
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। মানচিত্রে এটি একটি ভূখণ্ড মাত্র; কিন্তু বাস্তবে এটি এক প্রাত্যহিক রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গনের একপাশে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল রূপ সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা, মাটির লবণাক্ততা, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আর তীব্র নদীভাঙন। অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে এই জনপদের লাখ লাখ নিঃস্ব মানুষ। এটি কোনো গতানুগতিক জীবনযাপন নয়। এটি একটি অঘোষিত জলবায়ু যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধারা হলেন আমাদের উপকূলের সেই অদম্য মানুষগুলো, যারা কোনো অপরাধ না করেও জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার।
প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙে এই মানুষগুলোকে বেঁচে থাকার নতুন লড়াই শুরু করতে হয়। তাদের লড়াই সুপেয় পানির জন্য, তাদের লড়াই এক চিলতে ফসলি জমির জন্য, তাদের লড়াই ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বা বড় বড় সেমিনারে যখন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়, তখন এই মানুষগুলো সেই তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেন নিজেদের রক্ত, ঘাম এবং শেষ সম্বলটুকু দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ছাড়াই সম্পূর্ণ খালি হাতে তারা এই অসম লড়াই আর কতদিন চালিয়ে যাবেন?
উপকূলের এই যোদ্ধারা লড়ছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে। যখন সমুদ্রের আগ্রাসী নোনাজল তাদের ফসলের মাঠ আর পুকুরের মিঠা পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে, তখন তারা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যে কৃষক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সোনালি ধানচাষ করতেন, তিনি আজ বাধ্য হয়ে লবণ-সহিঞ্চু জাতের ফসল আবাদের চেষ্টা করছেন, যা প্রায়শই অলাভজনক। অনেকে ধানের বদলে চিংড়িচাষ শুরু করেছিলেন; কিন্তু সেই চিংড়ি ঘেরও ঘন ঘন দুর্যোগে ভেসে যাচ্ছে।
যখন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়ছে, তখন তারা ধারদেনা করে বা শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ঘরেরভিটে এক ফুট উঁচু করছেন। এই ভিটে উঁচু করার প্রক্রিয়াটি কোনো সরকারি প্রকল্প নয়, এটি তাদের ব্যক্তিগত লড়াই। যে কৃষক একসময় জমিতে লাঙল চালাতেন, লবণাক্ততা তার জমি কেড়ে নেওয়ায় সে আজ পেশা পরিবর্তন করে নদীতে মাছ ধরছেন বা দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন। এই খাপ খাইয়ে নেওয়া বা অভিযোজন প্রক্রিয়াটি কোনো তাত্ত্বিক শব্দ নয়। এর প্রতিটি ধাপেই রয়েছে বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ। একটি লবণ-সহিঞ্চু ফসলের বীজ কেনা, একটি পুকুরকে লবণাক্ততা থেকে রক্ষা করা, ঝড়ের পর ঘর মেরামত করা বা পেশা পরিবর্তন করে নতুন জীবিকা খোঁজা, এর প্রতিটির জন্যই অর্থের প্রয়োজন। এই ব্যয়বহুল লড়াই তারা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এই অসম লড়াইয়ে তাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্য যে ফুরিয়ে আসছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার কী, তা প্রতিফলিত হয় আমাদের জাতীয় বাজেটে। উপকূলীয় সুরক্ষা এবং অভিযোজনের জন্য প্রতি বছর যে বরাদ্দ রাখা হয়, তা কি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট?
