
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এক ভোর। তখনো সূর্য ওঠার বেশ দেরি। হেমন্ত ঋতু চলছে। তবু বাতাসে আগের গরমের তীব্রতা রয়ে গেছে। কুমিল্লায় গোমতী নদীর তীরে টিনের তৈরি ছোট্ট এক ছাপড়ি ঘর। সেখানে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে মাটির ওপর পাতা বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে ১৪ বছর বয়সী জাহিদ হোসেন।
দরজার ওপাশের ছাপড়ি রান্নাঘরে ব্যস্ততা তুঙ্গে। খাবার রান্না চলছে ২০-২৫ জনের। দস্তার হাঁড়িতে ধোঁয়া উড়ছে। জোসনা বেগম নামের একজন ডাকছেন, ‘জাহিদ! ওঠো বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে!’
কোমল স্বরটা ধীরে ধীরে তীব্র হলে জাহিদ হঠাৎ চমকে ওঠে, দৌড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। জোসনা বেগমও খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন, যদিও সেটাকে বলা চলে দীর্ঘশ্বাস।
জাহিদ দৌড়ে স্কুলে কিংবা খেলতেও গেলো না, ওর গন্তব্য ঘরের সামনের ইটভাটা। যেখানে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাদামাখা মাটির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। জোসনা নিজে ওই ভাটায় শ্রমিকদের জন্য রান্না করেন, আর গত বছর থেকে স্কুল ছাড়িয়ে ছেলেকেও সঙ্গে এনেছেন।
কুমিল্লার এ ইটভাটায় আসার আগে জাহিদ ছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এক গ্রামে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের কাছে একটি মাদরাসায় পড়তো সে।
‘দুজন মিলে কাজ করলে আয়টা একটু বাড়ে। দুই মেয়ের পর সে আমার একমাত্র ছেলে, ওকে খুব পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আগে তো আমাদের পেটের কথা ভাবতে হয়’—নিচু স্বরে বলেন জোসনা বেগম।
জাহিদের জন্মের কিছুদিন পরই জোসনার স্বামী তাদের ছেড়ে চলে যায়। তিন সন্তানের ভরণ-পোষণ আর তাদের মানুষ করা জোসনার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মেয়েদের বয়স ১২ হতেই বিয়ে দিতে বাধ্য হন। ভেবেছিলেন, ছেলেকে অন্তত পড়াশোনা করানোর মতো কিছু টাকা জমানো যাবে।
কিন্তু ইটভাটায় একা কাজ করে পাওয়া সামান্য আয় সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। শেষে উপায় না দেখে মা-ছেলে দুজনকেই ভাটায় নামতে হয়েছে।
কুমিল্লার গোমতী বেড়িবাঁধের কাছে ওই ইটভাটায় জাহিদের সঙ্গে আরও অনেক কিশোর কাজ করছে। তাদের অধিকাংশই সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলীয় এলাকা থেকে এসেছে।
শুকলার চর, শ্রীরায়ের চর, দড়িকান্দি এবং জিয়াকান্দিতে থাকা ভাটাগুলো পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে, ছয় বছর বয়সী ছোট ছোট শিশুরাও সেখানে কাজ করছে। কেউ তাদের মা-বাবার সঙ্গে এসেছে, কেউ আবার ছয় মাসের চুক্তিতে শ্রমিক নেতাদের (সরদার) সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
ভিটিকান্দি ইউনিয়নের জগতপুর গ্রামের গোমতীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষা ওই ইটভাটায় জাহিদের মতো আরও অনেক কিশোর-কিশোরী কাজ করে। যাদের বেশির ভাগই সাতক্ষীরা-খুলনার মতো উপকূলীয় এলাকা থেকে আসা। কেউ মাটি কেটে দেয়, কেউ ইট সাজায়, কেউবা শুকানোর জন্য ইট উল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে পোড়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়ার মতো নানান কাজ করে।
শিশু শ্রমিক নিয়োগ বিশেষ করে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আইনবহির্ভূত। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬–এর ২৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিশু বা কিশোরকে আইন ভঙ্গ করে কাজে নিলে বা কাজে লাগাতে দিলে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
