
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: ‘ঘর হারিয়ে এসেছি শহরে। এখন এখানে বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতরে পানি ওঠে। আমরা যেন এক দুর্যোগ থেকে আরেক দুর্যোগে এসে পড়েছি।’—বলছিলেন ৫৫ বছরের রহিমা বেগম। তার জন্ম উপকূলীয় শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে, আর এখন বাস সাতক্ষীরা পৌরসভার ইটাগাছা বস্তিতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য শহরের বস্তিগুলো হয়ে উঠেছে ‘আশ্রয়হীন আশ্রয়স্থল’। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা কিংবা জলোচ্ছ্বাসের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে তারা শহরে এসেছেন। অথচ শহরও প্রস্তুত নয় এই উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে।
এক শহরে ৭০ হাজার মানুষের ঠাঁই বস্তিতে
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)-এর এক ধারণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরা পৌরসভায় বর্তমানে ৪৭টি বস্তিতে বাস করছেন প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। যা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ। তাদের অধিকাংশই জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার। উপকূলের কৃষক, জেলে, দিনমজুর। এখন তারা শহরের বস্তিতে গৃহকর্ম, রিকশা চালানো, ফুটপাতের হকার কিংবা হোটেল বয়ের কাজ করে দিনযাপন করছেন।
জলাবদ্ধতা: বাস্তুচ্যুতি থেকে নতুন দুর্যোগে
নানান দুর্যোগের কারণে নিরাপত্তা ও জীবিকার আশায় উপকূল ছেড়ে সাতক্ষীরা শহরে এলেও এসব বস্তিতে নেই পরিকল্পিত সড়ক, ড্রেনেজ বা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় বসতঘর, রান্নাঘর, এমনকি গোয়ালঘরের পশুকে বাস করতে হয় পানিতে।
সম্প্রতি তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে ইটাগাছা, গদাইবিল, মাঠপাড়া, রাজারবাগান, লিচুতলা, বদ্যিপুর কলোনি, গড়েরকান্দা, রহমতপুর, চালতেতলা, বাঁকাল ইসলামপুর কলোনি, বোসপাড়া বলফিল্ড বস্তি, পৌরসভার পেছনের হরিজনপল্লী এবং দক্ষিণ কামাননগরসহ পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।
কামালনগর বস্তির আমিনুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ি হারিয়ে এখানে এসেছেন ২০১০ সালে। এখন বর্ষায় ঘরেই পানি ওঠে। পানিতেই রান্না, ঘুম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার উপায় থাকে না।
৮,৫০১ পরিবার, ৩৫,৭০৪ জন উদ্বাস্তু
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উত্তরণ’-এর তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে ২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আম্ফান পর্যন্ত সাতক্ষীরা পৌরসভায় ৮,৫০১টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে বস্তিতে। তাদের সদস্য সংখ্যা ৩৫,৭০৪ জন। তাদের অধিকাংশই বর্তমানে বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ ঘর, নোংরা পানিতে ডুবে থাকা রাস্তাঘাট, এবং ভেঙে পড়া স্যানিটেশন ব্যবস্থা তাদের নিত্যসঙ্গী।
“দু’মুঠো ভাতের জন্য যুদ্ধ করতে হয়”
কামালনগর বস্তির জাফর আলী বলেন, ‘সকাল ৭টায় ঘর থেকে বের হই কাপড় বিক্রি করতে, ফিরি রাত ৯টায়। বৃষ্টি হলে বিক্রি বন্ধ। তখন ঘরে ভাতও থাকে না।
গড়েরকান্দার সাথী আক্তার বলেন, ‘তিন মেয়ের মধ্যে দুজনকে ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে দিতে হয়েছে। বস্তিতে রাখা নিরাপদ না। রাতদিন উৎপাত আর ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়।’
নেই সরকারি পরিকল্পনা, নেই শহরের প্রস্তুতি
জলবায়ু কর্মী এস এম শাহীন আলম বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো সুস্পষ্ট ও বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা এখনো নেই। বিশেষ করে পৌর বা নগর পর্যায়ে এমন কোনো কাঠামো তৈরি হয়নি যেখানে জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষকে পরিকল্পিতভাবে গ্রহণ, পুনর্বাসন বা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ফলে তারা শহরে এসে নতুন এক মানবিক সংকটে পড়ছে। তাদের বসবাস করতে হচ্ছে অস্থায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ বস্তিতে। নেই স্যানিটেশন, নেই সুপেয় পানির নিশ্চয়তা। বর্ষায় ঘরে পানি ওঠে, আর শুষ্ক মৌসুমে থাকে চরম পানির সংকট।
এস এম শাহীন আলমবলেন, শহরে প্রবেশ করে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ জীবনধারণের জন্য যেসব পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, তা অনেকটাই অনিরাপদ এবং অস্থায়ী। যেমন হকারি, রিকশা চালানো, গৃহকর্ম কিংবা দিনমজুরি।
এত বড় জনসংখ্যা শহরে যুক্ত হলেও নাগরিক পরিকল্পনায় নেই তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান বা কর্মসংস্থানের কোনো অন্তর্ভুক্তি। বিষয়টি শুধু একটি সামাজিক সংকট নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতাও বটে। বলেন ওই জলবায়ু কর্মী।
তিনি আরও বলেন, ‘যত দিন না আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি দিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কৌশল গ্রহণ করব, তত দিন এই সমস্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। শহরকে প্রস্তুত না করে মানুষকে এখানে ঠেলে দেওয়া মানে শুধু শহরের ওপর চাপ বাড়ানো নয়, বরং এই জনগোষ্ঠীকেও প্রতিনিয়ত হুমকির মধ্যে ফেলা।’