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) গঠিত হয়েছে, যা নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু মোকাবিলার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু, এই তহবিলের আকার এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল চাহিদা বিবেচনা করলে এই বরাদ্দকে অপ্রতুলই বলতে হয়। তদুপরি, যেটুকু বরাদ্দ আসে, তা প্রায়শই ব্যয় হয় তাৎক্ষণিক বা জরুরি মেরামতের কাজে। টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে যে ধরনের বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন, তার অভাব সুস্পষ্ট।
যখন একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়, তখন তা জরুরি মেরামত করা হয়। সেই দুর্বল বাঁধ পরের জলোচ্ছ্বাসেই আবার ভেঙে যায়। এই চক্রাকার ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে বরাদ্দের স্বল্পতা এবং সেই বরাদ্দের ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা ছাড়া শুধু খণ্ডিত প্রকল্প দিয়ে এই বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়।
এই সংকটের মূল প্রোথিত রয়েছে- জলবায়ু অবিচাচারের ধারণার মধ্যে। যে উন্নত দেশগুলোর লাগামহীন কার্বন নিঃসরণ এবং শিল্পায়নের ফলে আজ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটছে, সেই দেশগুলো এই বিপর্যয়ের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ী। অথচ এর সবচেয়ে নির্মম শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যাদের কার্বন নিঃসরণের দায় ইতিহাসে প্রায় শূন্য। এই ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকেই উন্নত দেশগুলো প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্যারিস চুক্তি থেকে শুরু করে প্রতি বছরের জলবায়ু সম্মেলনে (COP) এই নিয়ে অনেক কথা হয়। লস অ্যান্ড ড্যামেজ বা ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি বিশেষ তহবিল গঠনের ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সেই প্রতিশ্রুত অর্থায়ন আজও একটি মরীচিকা হয়েই আছে।
যে সামান্য অর্থায়ন পাওয়া যায়, তা আসে ঋণ হিসেবে, অনুদান হিসেবে নয়। অথবা তা এমন সব জটিল শর্তের জালে আটকা পড়ে থাকে যে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে তা পৌঁছাতেই পারে না। এই অর্থায়ন প্রাপ্তিতে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতা যেমন রয়েছে, তার চেয়েও বেশি রয়েছে উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি মানবিক সংকট হিসেবে না দেখে, এটিকে একটি দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এটিই জলবায়ু অবিচারের সবচেয়ে নগ্ন এবং নিষ্ঠুরতম রূপ। অর্থায়ন ছাড়া উপকূলের এই একতরফা লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ কী? এর পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এরই মধ্যে তা দেশব্যাপী দৃশ্যমান। সেই পরিণতি হলো- ব্যাপকহারে জলবায়ু অভিবাসন। যখন একজন কৃষক তার জমি হারান, যখন একজন জেলে তার জীবিকা হারান, যখন একজন মানুষ বারবার দুর্যোগে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন, তখন তার সামনে একটিই পথ খোলা থাকে, ভিটেমাটি ত্যাগ করা। এই মানুষগুলোই জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হচ্ছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন শহরের বস্তিগুলোতে।
উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙন যেন একটা চিরাচরিত প্রথা। বাংলাদেশে বর্ষা মানে নদী ভাঙন আর নদী ভাঙন মানেই নদী তীরবর্তী মানুষদের চরম দূর্ভোগ। পত্র-পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন নদীর ভাঙন ও ভাঙন কবলিত মানুষদের দুর্দশার যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা সত্যিই হৃদয় বিদায়ক। ‘নদীর এ পাড় ভাঙে, ওপাড় গড়ে এইতো নদীর খেলা।’ এটি দেশের একটি গানের লাইন। আর এই বাস্তবতা উপকূলীয় মানুষদের কাছে যেন কখনই পুরাতন হয় না। প্রতিনিয়ত ঘুরে ঘুরে আসে ভাঙনের এ সর্বনাশা খেলা। নদী তীরের লাখো মানুষ প্রাই বছর ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বশান্ত হয়। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের মিছিল হয় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
২০০৯ সালের ১৫ই মে আইলার আগ্রাসনে পড়া শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ খ্যাত ইউনিয়ন গাবুরা পদ্মপুকুর ইউনিয়নের মানুষদের সর্বশান্ত হওয়ার চিত্র যেন এখনো বিগত হয়নি এ এলাকার মানুষদের কাছে। নদী ভাঙনের শিকার জনগোষ্ঠী সব হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য ছুটে গিয়েছিল শহরের দিকে। এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করেছিল তারা। অনেকে এক মুঠো অন্নের জন্য বাধ্য হয়েই নানান রকম সমাজ বিরোধী কাজেও লিপ্ত হয়। তাদের কাছে যেন মানবিক হয়ে ওঠে চিরশত্রু। সুতরাং শহরে এ রকম ছিন্নমূল মানুষদের ব্যাপক প্রবেশে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাও বেড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো অভিশপ্ত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয় শহরের মানুষের কাছে। এই চিত্র কারো কাম্য হতে পারে না।
কিন্তু নদী ভাঙন প্রতিরোধে সেই অতীতের দিনগুলো থেকে আজ অবধি সফল কোনো কর্মসূচি এখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। বাজেটের সিংহভাগ যেন চলে যায় নদী ভাঙনের সাথে। বিভিন্ন মানুষের স্বেচ্ছাচরিতার কারণে নদী ভাঙনের বাস্তব চিত্র সম্বলিত সেই গানটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বরং আরো বেশি করেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্ষা মৌসুম আসার আগ থেকেই নদী তীরের জনপদগুলোতে এখনো আতংক বিরাজ করে। কারণ, রাক্ষুসী নদীগুলো দয়ামায়াহীনভাবে গ্রাস করে নেয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা স্মারকসহ সমৃদ্ধ জনপদগুলো। মুহূর্তেই নিভিয়ে দেয় নদী তীরবাসীর সুখ-স্বপ্নের। উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাঠি, পূর্ব পাতাখালী, চাউলখোলা, বন্যতোলা এলাকার চিত্র দেখলেই বোঝা যায় এ এলাকার মানুষের দূর্দশার কথা। অন্নের চেয়ে যেন ভেড়িবাঁধ সংস্কারের চিন্তাটাই তাদের কাছে বেশি। ‘খাই দায় পাখি বনের দিকে চাই’ এই প্রবাদের মতই তারা চেয়ে থাকে বাঁধের দিকে।
উপজেলার রমজাননগর ইউয়িনের টেংরাখালির কওমিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন ভেড়িবাঁধের দিকে তাকালে বোঝা যায় এলাকার মানুষগুলো কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু তাদের এই নিরব কান্না শোনার মত নেই যেন কেউ। পদ্মপুকুর ও রমজাননগর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নিয়ে এক বা একাধিকবার মানব বন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে স্থানীয় যুব সংগঠন ও এলাকাবাসী। কিন্ত কোন প্রতিকার পায়নি তারা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, টিভি চ্যানেলগুলো এখানকার মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশার কথা তাদের সুন্দর লেখনি এবং উপস্থাপনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক হিসাবের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই বিপুলায়তন জমি নদীতে গ্রাস করে নেবার ফলে কতো সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার যে উদ্ভাস্তু হয়ে পড়ে, তার চিত্রটি অত্যন্ত ভয়াবহ। ফসলের জমি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি হারিয়ে ঐসব মানুষগুলোকে যে কি অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্গতির মধ্যে পতিত হতে হয়, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়েনা। আবার, নদী এদিকে ভেঙে অন্যদিকে চর জাগালেও তাতে ভাঙন কবলিত অসহায় মানুষদের উপকারে আসে না। সে চর অধিকাংশ দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। এক সময় নদী-শাসনকে অসম্ভব মনে করা হতো। কিন্তু এখন নদীশাসন এবং নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। এখন নদীর ভাঙন রোধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মানুষ তা প্রায় একশ বছর আগেই প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে নদী ভাঙনের কবল থেকে গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ রক্ষা এবং বন্যা-নিয়ন্ত্রণের জন্যে দীর্ঘদিন ধরে নদী-শাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে।