তবে ইটভাটার বাস্তব চিত্র ভিন্ন। তপ্ত রোদে কাঁচা ইট শুকানো, ভাটায় আগুন জ্বালানো, ইট-মাটি বহনসহ ইট তৈরির প্রায় প্রতিটি ধাপেই শিশুদের কাজ করতে দেখা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাটাগুলোতে এ ধরনের শিশুশ্রমের অসংখ্য উদাহরণ মিলেছে।
যে শিশুরা একসময় স্কুলে যেতো, খেলাধুলা করতো, দুরন্তপনায় মেতে থাকতো, তারা এখন ভাটার কঠোর ও তীব্র পরিশ্রমের চক্রে আটকে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি বাড়তে থাকায় বহু পরিবার শিশু সন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি তদারকির দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করেছে। ফলে অসংখ্য শিশু শৈশব হারাচ্ছে।
‘ভাটায় আসার পর থেকে জাহিদের দুরন্তপনা আর নেই, আগের মতো আবদার-আহ্লাদও করে না। ও নিজের ভেতরে কেমন গুটিয়ে থাকে। মা তো, বুঝতে পারি—স্কুল, বন্ধু-বান্ধব, আর দাদির কথা, যেইখানে বড় হইছে, ওদের সবার কথা ওর মনে পড়ে’—বলছিলেন জোসনা বেগম।
উপকূলীয় জেলা থেকে কত শিশু ইটভাটায় যাচ্ছে কিংবা কতজন স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে এ বিষয়ে কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২৪ সালের ‘বাংলাদেশের ইটভাটায় শিশুশ্রমের স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ইটভাটায় কাজে যোগ দেওয়ার আগে শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং গ্রামের প্রায় ৮৪ শতাংশ শিশু নিয়মিত স্কুলে যেতো।
জোসনা বেগমের অনুমতি সাপেক্ষে কথা হয় তার ছেলে জাহিদের সঙ্গে। জাহিদ বলছিল, ‘দুপুরের এই সময়টায় আগে স্কুলে থাকতাম, ক্লাসের পর ক্লাস, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করে দিন পার হয়ে যেতো। বাড়ি ফিরে খেয়ে আবার খেলতে যেতাম। এখন তো সারাদিন ভাটায় কাজ করতে হয়।’
প্রতি মৌসুমে কয়েক হাজার শিশু স্কুল ছেড়ে অস্থায়ীভাবে এসব ভাটায় যুক্ত হয়। যদিও ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশুশ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সীদের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমদান নিষিদ্ধ করেছে। শ্রম আইন শিশুদের জন্য এমন কাজ নিষিদ্ধ করলেও বাস্তবে তদারকি প্রায় অনুপস্থিত।
সর্দাররা জানান, ভাটায় কয়েকটি কাজে শিশুদের লাগানো যায়। তাদের মজুরিও কম। আইনি ঝামেলা থাকায় তারা অনেক সময় শিশু শ্রমিক নিতে চান না। তবে বাবা-মায়ের অনুরোধে নিতে হয়। কারণ, এলাকায় কর্মসংস্থান নেই। অভাবের কারণে অনেকে সন্তানদের কাজে পাঠায়। তারাও নিরুপায় হয়ে তাদের কাজে নেন।
জাহিদ যখন কথা বলতে রাজি হয়, তার প্রতিটি কথায় ধরা পড়ে জীবনের ভার। জাহিদ জানায়, সে স্কুল খুব মিস করে। ‘যখন আমি লেখাপড়া করতাম, ভাবতাম একদিন বড় চাকরি করবো। জানি না সেটা আর করতে পারবো কি না’—আক্ষেপের সঙ্গে বলে সে।
গ্রামে থাকার সময় জাহিদ সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে যেতো, দুপুরে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যেতো। ক্রিকেট খেলতে সে খুব ভালোবাসতো, তবে ফুটবলটা খেলতো ভালো।
একটু ভাবতে ভাবতে জাহিদ বললো, ‘বাড়ির দিনগুলো দ্রুত পার হতো। এখানে সকাল থেকেই কাজ শুরু, মাঝে এক-দেড় ঘণ্টার বিরতি, তারপর আবার মাগরিব পর্যন্ত কাজ। এভাবেই দিন পার হয়।’
বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে না পারাটা জাহিদের সবচেয়ে বড় কষ্ট। মাঝেমধ্যে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার, কিন্তু সে জানে পারবে না। এখানে ছয় মাসের চুক্তি, এসময়ে বাইরে কোনো জায়গায় যেতে পারবে না। তাছাড়া গ্রামের বাড়িতেও কেউ নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি বাড়তে থাকায় বহু পরিবার শিশুসন্তানদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি তদারকির দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করেছে, ফলে অসংখ্য শিশু শৈশব হারাচ্ছে।—বলছেন বিশ্লেষকরা
