
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে ঘূর্ণিঝড় কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, প্রতিবছর আঘাত হানা এক আজন্ম অভিশাপ। বিশেষ করে, বছরের বর্ষা মৌসুমের আগে এবং পরে আকাশে মেঘ দেখলেই তাদের মনে দানা বাঁধে এক চেনা ভয়, এই বুঝি হারালাম সবকিছু।
এই ভয়ের একটি ভৌগোলিক এবং বৈশ্বিক কারণও রয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূখ- প্রাকৃতিকভাবেই নিচু এবং সমতল। অসংখ্য নদী-নালা জালের মতো ছড়িয়ে থাকায় এই অঞ্চল যেমন উর্বর, তেমনই অরক্ষিত। বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির উপকূলরেখা সামুদ্রিক ঝড়কে দানবীয় শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন নামক বৈশ্বিক অভিশাপ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘূর্ণিঝড়গুলোকে আরও শক্তিশালী ও ঘন ঘন আঘাত হানার পরিবেশ তৈরি করছে। ফলে, যা ছিল প্রকৃতির এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তা এখন এক বিধ্বংসী ও নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। উপকূলের সাধারণ মানুষ, যারা এই জলবায়ু পরিবর্তনে সামান্যতম ভূমিকাও রাখেনি, তারাই এর সবচেয়ে নিষ্ঠুর শিকার।
তবে প্রকৃতির এই রুদ্র রূপের বিপরীতে উপকূলকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন- সুন্দরবন। সিডর, আইলা বা বুলবুলের মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের সামনে সুন্দরবনই যেন হয়ে উঠেছিল এক প্রাকৃতিক বর্ম। এর অসংখ্য গাছপালা, শ্বাসমূল আর নদ-নদীর ঘন নেটওয়ার্ক ঝড়ের গতিকে অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা শোষণ করে নেয় এবং উপকূলের মূল ভূখ-কে সরাসরি আঘাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, দূষণ এবং বনখেকোদের আগ্রাসনে সুন্দরবন নিজেই আজ বিপন্ন। এই প্রাকৃতিক রক্ষাকবচকে রক্ষা করতে না পারলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বাংলাদেশের জন্য আরও কত ভয়াবহ হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। সুন্দরবনকে বাঁচানো তাই কেবল একটি পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি উপকূলের কোটি মানুষের জীবন বাঁচানোর সমার্থক।
উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রতিবছর হারায় তাদের স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, নিকটাত্মীয়, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি। সিডর, আইলা, ফণী, আম্ফানÑ এসব নামের সাথে মিশে আছে হাজারো মানুষের কান্না আর হারানোর বেদনা। তবে এই দুর্যোগগুলোই তাদের আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিও জোগায়। এই হারানোর যন্ত্রণা কেবল বস্তুগত বা শারীরিক নয়, এর একটি গভীর মানসিক প্রভাবও রয়েছে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলের শিশুদের চোখে যে আতঙ্ক জমা হয়, তা ভোলার নয়। ঝড়ের রাতে বাতাসের হুংকার আর জলোচ্ছ্বাসের গর্জন তাদের শিশু মনে যে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে, তা সারাজীবনেও শুকায় না। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের উদ্বেগ। বারবার ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারিয়ে তারা একসময় মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি প্রায়শই ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।
এই সংকটের সবচেয়ে নীরব শিকার হয় নারী ও শিশুরা। দুর্যোগের সময় এবং পরে তাদের দুর্ভোগ পৌঁছায় চরমে। আশ্রয়কেন্দ্রে অপরিসর ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নারীরা তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকেন। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে তারা নানা রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন, বিশেষ করে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্যোগ পরবর্তী সময়েও সংসারের হাল ধরতে নারীদেরই সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। অন্যদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। দুর্যোগের এই লিঙ্গভিত্তিক এবং বয়স-ভিত্তিক প্রভাবগুলো আমলে না নিলে কোনো পুনর্বাসন কার্যক্রমই পুরোপুরি সফল হতে পারে না।