২০০৯ সালের আইলার পর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা হলেও দুঃখজনকভাবে এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো উল্লেযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্প যেমন হওয়া উচিত বাস্তবভিত্তিক তেমনই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থসম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ এলাকার মানুষের প্রত্যাশা, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী-ভাঙন প্রতিরোধ করতে নদীশাসন ও সংস্কারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
রূপান্তরিত বাংলাদেশে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশ সাজছে ভিন্ন পরিকল্পনায়, চলছে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশটিকে নতুনভাবে সাজাতে চান অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার। রক্ত ঝরানো এই অভ্যুত্থান দেশের মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে ফিরবে সেই সুদিন, যেদিন দেশটি নতুনভাবে ডানা মেলবে, মানুষ ফিরে পাবে তার গণতান্ত্রিক অধিকার। দেশের সব মানুষ যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চান, তেমনি দেশটির দক্ষিণপ্রান্তে সমুদ্রঘেঁষা উপকূলের মানুষও চান রূপান্তরিত বাংলাদেশে অগ্রাধিকারে থাকুক উপকূল। যে উপকূলে আছে হাজারো সংকট, একই সঙ্গে হাজারো সম্ভাবনা। প্রাকৃতিক বিপদের মুখে থাকা দক্ষিণ দুয়ার খোলা রেখে আমরা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে পারবো না।
রূপান্তরিত বাংলাদেশে সংস্কার এবং পরিবর্তনের নানামুখি চিন্তাভাবনা চলছে সব মহলে। সামগ্রিক চিন্তার আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারও ভাবছে নতুন কিছু। কিন্তু সেসব ভাবনায় উপকূলের প্রান্তিকের মানুষেরা কতটা স্থান পাচ্ছে আমাদের জানা নেই। সংকট আর সম্ভাবনা নিয়ে সমুদ্ররেখায় জেগে আছে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল। প্রাকৃতিক বিপদ এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। বহু এলাকার মানুষ এখনও জোয়ার-ভাটায় ভর করে জীবনযাপন করেন। আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখনও সমুদ্র ও নদীনির্ভর। প্রাকৃতিক ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষ সৃষ্ট ঝুঁকি। যেন আমরাই আমাদের বিপদ ডেকে আনছি। দুর্যোগ দুর্বিপাক প্রতিনিয়ত হানা দেয় উপকূলে। প্রায় সারাবছরই কোনো না কোনো ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখি হয় উপকূল। উপকূলের মানুষের জীবন জীবিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব দুর্বিপাকের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এখানকার মানুষ বাঁচে, এগোয় সামনের দিকে। উপকূলের মানুষের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার তাগিদেই উপকূলের দিকে সুদৃষ্টি প্রয়োজন।
অবকাঠামো: পূর্বে টেকনাফের শাহ্ পরীর দ্বীপ থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত অধিকাংশ স্থানেই শক্ত বেড়িবাঁধ নেই। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ থাকলেও তা বছরের পর বছর অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। নদীভাঙনের কারণে বহু এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম ভাসিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলের অধিকাংশ দ্বীপ-চর এখনও বেড়িবাঁধের আওতায় আসেনি। এ সব এলাকার লাখ লাখ মানুষ বছরের পর বছর অরক্ষিত থাকছে। একই অবস্থা রাস্তাঘাটের। ফলে সামান্য ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও বাড়িঘর ডুবে যায়, ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
দুর্যোগ-দুর্বিপাক: দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে সাফল্য দেখাতে পারলেও উপকূলে স্থানীয় পর্যায়ে এখনও রয়েছে অনেক সমস্যা। দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, আগের চেয়ে লোকসংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাই প্রতিটি গ্রামে অন্তত একটি করে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র দরকার। একইসঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে নারী ও শিশুদের জন্য সুষ্ঠুভাবে অবস্থানের পরিবেশ থাকা দরকার। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তার ক্ষেত্রেও অনেকের অভিযোগ আছে। অনেকে আবার বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা তারা যথাযথভাবে পান না। সর্বশেষ সাইক্লোন রেমাল-এর ক্ষেত্রেও আমরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখতে পাই। দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আরও সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।
