ডেস্ক রিপোর্ট : মানুষের ঘরের আঙিনা, বারান্দা কিংবা গ্রামের মাঠে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভরসার সঙ্গী হয়ে থাকা ছোট্ট প্রাণীটি হলো চড়ুই পাখি। বাদামি-ধূসর পালক, ছোট ঠোঁট আর কিচিরমিচির ডাক দিয়ে একসময় আকাশ মুখর করে তুলত এই পরিচিত গৃহচড়ুই। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ এ পাখিটি যখন বিলীন হওয়ার পথে তখন সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা হাটেরমোড় এলাকায় দেখা মিললো ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি। ইটাগাছা হাটের মোড়ে দৈনিক পত্রদূত অফিসের সামনে জোড়া বকুল গাছে রাতে আশ্রয় নেয় হাজারো চড়ুই। পূবের আকাশ আঁধার হতেই তারা ফিরে আসে নীড়ে। সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের পাশে এক জোড়া বকুল গাছ। এই গাছে রাতে পাতার চেয়ে পাখি বেশি দেখা যায়। যানবাহনের শব্দ, মানুষের কোলাহল ওদের নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটায় বটে তবুও ওরা একে অপরের সাথে থাকে মিলেমিশে। গোধূলির আভায় ওরা এসে বসে বিদ্যুৎ লাইনের তারের উপর। সেখানে বসে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়। তারপর সবাই ফিরে এলে বসে সবুজ পাতায় মোড়া বকুলের ডালে। সকালে আলো ফোটার আগেই আবার চলে যায় দূর-দূরান্তে খাদ্যের সন্ধানে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর-ব্রহ্মরাজপুর গার্লস হাইস্কুলের জীব বিজ্ঞানের শিক্ষক আসমাতারা জাহান বলেন-চড়ুই আকারে ছোট, দৈর্ঘ্য ১৪-১৬ সেন্টিমিটার এবং ওজন ২৫-৪০ গ্রাম। এদের পালক বাদামি-ধূসর রঙের, ডানায় থাকে কালো দাগ। শস্যদানা, ভাতের দানা ও ছোট পোকামাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য। কৃষিজমিতে কীটপতঙ্গ খেয়ে চড়ুই কৃষকের উপকার করে। তবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিক্ষক আসমাতারা জাহান বলেন-একসময় কাঁচা ঘর-বাড়ির চাল, উঠানের বাঁশঝাড় বা গাছের ডালে চড়ুই বাসা বাঁধত। কিন্তু কংক্রিটের দেয়াল ও কাচঘেরা ভবনের ভিড়ে আশ্রয় হারাচ্ছে তারা। কৃষিজমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে কমছে পোকামাকড়, যা চড়ুই ছানাদের জন্য প্রধান খাবার। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ এবং মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণ। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে চড়ুইয়ের সংখ্যা। বিড়াল, কাক, হুতোম পেঁচা, বাজপাখি, সাপ ও ইঁদুরের মতো প্রাণী চড়ুইয়ের বড় শত্রু। পাশাপাশি মানুষের শিকার, গাছ কেটে ফেলা, দূষণ এবং কীটনাশক ব্যবহারের কারণে এ পাখি আজ আরও হুমকির মুখে।
বিশিষ্ট নাট্য শিল্পী ও প্রবীণ শিক্ষক অনুজিত কুমার মন্ডল বলেন- চড়ুই রক্ষায় প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাড়ির ছাদ বা বারান্দায় পানির পাত্র ও কিছু দানাদার খাবার রাখা, কাঠ বা বাঁশের ছোট বার্ডহাউস ঝুলিয়ে দেওয়া, আশেপাশে গাছ লাগানো-এসব ছোট উদ্যোগ চড়ুইকে ফিরিয়ে আনতে পারে। কীটনাশক কমানো ও দূষণ নিয়ন্ত্রণও জরুরি। প্রতি বছরের ২০ মার্চ বিশ্ব চড়ুই দিবস পালন করে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক গাজী শাহজাহান সিরাজ বলেন-চড়ুই শুধু একটি পাখি নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিরও অংশ। লোককথা, ছড়া, গান-সব জায়গায় চড়ুইয়ের উপস্থিতি আছে। 'চড়ুইভাতি' শব্দের উৎপত্তি এ পাখির নাম থেকেই। আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ গল্পে, রজনীকান্ত সেনের কবিতায় কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের লেখায় বারবার উঠে এসেছে চড়ুইয়ের কথা।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন-আজ শুধু চড়ুই নয়, টিয়া, বউ কথা কও, গাঙশালিক, বুলবুলি-এসব পাখিও হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ একসময় এইসব পাখির ডাকেই ভোরে জেগে উঠত বাঙালি।
সাহিত্যিক গাজী শাহজাহান সিরাজ আরও বলেন-চড়ুই পাখির মতো এখন দেখা মেলে না, টিয়াপাখি, গাঙচিল, গাঙশালিক, হলদেপাখি, বউ কথা কও, বুলবুলির মতো অনেক পাখি। অথচ এসব পাখির ডাকে ঘুম ভাঙত বাঙালির।
তিনি বলেন-চড়ুইয়ের কিচিরমিচির শুধু ভোরের সঙ্গীত নয়, এটি প্রকৃতির সুষমার প্রতীক। চড়ুই রক্ষা করা মানে একটি প্রজাতি বাঁচানোই নয়, বরং আমাদের পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে বাঁচানো। তাই এখনই উদ্যোগ নিতে হবে-চড়ুই থাকুক আমাদের উঠানে, প্রকৃতি থাকুক তার প্রাণচাঞ্চল্যে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত