জন্মভূমি ডেস্ক : পাঁচ বছর আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৫ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। গত বছর শেষে তা ৫৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সে হিসাবে ২০১৯ সালের পর এ চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ শতাংশেরও বেশি।
সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে অগ্রণী ব্যাংকের। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্তও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। গত বছর শেষে তা ১৮ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ এ পাঁচ বছরে অগ্রণীর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২০৩ শতাংশেরও বেশি। এ সময়ে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮০ শতাংশ। আর সোনালী ব্যাংকের বেড়েছে ২৪ দশমিক ৮৯ ও জনতা ব্যাংকের ২১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোর কোনোটিই কার্যকর হয়নি। বরং দিন যত যাচ্ছে, এ ব্যাংকগুলোর ঋণ শৃঙ্খলা আরো বেশি ভেঙে পড়ছে। এখনো প্রভাবশালীদের তদবিরে বড় অংকের ঋণ বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রধান চার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী (এমডি) পদে থাকা ব্যক্তিদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। তাদের ব্যর্থতার কারণে ব্যাংকের অপেক্ষাকৃত নিচের পদের কর্মকর্তারা নীতিনির্ধারণী ভূমিকা রাখছেন; ঋণ বিতরণ, কর্মীদের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছর শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২৫ দশমিক ৮৯ শতাংশই উঠেছে খেলাপির খাতায়। অথচ মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সাল শেষেও খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ২০৩ শতাংশেরও বেশি।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অগ্রণী ব্যাংকের সবক’টি আর্থিক সূচকেই পতন হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন বা সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ছিল ৪ হাজার ৮২৮ কোটি টাকার বেশি।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে ২০২২ সালের আগস্টে নিয়োগ পান মুরশেদুল কবীর। একই সময়ে সোনালী ব্যাংকে আফজাল করিম এবং রূপালী ব্যাংকে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে এমডি পদে নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে গত বছরের এপ্রিলে জনতা ব্যাংকের এমডি পদে মো. আবদুল জব্বার নিয়োগ পান।
অগ্রণী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাবেক এমডি মো. শামস-উল-ইসলামের মেয়াদে বাছবিচার ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। সেসব ঋণ এখন আর আদায় হচ্ছে না। আবার এমডি পদে মুরশেদুল কবীর দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকটির সামগ্রিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তিনি ব্যাংকের কর্মকর্তা কিংবা গ্রাহক, কোনো পক্ষেরই আস্থা অর্জন করতে পারছেন না। এ কারণে ঋণ আদায় পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও মুরশেদুল কবীরকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমডির তৎপরতায় অসন্তোষ আছে অগ্রণী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদেরও। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত বলেন, ‘ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্তই ত্বরিত নিতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ক্ষেপণ হলে ব্যাংকের পাশাপাশি গ্রাহকও ক্ষতিগ্রস্ত হন। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সাহস ও দক্ষতার ঘাটতি আছে। এটি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে।’
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকটকে বড় করে দেখছেন ড. জায়েদ বখ্ত। ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-৫-এর আওতায় আমরা বেশকিছু ঋণ পুনঃতফসিল করেছিলাম। এখন বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে গ্রাহকরা ঠিকমতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব ব্যাংকের অন্যান্য আর্থিক সূচকের ওপর পড়ছে।’
গত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে রূপালী ব্যাংকের। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা, যা ছিল বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত বছর শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশই এখন খেলাপির খাতায়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। গত বছর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। ব্যাংকের মুনাফাসহ সবক’টি আর্থিক সূচকে উন্নতি হয়েছে। প্রভিশন ঘাটতি কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। এজন্য বড় ঋণ না দিয়ে এসএমই ও কৃষি ঋণ বিতরণে জোর দেয়া হচ্ছে। আশা করছি, রূপালী ব্যাংক আরো ভালোর দিকে যাবে।’
খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকে অবনতি হয়েছে সোনালী ব্যাংকেরও। ২০১১ সাল-পরবর্তী সময় থেকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য দেশ-বিদেশে তুমুল সমালোচিত হয়েছিল ব্যাংকটি। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ওই ঋণ কেলেঙ্কারির ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, উল্টো নতুন ঋণ কেলেঙ্কারিতেও ব্যাংকটির নাম জড়িয়ে পড়ছে। গত পাঁচ বছরে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা থাকলেও গত বছর শেষে তা ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশই এখন খেলাপি।
সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই হাউজ বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশনে কাটিয়েছেন। এ কারণে কোর ব্যাংকিং সম্পর্কে তার ধারণা একেবারেই কম। সরকারি খাতের বৃহৎ ব্যাংক হওয়ায় সোনালীর কার্যক্রম অনেক বড়। কিন্তু তিনি কোনো কিছুই ঠিকমতো সামলে উঠতে পারছেন না। এ কারণে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের একজন ডিএমডিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। বড় গ্রাহকরাও এমডির সাক্ষাৎ পান না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও আফজাল করিমের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়ছে। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় বিতরণকৃত ঋণের ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত বছর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ৫০১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।