এম সাইফুল ইসলাম
শহীদ অধ্যাপক খালেদ রশীদ। চিরকুমার এ কমরেড খুলনার শহিদ হাদিস পার্কের শহিদ মিনারের ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রæয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে তিনি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পাক-চীন মৈত্রী সমিতির খুলনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি (এমএল)-এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধে খুলনায় নয় মাসে সংগ্রামী মানুষের ত্যাগ-তীতিক্ষা ও স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রামী শহিদ অধ্যাপক খালেদ রশীদের নাম। খুলনার বাইতিপাড়া এলাকার তালতলা রোড থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সেতু’ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘সন্দীপন’ নামের মাসিক পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। হত দরিদ্র পরিবারের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে জনমত গঠনের লক্ষে এ পত্রিকা দু’টিতে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ছাপা হত। ছাপা হত খালিশপুর ও রূপসা অঞ্চলের শ্রমিকদের দুর্দশার কাহিনী। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনই ছিল পত্রিকা দু’টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও বর্গা চাষীদের অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশ পেত ‘সেতু’ ও ‘সন্দীপন’ পত্রিকার পাতায়। তিনি ‘সন্দীপন’ পত্রিকার ‘আলকেমি’ ছন্দনামে লিখতেন।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে খালেদ রশিদের নেতৃত্বে খুলনার ডুমুরিয়ার শোভনা অঞ্চলে বিপ¬বী গেরিলা বাহিনী সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু করে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐতিহ্যবাহী শোভনা অঞ্চল। সেখানে বিচরণ কৃষক মজুরের সংগ্রামী নেতা মাওলানা আহমদ আলীর। ডুমুরিয়ার শোভনা অঞ্চলকে অধ্যাপক খালেদ রশিদ আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বেঁছে নিলেন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল রেডিও পাকিস্তান খুলনা কেন্দ্র দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থ অভিযান এবং চুকনগরের পাকবাহিনীর গণহত্যায় ডুমুরিয়ার মানুষ ফুঁসে উঠে। খালেদ রশিদের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনী সদা প্রস্তুত। তখনকার দিনে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুরূহ। পাক হানাদার বাহিনীর দুই/তিনটা গানবোট ডুমুরিয়ার নদীতে টহল দিত। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের চোরা মাইরের কারণে পাক বাহিনী পিছু হটে যায়। পাকবাহিনী ভদ্রা ও কৈয়া নদী থেকে আশে-পাশের গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চলাতে থাকে। শোভনা মুক্ত অঞ্চল হলেও রাজাকার ও খালেদ রশিদের নেতৃত্বে টার্গেট এই অঞ্চলের ওপর। পাকবাহিনীর একটি গানবোট দিয়ে হামলা চালায় শোভনা গ্রামের ওপর। অসীম সহসিকতার সাথে বিপ্লবী গেরিলা বাহিনী তার প্রতিরোধ করেন। শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীকে বোঝাতো মুক্তিবাহিনীর চেয়েও বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ গেরিলারা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। গেরিলারা সাধারণত পিছু হটতো না। পাক বাহিনী গেরিলাদের হাতে ২/১ বার পরাজিত হওয়ার পর শোভনা এলাকায় গেরিলাদের ঘাঁটি ও অবস্থান জেনে নেয়।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কথা। পাকিস্তান বাহিনী দু’টি গানবোট নিয়ে শোভনা অঞ্চলের গেরিলাদের ওপর আক্রমণ চালায়। গানবোট দু’টিতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুদ ছিল। অধ্যাপক খালেদ রশিদের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী মরণপন রাতভর যুদ্ধ করে। পাক বাহিনীর একটি গুলিতে অধ্যাপক খালেদ রশিদের মৃত্যু হয়।
১৯৩৪ সালে সিরাজগঞ্জে তার জন্ম হয়। তার পিতার নাম বাহাদুর সরদার, পেশায় ব্যবসায়ী। খালেদ রশিদ সিরাজগঞ্জ থেকে এসএসসি পাশ, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এমএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে খুলনা মহিলা কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদেন। এই কলেজটি সরকারি হলে পদত্যাগ করে সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি উপাধ্যক্ষ। রণাঙ্গনের এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা চির কুমার থাকায় তার কোন স্বজন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গেরিলা যুদ্ধে শহীদ হন ডুমুরিয়ার অধ্যাপক খালেদ রশীদ
Leave a comment