বাস্তুচ্যুত মানুষের ভিড়: উপকূলের বহু মানুষ প্রাকৃতিক কারণে বাড়িঘর হারাচ্ছে। নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে উপকূলের মানুষ তাদের বসতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। অনেকে আবার নিজের ভিটেমাটি আঁকড়ে এলাকায় থাকার চেষ্টা করেন। এমন বহু পরিবার রয়েছে, যারা ১০-১৫ বার বাড়ি বদল করে অবশেষে ঠাঁই নিয়েছেন শহরের বস্তিতে। তিনবেলা ঠিকভাবে খাওয়া, কাজের সংস্থান, মাথা গোঁজার ঠাঁই, এমনকি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে প্রচন্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করছে নদীভাঙন। সম্পদ হারিয়ে পথে বসেছে বহু পরিবার। এমন অনেক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তাদের দুর্দশার চিত্র। বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রায়ণ প্রকল্প করা হলেও তা কতটা টেকসই, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সেসব আশ্রায়ণে ন্যুনতম নাগরিক সুবিধা নেই। এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর জন্য বড় সমস্যা।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ক্ষতবিক্ষত উপকূল
নদী ভাঙন: নদী ভাঙন উপকূলজুড়ে এক স্বাভাবিক চিত্র। ক্রমাগত ভাঙনে বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের নদনদীর গতিপ্রকৃতি। বহু মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কালিঞ্চি গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই কান পাতলে ভেসে আসে ভাঙনের শব্দ। মধ্য-উপকূলে ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, মনপুরা, চাঁদপুর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, কলাপাড়া, ঢালচর, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা অনেকে বেশি বলে সরেজমিন পাওয়া তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়। মেঘনা নদীর দু’পাড়েই ভয়াবহ ভাঙনের চিত্র চোখে পড়ে। কূল ভেঙে নদীর মাঝখানে চর জাগে, আবার ভাঙনের প্রলয়ে জেগে ওঠা সেই চরও নিঃশেষ হয়ে যায়। উপকূলজুড়ে এই ভাঙনের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রভাবিত। ভাঙন রোধে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় বরাদ্দ কাজে লাগছে না। অন্যদিকে ভাঙন কবলিত মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা যথাযথ সুফল বয়ে আনছে না।
নৌপরিবহনের সংকট: জলরাশি বেষ্টিত উপকূলে জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদী। অধিকাংশ স্থানের মানুষ এখনও নৌপথের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের এলাকাগুলোর মানুষ সড়কপথের ওপর ভর করে যাতায়াত করতে পারলেও মধ্য উপকূলের বহু বিচ্ছিন্ন জনপদ এখনও পুরোপুরি নৌপথের ওপর নির্ভরশীল। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে কিছু এলাকা থেকে নৌপরিবহন ব্যবস্থা উঠে গেলেও কিছু নৌপথ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সময় কিংবা জোয়ারভাটা মেপেই চলাচল করতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। কিন্তু অধিকাংশ সময় এসব নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। নৌযানগুলোতে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে। একইসঙ্গে বহন করা হয় যাত্রী ও মালামাল। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে বাড়িয়ে ফেলা হয় ঝুঁকি। অন্যদিকে উপকূলজুড়ে নাব্যতা সংকট বিদ্যমান। ফলে নৌচলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, আবার পণ্য পরিবহনেও বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়া কোথাও ইতিবাচক সম্ভাবনার ইঙ্গিতও দিচ্ছে। নাব্যতার ক্ষেত্রে সংকট উত্তরণ এবং সম্ভাবনা বিকাশের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড: কৃষিসহ উপকূলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। উপকূলের চরাঞ্চলের ঊর্বর মাটি বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদনের উপযোগী। কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ঘটতে পারে কৃষি বিপ্লব। তা সত্তেও সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ প্রান্তিক পর্যন্ত এখনও পৌঁছেনি। মহিষের দুধের রয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। অন্যদিকে পূর্ব উপকূলে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার কিছু অংশে লবণ উৎপাদন হলেও চাষিরা পান না ন্যায্যমূল্য। মৎস্যখাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশের বিরাট সুযোগ রয়েছে। শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, শৈবালসহ আরও অনেক কৃষিজ পণ্য উৎপাদন এবং তা থেকে বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকাশ হতে পারে।
মাছধরা: উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম নদী-সমুদ্রে মাছধরা। আর এই মাছধরায় তাদের বাহন ট্রলার-নৌকা। প্রতিদিন হাজার হাজার জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যান। ট্রলার-নৌকার নোঙর ওঠানোর পর জেলেরা ভর করে নিয়তির ওপর। প্রথমত, মাছধরার নৌযানগুলোতে নির্মাণ কৌশলে রয়েছে ত্রুটি। কারণ এগুলো নির্মাণে বৈজ্ঞানিক কোনো কলাকৌশল প্রয়োগ হয় না। এগুলো দেখার জন্য নেই যথাযথ কর্তৃপক্ষ। ফলে যে যার মতো কম খরচে নির্মাণ করে মাছধরার নৌযান। মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলার নৌকাগুলোতে নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো লাইফ জ্যাকেট কিংবা বয়া। এমনকি বহু নৌযানে নেই আবহাওয়া বার্তা শোনার যন্ত্র। ফলে প্রতিবছর ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান কিংবা নিখোঁজ হন বহু জেলে। মাছধরায় নিয়োজিত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
ভূমি ব্যবস্থাপনা: উপকূল অঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক ও উন্মুক্ত চরাঞ্চল। প্রতিনিয়ত জাগছে নতুন চর। অধিকাংশ স্থানে এগুলোর অপব্যবহার লক্ষ্যণীয়। প্রভাবশালীরা গায়ের জোরে এগুলো ব্যবহার করে। বাড়ির বা জমির সামনে দিয়ে বেড়িবাঁধের বাইরের জমির মালিকানা নিয়ে নেন তারা। জমি চাষাবাদ, জলাধারে মাছধরা সবই থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট চর এলাকা এবং নদীর সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় এগুলো যে যার মতো ব্যবহার করছে। এ নিয়ে সংঘর্ষ বাঁধে, খুন জখমের মতো ঘটনাও ঘটে। মামলা মোকদ্দমা চলতে থাকে যুগের পর যুগ। জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল অঞ্চলের মানুষদের রক্ষার তাগিদে ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই বাঁধ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাঁধের ভেতরের খালগুলো এবং বাঁধের সঙ্গে নির্মিত স্লুইজগেটগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে থাকে।
পরিবেশ-প্রতিবেশ: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে গাছপালা মরছে। কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। ভাঙাগড়ায় দ্বীপ চরগুলোতে এক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষ সৃষ্ট কারণ। নদী ভরাট হচ্ছে, দখল হচ্ছে, গাছপালা কেটে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে পরিবেশ বিধ্বংসী শিল্প। এসব কারণে উপকূলের পরিবেশের ওপর ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। সে কারণে উপকূলের পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবন সুরক্ষা: প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বিপর্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মিঠা পানির প্রবাহ কমে গিয়ে লবণ পানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের মিষ্টিপানি নির্ভর গাছপালার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি জমা হচ্ছে সুন্দরবনের ভেতরে। বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের ভেতরে মিষ্টি পানির প্রবাহ বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন বহুবার। অন্যদিকে রামপাল সুন্দরবনের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, আবার তেল, কয়লা, সারের বার্জ ডুবে সুন্দরবনের পানি দূষিত করে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করছে। শেষ সাইক্লোন রেমাল-এ প্রবল জোয়ারের পানিতে ডুবেছিল সুন্দরবন। লোকালয়ে ভেসে এসেছিল অনেক হরিণ। অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে সুন্দরবনের প্রাণীকূল বিপদাপন্ন। সামগ্রিকভাবে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
শিক্ষা ব্যবস্থা: উপকূল অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থায় হাজারো সংকট চলমান যুগের পর যুগ। শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত থাকছে উপকূলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে। নদীভাঙনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়ায় অনেক শিশু ঝরে পড়ে। এভাবে বারবার স্কুল বদল হওয়ায় অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ নেই। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাঘাট নেই। দুর্যোগের কারণে, এমনকি স্বাভাবিক জোয়ারেও অনেক এলাকায় স্কুল বন্ধ রাখা হয়। আবার স্কুলগুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও আসবাবপত্র নেই। এর সঙ্গে যোগ হয় অভিভাবকদের অসচেতনতা ও দারিদ্র্য। অল্প বয়সে ছেলেশিশুরা কাজে যোগ দেয়, আর মেয়েশিশুদের বিয়ে হয়ে যায়। উপকূলের শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিবেশ। উপকূলের শিক্ষায় আলাদা নজর দিতে হবে।
কখনো সমুদ্র বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: চিকিৎসা কিংবা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র কল্পনায় এলে উপকূলের এক বিপন্নতার চিত্র ভেসে ওঠে। অনেক বার দেখেছি, মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকতে। পাশে স্বজনেরা আহাজারি করছে। আসলে তাদের কিছু করার নেই। নদী পেরিয়ে কখন ওপারে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যাবে- সেই আশায় বসে থাকতে হয়। ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা বলা হলেও উপকূলের ২২ হাজার মানুষের জন্য একটা কমিউনিটি ক্লিনিক দেখেছি- যেখানে ডাক্তার ও ওষুধ নেই। নারী স্বাস্থ্য, নারীদের মাতৃত্বকালীন পরিচর্যা, নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত শিশুদের স্বাস্থ্য। কিন্তু পর্যাপ্ত সেবা ব্যবস্থা না থাকায় শিশুরা নানান রোগবালাই নিয়ে বেড়ে উঠছে। বিশেষ নজর রাখতে হবে উপকূলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়।
পর্যটন: কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবনসহ কয়েকটি বহুল পরিচিত স্থান ছাড়াও উপকূলের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন সম্ভাবনা বিকাশের বিরাট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ঘন বনে আবৃত দ্বীপচর। দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে অসংখ্য মনোরম সমুদ্র সৈকত। এসব দ্বীপচর এবং সমুদ্র সৈকত ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারে। বর্ষা মৌসুমের কয়েকমাস বাদে শুকনো মৌসুমে নদীপথে পর্যটকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারলে এবং থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে একমাত্র উপকূলই পর্যটন শিল্পের বিরাট দ্বার খুলে দিতে পারে।
উপকূল মন্ত্রণালয় ও উপকূল উন্নয়ন বোর্ড: উপকূলের উন্নয়নের জন্যে পৃথকভাবে এ দেশে এখন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এক সময় অফসর আইল্যান্ড বোর্ড গঠিত হলেও এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। উপকূলের নাগরিকেরা কার কাছে কথা বলবে? উপকূলের মানুষের সমস্যার কে সমাধান করবে? উপকূলের অভিভাবক হিসাবে উপকূল মন্ত্রণালয় গঠন এখন সময়ের দাবি। এরই মধ্যে উপকূলের বিভিন্ন স্থান থেকে নাগরিক সমাজ এ দাবি তুলেছে। উপকূল মন্ত্রণালয় গঠিত হলে উপকূলের সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান হবে। উপকূলের মানুষের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
উপকূল দিবস: ’৭০-এর ১২ নভেম্বরের প্রলয় স্মরণে ১২ নভেম্বরকে উপকূল দিবস ঘোষণার দাবি উঠেছে। ২০১৭ সাল থেকে বেসরকারিভাবে সমগ্র উপকূলে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত