকারের কাছে চাঁদার টাকা না পেয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, হত্যার পর জড়িতরা বিভিন্নজনের কাছে চাঁদা চাওয়ার সময় উত্তম সরকারকে খুন করার রেফারেন্স টেনে মোবাইল ফোনে ভয়ভীতি দেখায়। ডিবি পুলিশ পরিদর্শক শেখ শাহিনুর রহমানের নেতৃত্বে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীম হোসেন ও এসআই মফিজুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি টিম খুলনা ও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে বিজন ও প্রশান্ত সরকারের আহŸানে এর আগে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
\ ব্যবসায়ী রকিবুল হত্যাকাÐ \
এ দিকে গত ১২ মার্চ স্ত্রীর সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান ফুলতলার ব্যবসায়ী নেতা ও একাধিক মামলার আসামি রকিবুল ইসলাম। এ সময় তার স্ত্রীও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।
রকিবুল খুলনার ফুলতলা উপজেলার আলকা গ্রামের মাহাবুব জমাদ্দারের ছেলে। তিনি ফুলতলা বাজার বণিক কল্যাণ সোসাইটির ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।
পুলিশ জানায়, রকিবুল ইসলাম ফুলতলা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। নওয়াপাড়া পৌরসভার কাউন্সিলর বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা মোল্যা ওলিয়ার রহমান হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে অভয়নগর ও ফুলতলা থানায় তিনটি হত্যা ও একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রকিবুল ইসলাম তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে মনিরামপুরের কপালিয়া গ্রামে বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে দত্তগাতী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে পৌঁছালে ওতপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি তার বুকের বাঁ পাশে ও মাথায় লাগে। তাকে ফুলতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেসে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে জানান।
রকিবুলের স্ত্রী বর্ষা বেগম বলেন, আমি ও আমার স্বামী মোটরসাইকেল করে দত্তগাতি এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কয়েকজন সন্ত্রাসী আমাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে স্বামীর মাথায় ও বুকে গুলি করে পালিয়ে যায়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দত্তগাতী দামুখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স¤প্রতি অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং আয়া পদে তিনজনকে নিয়োগ দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই নিয়োগে প্রায় ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। এ লেনদেনে রকিবুল ইসলাম ৯ লাখ টাকা দাবি করেন।
একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সৃষ্ট দ্ব›েদ্ব তাকে হত্যা করা হতে পারে।
সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ফুলতলা বাজার বণিক কল্যাণ সোসাইটির ক্রীড়া সম্পাদক খন্দকার রকিবুল ইসলাম হত্যাকাÐের ঘটনায় অভয়নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। রকিবুলের মাতা রহিমা বেগম গত শুক্রবার রাতে অজ্ঞাতনানা কয়েকজনকে আসামী করে থানায় এসে একটি হত্যা মামলা (নং- ১০, তারিখ- ১৩/০৫/২২ ইং) দায়ের করেন।
পুলিশ মামলার সাথে জড়িত দু’জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে।
অভয়নগর থানার ওসি (তদন্ত) মিলন কুমার মন্ডল জানান, নিহত থানা পুলিশ হত্যাকাÐের সাথে জড়িত দামুখালী গ্রামের মৃত মুকুন্দ বিহারী হালদারের পুত্র ইউপি সদস্য মিলন হালদার (৫২) ও দত্তগাতি গ্রামের মোঃ কাশেম মোল্যার পুত্র সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ সাইফুল আলম (৪০) কে গ্রেফতার করে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদনপূর্বক জেল হাজতে প্রেরণ করেছে।
\ রায়েরমহলে রাজু হত্যাকাÐ \
এর আগে গত ৭ মার্চ রাতে নগরীর রায়েরমহল হামিদনগর ¯øুইচ গেটে দুর্বৃত্তদের গুলিতে রাজু শেখ (৪০) নামের এক যুবক নিহত হন। নিহত রাজু শেখ ওরফে রাজা রায়েরমহল হামিদনগর ¯øুইচগেট এলাকার বাসিন্দা তোরাব শেখের ছেলে। সে সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হত্যা মামলার অন্যতম আসামি রাজু।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, নিহত রাজু শেখ একাধিক মামলার কারণে জেল খেটে কিছুদিন আগে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এরপর তিনি নগরীর খালিশপুর এলাকায় অবস্থান করতেন।
ওই সন্ধ্যায় হামিদনগর সেভ ড্রিংকিং ওয়াটারের কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় মোটরসাইকেলে দুইজন এসে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়।
গত প্রায় আড়াই মাস পেরোলেও নগরীতে জমি ব্যবসায়ী মোঃ রাজা শেখ (৪৫) ওরফে রাজু শেখ হত্যা মামলার কুল-কিনারা হয়নি। জড়িত দুই সন্দেহভাজন গ্রেফতার এবং তাদেরকে পৃথক মেয়াদে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে নতুন কেউ গ্রেফতার হয় নি। উদ্ধার হয়নি-হত্যাকাÐে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র।
পুলিশ জানায়, গত ৭ মার্চ রাত সাড়ে ৮ টার দিকে হরিনটানা সাহাল মার্কেটের সামনের সড়কে মোঃ রাজা শেখকে মোটর সাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। তার মরদেহের মাথায় একাধিক বুলেটের ক্ষত ছিল। তিনি মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হত্যা মামলার আসামি। খুন হওয়ার মাস তিনেক আগে তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন। তিনি জমি-জমার ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। নিহতের পিতা তোয়েব আলী অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে এ হত্যা মামলাটি দায়ের করেন।
সূত্রমতে, হত্যাকাÐে জড়িত সন্দেহে হরিনটানা থানা পুলিশের একটি টিম গত ১২ মার্চ রাতে মোঃ শওকত হোসেন বিটু (৪৯) নামে এক জনকে নোয়াখালির সেনবাগ এলাকা হতে গ্রেফতার করে। একই রাতে আরেক সন্দেহভাজন শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৫) নামে আরেকজনকে নগরীর হরিনটানা থানার আন্দিরঘাট এলাকা হতে গ্রেফতার করা হয়। আদালতের আদেশে বিটুকে দু’ দিন এবং মামুনকে এক দিন রিমাÐে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আলোচিত এই হত্যাকাÐে গ্রেফতারকৃত শওকত হোসেন বিটু খুলনার দৌলতপুরের চাঞ্চল্যকর হজি শহিদ হত্যা মামলার আসামি বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হরিনটানা থানার উপ-পরিদর্শক মিলন কুমার মৈত্র গতকাল রোববার রাতে বলেন, ওই দুই আসামিকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য গুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। খুনের সাথে জড়িত অন্য আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতার, ঘাতকদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি উদ্ধারসহ হত্যাকাÐের রহস্য উদঘাটনের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে ।
খুলনা-যশোরে চরমপন্থি তৎপরতা!
Leave a comment