এখানে ঘূর্ণিঝড় বৃষ্টি ও বাতাসের সাথে সাথে নিয়ে আসে লোনা পানির বিশাল ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাস। মানুষ কেবল তার শেষ আশ্রয় হারায় না, খাদ্য-বস্ত্র-পানির অভাব তখন সবচেয়ে প্রকট হয়। বাঁধ ভেঙে নদীর লোনা পানি উপকূলে ঢুকে পুকুর, টিউবওয়েলসহ অন্যান্য পানির উৎস নষ্ট করে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে ডেকে আনে খাদ্য সংকট এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি। সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায় লবণাক্ততা আর তীব্র বাতাসের তোড়ে। জেলে হারায় তার মাছধরার জাল ও নৌকা। অনেকেই হারায় তাদের জীবিকার অনুসঙ্গ, যার ফলে বেড়ে যায় অপরাধপ্রবণতা। লোনা পানির এই আগ্রাসন কেবল তাৎক্ষণিক সংকট তৈরি করে না, এটি উপকূলের কৃষি অর্থনীতি এবং বাস্তুতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে বদলে দেয়। যে জমিতে একসময় সোনার ধান ফলত, লবণাক্ততার কারণে তা আজ বন্ধ্যা। বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক তাদের শতবর্ষের পেশা ছেড়ে চিংড়ি চাষ বা অন্য পেশায় ঝুঁকছে। চিংড়ি চাষ লাভজনক হলেও এটি মাটির উর্বরতা আরও কমিয়ে দেয় এবং লবণাক্ততা বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে মিষ্টি পানির মাছ ও দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এটি একটি চক্রাকার সংকট তৈরি করে। ঘূর্ণিঝড় লবণাক্ততা বাড়ায়, আর সেই লবণাক্ততা কৃষিকে ধ্বংস করে মানুষকে এমন পেশার দিকে ঠেলে দেয়, যা পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে। এর ফলে উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর এক নীরব আঘাত নেমে আসে।
বেশিরভাগ মানুষ সঠিক খবর ও সচেতনতার অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না। যারা আশ্রয় গ্রহণ করে তারা ফিরে এসে বাড়ির খোঁজ নেয়, হারিয়ে যাওয়া গবাদিপশুটির খোঁজ নেয়। ঘূর্ণিঝড় বাড়িঘর আস্ত রাখে না, অনেকসময় মেরে ফেলে তাদের সম্বল গবাদি পশুদের। কিন্তু, এই অদম্য মানুষগুলো আবার ঘুরে দাঁড়ায়। চোখের পানিকে আড়াল করে ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করে, গড়ে তোলে আরেকটা বাড়ি, মাছে ভরা পুকুর, গোয়ালভরা গবাদি পশু-পাখি। কিন্তু, এসব আয়োজন যেন আবার ঘূর্ণিঝড়ের কাছে সঁপে দেওয়ার জন্য।
এই ঘুরে দাঁড়ানো এখন আর কেবল ভাঙা ঘর নতুন করে গড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে করতে উপকূলের মানুষ শিখে নিয়েছে অভিযোজনের নিজস্ব কৌশল। তারা এখন অতীতের অর্জিত জ্ঞানের সাথে আধুনিক প্রযুক্তিকে মিলিয়ে টিকে থাকার নতুন পথ খুঁজছে। অনেকেই মাটির ভিটার উচ্চতা বাড়িয়ে ঘর তৈরি করছেন। বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে ভাসমান সবজির বাগান তৈরি করছেন কেউ কেউ, যা জলোচ্ছ্বাসেও নষ্ট হয় না। লবণাক্ততা-সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদ বাড়ছে। কমিউনিটি-ভিত্তিক দুর্যোগ প্রস্তুতি দল গঠন করে তারা নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে।
উপকূল রক্ষায় বেড়িবাঁধগুলোই প্রথম প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ, দুর্নীতি এবং নদী ভাঙনের কারণে অনেক বাঁধই দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ। একটি শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা তাদের থাকে না। আবার আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যেগুলো আছে, তার অনেকগুলোই মূল বসতি থেকে দূরে হওয়ায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সেখানে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। দুর্যোগের সময় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে।
তাছাড়া, যখন একজন কৃষক নদী ভাঙনে তার জমি হারায়, একজন জেলে তার নৌকা হারায় এবং একজন দিনমজুর তার কাজ হারায়, তখন নিজের গ্রামে টিকে থাকার আর কোনো উপায় থাকে না। জীবন ও জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার পরিবার প্রতি বছর উপকূল ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ি জমায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনার মতো বড় শহরের বস্তিগুলোতে আশ্রয় নেয় তারা, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে এক ভিন্নধর্মী সংগ্রাম। মাটির সঙ্গে বেড়ে ওঠা এই মানুষগুলো শহরের ইট-পাথরের জীবনে খাপ খাওয়াতে পারে না। তারা তাদের পরিচিতি হারায়, সামাজিক বন্ধন হারায় এবং প্রায়শই ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। এই জলবায়ু-শরণার্থীদের গল্পগুলো জাতীয় পরিসংখ্যানে প্রায়শই হারিয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে দাঁড়ায়, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে, এমনকি ঘর মেরামতের ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু, স্থানীয় রাজনীতির চক্করে পড়ে অনেক সময় মূল ক্ষতিগ্রস্তরা এসব সাহায্যের বাইরে থেকে যায়। ত্রাণ কার্যক্রম প্রায়শই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন, যেমন- টেকসই জীবিকার ব্যবস্থা করা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, অথবা জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণÑ এসব দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় না। ফলে, একটি দুর্যোগের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আরেকটি এসে আঘাত হানে, এবং মানুষগুলো এক ত্রাণ-নির্ভরতার দুষ্ট চক্রে আটকা পড়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই অন্তহীন সংগ্রামের শেষ কোথায়? কেবল ত্রাণ বা তাৎক্ষণিক সাহায্য দিয়ে এই সমস্যার মূল উৎপাটন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। টেকসই ও মজবুত বেড়িবাঁধ, পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী তৈরি করতে হবে, তেমনই লবণাক্ততা-সহনশীল কৃষি ব্যবস্থা ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ বা ক্ষয়ক্ষতি পূরণের তহবিল আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সকল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, তারাই এই সংকটের প্রধান ভুক্তভোগী এবং তারাই জানে টিকে থাকার সেরা উপায়। উপকূলকে বাঁচাতে হলে তাদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকেও সম্মান জানাতে হবে।
সত্তরের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন কিংবা ১৯৯১ সালের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিডর, আইলা, ফণী, আম্পান বা মোখার মতো প্রচ- ক্ষমতাশালী ঝড়গুলোতেও আমরা মৃত্যুর সংখ্যাকে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এই বৈপ্লবিক সাফল্যের পেছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে আমাদের সময়োপযোগী আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আমরা দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাণহানি দিন দিন কমিয়ে আনছি।
উপগ্রহ থেকে তথ্য সংগ্রহ, উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক (বিশেষ করে সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম বা সিপিডি) একযোগে কাজ করে। ঝড়ের কয়েকদিন আগে থেকেই বিপদ সংকেত পৌঁছে যায় উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাইকিং, রেডিও, টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারণার ফলে মানুষ দুর্যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। এই সক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু, সাফল্য কি আমাদেরকে এক ধরনের আত্মতুষ্টির বিভ্রান্তিতে ভোগাচ্ছে? আমরা কি ধরে নিচ্ছি যে, মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনার বার্তা দিতে পারাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত সফলতা? সময় এসেছে এই প্রশ্নগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করার। সতর্কবার্তা জীবন বাঁচায়, কিন্তু সেই জীবনকে সচল রাখার জন্য যে জীবিকা প্রয়োজন, তা কি আমরা রক্ষা করতে পারছি?
বাস্তবতা হলো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো সতর্কবার্তা, শেষ ধাপ নয়। যখন একজন উপকূলীয় বাসিন্দাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা জানিয়ে ঘর ছাড়তে বলা হয়, তখন আমরা কি ভেবে দেখেছি, তার গন্তব্য কোথায়? সংকেত পাওয়ার পর সেই মানুষটির যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত, মানসম্মত ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র কি আমরা আদৌ নিশ্চিত করতে পেরেছি? কাগজে-কলমে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ। বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্রই সারাবছর অবহেলায় পড়ে থাকে। দুর্যোগের সময় সেগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা, সুপেয় পানি বা পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকে না। বিশেষ করে নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই পরিবেশ অত্যন্ত অনিরাপদ ও অবমাননাকর।
এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, গবাদি পশুর জন্য স্থানের অভাব। উপকূলীয় অঞ্চলের একটি পরিবারের কাছে তার কয়েকটি ছাগল, হাঁস-মুরগি বা একটি গরু কেবল পশু নয়, এগুলো তার জীবিকার প্রধান অবলম্বন এবং বছরের সঞ্চয়। যখন আশ্রয়কেন্দ্রে এই নিরীহ প্রাণীগুলোর জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকে না, তখন অনেক পরিবারই তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝড়ের মধ্যে নিজেদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, আমাদের সতর্কবার্তা ব্যবস্থা সচল থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী অবকাঠামোর কারণে পুরোপুরি কার্যকর হতে পারে না। মানুষকে কেবল ‘যাও’ বলাই যথেষ্ট নয়, তাদের একটি নিরাপদ ও মানবিক আশ্রয় নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত।
সতর্কবার্তা মানুষকে সাময়িকভাবে নিরাপদ স্থানে সরাতে পারে, কিন্তু দুর্যোগের মূল আঘাতটি আসে আমাদের ভঙ্গুর অবকাঠামোর ওপর। আর এই অবকাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাতেই যখন এই বাঁধগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, তখনই প্রকৃত বিপর্যয় শুরু হয়। একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসে, কেন প্রতি বছর একই জায়গায় বাঁধ ভাঙে? কেন বর্ষার আগে বা দুর্যোগের ঠিক আগমুহূর্তে জরুরি মেরামত বা আপৎকালীন সংস্কার করতে হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের সংস্কৃতিতে। আমাদের বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়েছে ত্রাণবান্ধব। অর্থাৎ, এমনভাবে দুর্বল করে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়, যা ভেঙে গেলে নতুন করে ত্রাণ ও মেরামতের সুযোগ তৈরি হয়। টেকসই ও জলবায়ু-সহনশীল বাঁধ নির্মাণে যে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ এবং স্বচ্ছতা প্রয়োজন, সেখানে দুর্নীতি ও অবহেলার অভিযোগ প্রকট। যখন একটি পাঁচ বা ছয় ফুট জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কাতেও বাঁধ ভেঙে যায়, তখন বুঝতে হবে এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। এই দুর্বল অবকাঠামোগত ব্যর্থতা দুর্যোগের ক্ষতিকে কেবল বহুগুণ বাড়িয়েই তোলে না, এটি সতর্কবার্তার সাফল্যকেও ম্লান করে দেয়।
বাঁধ ভাঙার তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়া। কিন্তু, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আরও ভয়াবহ এবং স্থায়ী। বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে যখন সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে, তা এক অপূরণীয় বিপর্যয়ের সূচনা করে। এই লবণাক্ত পানি বছরের পর বছর কৃষি জমিকে অনুর্বর করে রাখে। কৃষকের সোনালি ধানের স্বপ্ন নোনা পানিতে ডুবে যায়। মিঠা পানির মাছের ঘেরগুলো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। সুপেয় পানির একমাত্র উৎস যে পুকুর, তা লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। এই দীর্ঘমেয়াদী বিপর্যয় থেকে মানুষ সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।
আমাদের বর্তমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি অদ্ভুত দ্বৈত সংকট তৈরি করেছে। আমরা আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারছি, কিন্তু টেকসই অবকাঠামোর অভাবে সেই মানুষগুলোর জীবিকা রক্ষা করতে পারছি না। একজন মানুষ যখন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঝড়ের পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন, তার ভিটেমাটি লোনা পানিতে ডুবে আছে, ফসলের জমি নষ্ট হয়ে গেছে, মাছের ঘের ভেসে গেছে, তখন তার বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
দুর্যোগের পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত ধীরগতির এবং প্রায়শই তা ত্রাণ-নির্ভর। এই ত্রাণ সাময়িক স্বস্তি দিলেও তা টেকসই সমাধান দেয় না। একটি ভাঙা বাঁধ সময়মতো মেরামত না হওয়ায় মানুষ এক ফসলের পর আরেক ফসল হারাতে থাকে। সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। জীবিকা হারিয়ে এই মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে স্থায়ী দারিদ্র্যের চক্রে আটকে পড়ে। শেষ পর্যন্ত, তারা সব হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে শহরের বস্তিগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং, আমরা জীবন বাঁচিয়ে হয়তো পরিসংখ্যানের পাতায় সফল হচ্ছি, কিন্তু জীবিকা ধ্বংস করে আমরা একটি নিঃস্ব ও পঙ্গু জনগোষ্ঠী তৈরি করছি। এটি কোনোভাবেই টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হতে পারে না।
সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। কেবল দুর্যোগের সময় তৎপর হয়ে ওঠা যথেষ্ট নয়। দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে সারাবছর ধরে। আমাদের সাফল্যকে পরিসংখ্যানের ঘরে আটকে না রেখে, তা মানুষের প্রকৃত জীবনমানে প্রতিফলিত করতে হবে। আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থার যে আধুনিকায়ন আমরা করেছি, তা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। এর পাশাপাশি আমাদের সমস্ত মনোযোগ ও বিনিয়োগ এখন টেকসই অবকাঠামোর দিকে ফেরাতে হবে। বিশেষ করে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোকে নেদারল্যান্ডসের ডেল্টা প্ল্যানের মতো দীর্ঘমেয়াদী ও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনায় পুনর্নির্মাণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা মাথায় রেখে বাঁধের উচ্চতা ও কাঠামো নতুন করে ডিজাইন করতে হবে। বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি মেরামতের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কেবল দুর্যোগের সময় নয়, সারাবছর ব্যবহারোপযোগী এবং মানবিক সুবিধাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে।