উত্তরণ’-এর প্রকল্প কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উদ্বাস্তুদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান ও জীবিকা অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমন্বিত নগর পরিকল্পনা অপরিহার্য।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্বশীল নীতিমালা থাকা জরুরি। এই জনগোষ্ঠী নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে না, অথচ দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তু, বাড়ছে যানজট
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের কারণে শহরের ওপর পড়ছে বাড়তি চাপ। সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, যত বেশি মানুষ শহরে আসছে, নাগরিক চাপ তত বাড়ছে। যানজট এখন চরম আকার নিয়েছে। পিচ-খোয়া উঠে রাস্তাগুলো খানা-খন্দে পরিণত হয়েছে।
জলাবদ্ধতা ও ড্রেনেজ সংকট: নদী খননে অনিয়ম
টানা বৃষ্টিতে শহরের বহু এলাকা হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। রাস্তার ওপর মানুষ যাতায়াত করছে বাঁশ আর ককশিটে বানানো ভেলায়। অ্যাডভোকেট সুধান্য সরকার বলেন, নদী ও খাল খননে বড় অনিয়ম হয়েছে। তলদেশ না কেটে কৃত্রিম গভীরতা দেখানো হয়েছে। ফলে বর্ষার পানি বের হতে পারে না, নদীর পানি উল্টো লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
প্রশাসনের ভাষ্য: সীমিত সক্ষমতায় এগোচ্ছে তারা
সাতক্ষীরা পৌরসভার সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, ‘বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে এবং আমরা সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। পৌরসভার আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা অনুযায়ী সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গভীর নলকূপ বস্তি এলাকাগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজও চলমান রয়েছে।’
সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা বলেন, সাতক্ষীরার গদাইবিল, মাঠপাড়া, রাজারবাগান, লিচুতলা, বদ্যিপুর কলোনি, গড়েরকান্দা, রহমতপুর, চালতেতলা, বাঁকাল ইসলামপুর কলোনি, বোসপাড়া বলফিল্ড বস্তি, পৌরসভার পেছনের হরিজনপল্লী এবং দক্ষিণ কামাননগরের মতো বস্তি এলাকাগুলোর মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব এলাকার ঘরবাড়ি বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্থায়ী। বর্ষাকালে ঘরে পানি ঢুকে যায়, রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, ফলে চলাচল ব্যাহত হয়। শীতকালেও তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
অনেক বস্তিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তারা পৌর এলাকার নাগরিক হিসেবে নিবন্ধিত না হলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা তাদের অবহেলা করছি না। পৌরসভার নাগরিক সুবিধার আওতায় থেকে তারা সুপেয় পানি, সড়ক, ড্রেন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেবা পাচ্ছেন। আমাদের দায়িত্ববোধ থেকে যতটুকু সম্ভব, আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’
পৌর প্রশাসক মাশরুবা ফেরদৌস বলেন, শহরের অনেক জায়গায় আধুনিক ড্রেনেজ দরকার। জরুরি পরিষ্কার অভিযান চলছে, স্থায়ী সমাধানে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
সমাধান কী?
সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, এই শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় বা পৌর পর্যায়ে নেই কোনো সুস্পষ্ট নীতিগত কাঠামো। ফলে তারা বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অথচ এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়, শুধু দরকার পরিকল্পনা, সমন্বয় ও সদিচ্ছা।
এ থেকে উত্তরণে অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী পাঁচটি সুপারিশ করেন। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এতে করে তারা রাষ্ট্রীয় সেবা ও সহায়তার আওতায় আসতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, শহর পরিকল্পনায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্ত করে বিশেষ পুনর্বাসন ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে নিরাপদ বাসস্থান, সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা থাকবে।
তৃতীয়ত, জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন জরুরি। নদী-খাল দখলমুক্ত করা, প্রকৃত গভীরতায় খনন, অকার্যকর স্লুইস গেট সংস্কার এবং অপরিকল্পিত মৎস্য ঘের অপসারণ এখন সময়ের দাবি।
চতুর্থত, বৃষ্টির মৌসুমে জরুরি ভিত্তিতে বস্তিগুলোর জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, অস্থায়ী স্যানিটেশন ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
পঞ্চমত, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি ও উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন কাঠামো তৈরি করতে হবে, যাতে সংকট নিরসনে টেকসই ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়া যায়।
সবশেষে, জাতীয় পর্যায়ে একটি ‘জলবায়ু অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা নীতি’ প্রণয়ন করতে হবে, যাতে শহরগুলোয় আগত এই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পরিকল্পিত পুনর্বাসন নিশ্চিত হয়।