ইটভাটা থেকে আগাম টাকা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জাহিদ বলে, ‘যদি আমি পালিয়ে যাই, তারা আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে আসবে। না হলে আমার মায়ের কাছ থেকে টাকা আদায় করবে। এত (৩০ হাজার) টাকা মা কোথায় পাবে।’
খুলনার কয়রার ১৩ বছর বয়সী মো. সাব্বির হোসেনের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে একজন আলেম হওয়ার। তবে সংসারের অভাবের কারণে গ্রামের বড় ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় চারশ কিলোমিটার দূরে, কুমিল্লার এ ইটভাটায় কাজ করতে আসতে হয়েছে। সেই বড় ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে সাব্বিরের সঙ্গে কথা হয়।
সাব্বির জানায়, গ্রামে তার বয়সী বেশিরভাগ ছেলে এ মৌসুমের শুরুতে তার মতো ভাটার কাজে চলে গেছে। ‘আমার বন্ধুরা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, আমিনবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গেছে’—বলে সে।
সাব্বিরের কথায়, ‘পড়ালেখা করতে আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু বাবা আমাদের ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করেছেন। মা অনেক কষ্ট করে আমার পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছিলেন। গ্রামে এখন তেমন কাজ নেই। বর্ষাকালে মা সংসার চালানোর জন্য সর্দারের কাছ থেকে সাত হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন। আমি এখানে কাজ করে সেই টাকা শোধ করবো। ছয় মাস কাজ করলে আরও কিছু টাকা হাতে পাবো। সেটা মাকে দিলে সংসার কিছুদিন ভালোভাবে চলবে।’
জাহিদের মতো কঠিন বাস্তবতা নিয়েই সাব্বির শেষ করে, ‘নিজের গ্রাম ও বন্ধুদের খুব মিস করি।’
উপকূলের দরিদ্রদের ভাসমান জীবন
গত ৩১ অক্টোবর সাতক্ষীরার শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, সেখান থেকে অন্তত ১০টি জেলায় বাস সংযোগ রয়েছে। এসব বাসে করে শ্রমিকরা বিভিন্ন জেলায় কাজে যাচ্ছেন। সেখানে কথা হয় গাবুরার নয় নম্বর সোরা গ্রামের আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। নিজে কয়েক বছর ধরে ভাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেও এবার ১৩ ও ১৪ বছরের দুই ভাই মিজানুর রহমান ও শাহিনুর ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন ঢাকার সাভারে। যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে টানা ছয় মাস কাজ করবেন তারা। আর আমিনুলের আয় নির্ভর করবে তিনি কতগুলো ইট তৈরি করতে পারেন তার ওপর।
শ্যামনগরের স্থানীয় এনজিও লিডার্সের একজন প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সুব্রত অধিকারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ফলে নিরাপদ খাবার পানি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখানে মাছ বা ফসলও উৎপাদন হতে পারে শুধু লবণ-সহিষ্ণু জাতের।’
ভাটায় আসার পর থেকে জাহিদের দুরন্তপনা আর নেই, আগের মতো আবদার-আহ্লাদও করে না। ও নিজের ভেতরে কেমন গুটিয়ে থাকে। মা তো, বুঝতে পারি—স্কুল, বন্ধু-বান্ধব, আর দাদির কথা, যেইখানে বড় হইছে, ওদের সবার কথা ওর মনে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে এলাকায় বেকারত্ব প্রকট। বনজীবী বা মাছ এবং কাঁকড়া চাষ ছাড়া এখানে বিকল্প পেশা খুব কম। ফলে এলাকার বড় অংশের জনগোষ্ঠী মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যান, সঙ্গে শিশু-কিশোরদেরও নিয়ে যান।’
‘এখানে ভালো স্কুল-কলেজও নেই। তাই অনেকের পক্ষে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়’—যোগ করেন সুব্রত অধিকারী।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ইটভাটার সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮৮১টি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চে (এনবিইআর) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের এসব ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই বন্ডেড লেবার বা ঋণদাসত্বের শিকার। অর্থাৎ, তারা ঋণ পরিশোধের বিনিময়ে ঋণদাতার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্র্যান্ট মিলারসহ কয়েকজন মার্কিন গবেষক। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) চারজন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন গবেষকের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন তারা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ইটভাটার শ্রমিকদের একটি বড় অংশ বছরের পর বছর একই মালিকের অধীনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তারা আগে নেওয়া ঋণের দায়ে জড়িত থাকেন। এ পরিস্থিতি কার্যত এক ধরনের আধুনিক দাসত্বে রূপ নিয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় দীর্ঘদিন কাজ করা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলাবদ্ধ বা বিপজ্জনক এলাকায় বসবাসকারী শিশুদের অনেককে মাসখানেকের জন্য ইটভাটা বা সুন্দরবনের ছোট মাছ আহরণের কাজে নেওয়া হয়। এ ধরনের কাজে তারা প্রায়ই দাদন হিসেবে অগ্রিম টাকা নেয়, কিন্তু প্রকৃত বেতন থাকে না। থাকা-খাওয়ার সুবিধা থাকলেও, বেতন কাজের ওপর নির্ভরশীল।’
‘যদি নির্ধারিত পরিমাণ ইট উৎপাদন করতে না পারে, তবে খাদ্য ও থাকা-খাওয়ার সুবিধাও বন্ধ হয়ে যায়। এক বছরের ঋণ পরিশোধ করতে তারা প্রায়ই পরের বছরও একই কাজে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এ চক্রে পড়ে তাদের জীবন হয়ে ওঠে কঠিন।’
যখন আমি লেখাপড়া করতাম, ভাবতাম একদিন বড় চাকরি করবো। জানি না সেটা আর করতে পারবো কি না।—আক্ষেপ জাহিদ হোসেনের
গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কাজ করার কারণে শিশুদের স্কুলে ফেরার সুযোগ নেই। বছরের মাঝামাঝি যখন তারা ফেরে তখন নতুন বছরের বই বা শিক্ষাসামগ্রী পায় না, ফলে শিক্ষাজীবন স্থায়ীভাবে ব্যাহত হয়। কেউ কেউ ছয় মাসের জন্য কওমি মাদরাসায় যায়, যা তাদের আরও বিচ্ছিন্ন করে। এভাবে তারা শৈশব হারায়।’
তার কথায়, ‘শুধু ছেলে শিশুরাই নয়, মেয়েরাও এ শ্রমে যুক্ত। মেয়েদের ইটভাটায় রান্না-বান্না বা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজে পাঠানো হয়। অনেক সময় তারা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, যা তাদের অবস্থাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে।’
লোনা পানি ছিনিয়ে নিচ্ছে উপকূলের জীবিকা
শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা জার্মান ফাউন্ডেশন ফ্রিডরিখ এইবার্ট স্টিফটংয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় ৬০ শতাংশেরও বেশি কৃষিজমি লবণাক্ততার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, ফলে অনেক পরিবারকে তাদের প্রচলিত আয়ের উৎস ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
শ্যামনগর, কয়রা, দাকোপের মতো বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও খুলনার বেশ কিছু উপজেলা ঊর্ধ্বমুখী লবণাক্ততার তীব্র প্রভাবে ভুগছে। আগে যেসব নদী জীবিকা ও কৃষিজমি সংরক্ষণ করতো, সেগুলো ক্রমশ লোনা হয়ে উঠছে। আবার একসময় ভালো ফলন দেওয়া ধানের ক্ষেতগুলো এখন শুকনো ও অনুর্বর হয়ে পড়েছে। এই উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার কৃষক ও মৎস্যজীবীর জন্য প্রতিটি মৌসুম আসে নতুন চ্যালেঞ্জ আর অনিশ্চয়তা নিয়ে।
সাতক্ষীরার চন্ডিপুরের আল মামুন শেখ ২০ জন শ্রমিকের সর্দার হিসেবে এমএসবি নামে এই ভাটায় কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ইনকাম করা মানুষ যারা তারা এখন সবাই গ্রামছাড়া। গ্রামে মুরুব্বি ছাড়া তেমন কোনো পুরুষ মানুষ নেই। ছোটদের মধ্যে যারা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে, তারাই গ্রামে রয়েছে।’
‘ইটভাটার সব কাজে ছোট ছেলেমেয়েদের লাগে না। তবে সহকারী হিসেবে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীকে নেওয়া হয়। এতে খরচ কিছুটা কমে। কারণ, বড়দের তুলনায় তাদের মজুরি কম দিলেও হয়। অনেক সময় পরিবারের অনুরোধেও তাদের নিতে হয়। কারণ, এলাকায় কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। আবার অভাবে তারা পড়ালেখাও করতে পারে না।’
পড়ালেখা করতে আমার খুব ভালো লাগতো। কিন্তু বাবা আমাদের ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করেছেন। গ্রামে এখন তেমন কাজ নেই। বর্ষাকালে মা সংসার চালানোর জন্য সর্দারের কাছ থেকে সাত হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন। আমি এখানে কাজ করে সেই টাকা শোধ করবো।—বলে সাব্বির হোসেন
আল মামুন বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কৃষিকাজ কমে গেছে। ঘেরে অনেক বেশি শ্রমিক লাগে না। তাই কর্মসংস্থান বলতে হয় সুন্দরবনে যেতে হয়, না হয় ভাটায় আসতে হয়। সব সিজনে এসব কাজ থাকে না।’
‘এসব কাজের সুবিধা হলো, যখন কাজ থাকে না তখন আমরা তাদের আগাম টাকা দিয়ে বুক করে রাখি। সিজন শুরু হলে তারা আমাদের সঙ্গে আসতে বাধ্য।’ তার দলটি প্রতিদিন ২০ হাজার ইট তৈরি করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ মৌসুমে অন্তত ৩০ লাখ ইট তৈরির টার্গেট রয়েছে।’
আল মামুন শেখ জানান, ভাটার মৌসুম শেষ হলে তিনি এবং তার শ্রমিক দল দেশের বিভিন্ন জেলায় ধান কাটার কাজে যাবে। ‘আমাদের সে দলেও অনেক শিশু-কিশোরও থাকবে’- স্বীকার করেন তিনি।
আল মামুন বলেন, ‘আগে অন্য জেলার লোকরা (মজুরির কাজ করা মানুষ) ধান কাটতে আমাদের এলাকায় আসতো। কিন্তু লোনা পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাগ্যও খারাপ হতে থাকে। এখন আমাদেরই সারাবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে হয়।’
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করতে রাজি নন।
তার ভাষ্য, ‘যদিও জলবায়ু পরিবর্তন এ অঞ্চলের দুর্যোগে ভূমিকা রাখে, তবে প্রধান সমস্যা হলো ভুল পরিকল্পনা, নদী অব্যবস্থাপনা এবং শিশুদের প্রতি সামাজিক অবহেলা। শুধু জলবায়ুকে দায়ী করলে সমস্যা বোঝা যাবে না; মানবিক ও প্রশাসনিক ত্রুটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
এ ধরনের পরিস্থিতি বোঝার জন্য ধারাবাহিক গবেষণার প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন গওহার নঈম ওয়ারা।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলোর মধ্যে দীর্ঘসময় কাজ করতে হয় শিশুদের। এতে হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, রক্তস্বল্পতাসহ নানান রোগে তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’
হারানো শৈশব, ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য, শ্রমের বন্ধন—জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশের হাজারো শিশু যে ক্ষতি ও ভোগান্তির মধ্যে বড় হচ্ছে, তার অনেকটাই নীতিনির্ধারণী আলোচনা বা পরিকল্পনায় স্থানই পাচ্ছে না—দেশে তো নয়ই, আন্তর্জাতিক পরিসরেও নয়।
সরকারের কথা ও কাজে সমন্বয় দরকার
অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখন আগের চেয়ে বেশি আলোচনা হলেও মাঠপর্যায়ে কাজ এখনো বেশ বিচ্ছিন্ন ও সমন্বয়হীন।
তিনি বলেন, ‘বহু বছর ধরে নানান উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো প্রায়ই খণ্ডিত থাকে, আর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছায় না।’
‘সরকারের বড় বড় ঘোষণা এখন আর যথেষ্ট নয়। জলবায়ু দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য স্পষ্ট পরিকল্পনাসহ বাস্তবসম্মত নীতিমালা দরকার এবং তা বাস্তবায়নে পৃথক বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করাও জরুরি।
ভাটায় কঠোর পরিশ্রম করছে শিশু-কিশোরেরা
রাজধানী ঢাকার ধামরাইয়ের একটি ভাটায় বানানো ইট বহন ও সাজাতে ব্যস্ত আবু রায়হান নামে একটি শিশু।
যে বয়সে তার সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আনন্দ আর উল্লাসে হেসে খেলে বেড়ানোর কথা, ঠিক তখনই তাকে পরিবার পরিজন ছেড়ে বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার দূরে জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হচ্ছে ইটভাটায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ধামরাইয়ের এ ইটভাটায় যোগ দিয়েছে সে, থাকবে আগামী মার্চ পর্যন্ত।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার নয়াখালী গ্রামের রফিকুল ইসলাম ও নূরনাহার দম্পতির সন্তান রায়হান স্থানীয় একটি মাদরাসায় নবম শ্রেণিতে পড়তো। পড়ালেখা বাদ দিয়েই ইটভাটায় কাজ নিয়েছে সে।
গত সোমবার (১০ নভেম্বর) দেখা হয় তার সঙ্গে।
কিন্তু মাদারাসা, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন ছেড়ে কেন তাকে ইটভাটায় কাজ নিতে হলো? প্রশ্নের জবাব মুখে না দিলেও রায়হানের ছল ছল চোখ বলে দেয় অনেক কিছুই।
নিজেকে সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ পর রায়হান বলে, ঈদের দিন (৩১ মার্চ, ২০২৫) হঠাৎ করেই নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় আমাদের গ্রামসহ আশপাশের আরও চার-পাঁচটি গ্রাম। এতে ঘরবাড়ি, মাছের ঘের সব শেষ হয়ে যায়। আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ি। থাকার জায়গা ছিল না, ঘুমানোর জায়গা ছিল না। ঘরবাড়ি ঠিক করার মতো সামর্থ্যও ছিল না। অভাব কাটে না। তাই ভাটায় আইছি।
শুধু আবু রায়হানই নয়, একই ইটভাটায় কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর এলাকার মো. রাকিবুল হাসান (১৫), আইটপাড়া গ্রামের আল মামুন (১৫), আশাশুনি উপজেলার দক্ষিণ একসোরা গ্রামের মারুফ বিল্লাহ (১২) ও খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর গ্রামের তামিম ইকবাল (১৫)। তাদের সবারই জীবনের গল্পগুলো প্রায় একই রকম।
রায়হান, রাকিবুল, আল মামুন, মারুফ বিল্লাহ ও তামিম ইকবালের বাড়ি দেশের তিনটি উপকূলীয় উপজেলায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ কয়েক বছর ধরেই বর্ষা মৌসুমের পরে ভাটার কাজে যোগ দেয়। সবচেয়ে ছোট ১২ বছরের মারুফ বিল্লাহও এবার দ্বিতীয় বারের মতো ভাটায় কাজে এসেছে। খুব অল্প বয়সেই কেন তারা কাজের সন্ধানে বাড়ি ছাড়ছে তা জানতে তাদের ঠিকানা ধরে অনুসন্ধান করা হয়। নেপথ্যে বেরিয়ে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম কষাঘাতের চিত্র।
অনুসন্ধান বলছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকাশিত সর্বশেষ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণতা সূচক (সিভিআই) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা খুলনার (সিভিআই ০ দশমিক ৫২), কয়রা (সিভিআই ০ দশমিক ৫৭) এবং উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা সাতক্ষীরা (সিভিআই ০ দশমিক ৫১) জেলার অতি উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা শ্যামনগর (সিভিআই ০ দশমিক ৫৮) ও আশাশুনি (সিভিআই ০ দশমিক ৫৫) উপজেলায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুপেয় পানি ও কর্মসংস্থান সংকটের কারণে ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। যার ফলে শৈশব হারাচ্ছে উপকূলের শিশুরা। সুযোগ পাচ্ছে না স্বাভাবিক বিকাশেরও। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে অকালেই। জীবনধারণের তাগিদে আট-নয় বছর বয়স থেকেই তারা কাজের জন্য ছুটছে ইটভাটায় বা যুক্ত হচ্ছে অন্য কোনো পেশায়।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর অক্টোবর এলেই উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা, খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলাসহ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল থেকে হাজারো শিশু স্কুল-পরিবার পরিজন ছেড়ে কাজের খোঁজে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। যাদের বেশির ভাগই ফিরে এসে আর স্কুলে যোগ দেয় না।
শিশু শিক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুসন্ধানে উপকূলীয় কয়েকটি উপজেলার মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের (পুরাতন) মধ্যে ১০টি ইউনিয়নের ৩৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (মাদরাসা ও কারিগরি ব্যতীত) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদ্যালয়গুলোতে ২০২০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে দুই হাজার ৭০৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এ ব্যাচের এক হাজার ৯৪২ জন শিক্ষার্থী ২০২৪ সালে দশম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। অর্থাৎ ২০২০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৬৫ জন আর শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। যাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। পাচ্ছে না পরিবারের আদর মায়া মততা। বঞ্চিত হচ্ছে দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠার, কিংবা ন্যূনতম খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ থেকেও। এটি শুধু একটি উপজেলার একটি ব্যাচের চিত্র।
গল্পচ্ছলে ধামরাইয়ে ইটভাটায় কর্মরত আল মামুন বলে, সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় যখন বিশ্রাম নেই, তখন বাড়ির কথা মনে পড়ে। কেউ খারাপ ব্যবহার করলে মার কথা মনে পড়ে, বাড়ির জন্য পরাণ পোড়ে। আগে বাড়িতে থাকতে খেলাধূলা করতাম, এখানে এসে সে সুযোগ আর নেই। আবার কাজ শেষে ছয় মাস পরে যখন বাড়ি ফিরি তখন বন্ধুরাও আর মিশতে চায় না। কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। আর স্কুলে যাওয়া তো বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আল মামুনের মতো হাজারো শিশুর শৈশব, শিক্ষা আর স্বপ্ন ভেসে যাচ্ছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা কিংবা দারিদ্র্য বা জীবনের কঠিন বাস্তবতায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভাটার সর্দার জানান, ইটভাটায় এমন কিছু কিছু কাজ আছে, যেগুলো শিশুদের দিয়ে করালে খরচ কম হয়, তাই প্রতি ব্যাচ শ্রমিকদের সঙ্গে শিশুদেরও নেন তারা।
যদিও বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো ধরনের শ্রমে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ।
মাত্র ৫৩ হাজার টাকায় চুক্তিতে ছয় মাসের জন্য ইটভাটায় কাজ করছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার দক্ষিণ একসোরা গ্রামের মারুফ বিল্লাহ (১২)। চলতি মৌসুমের আগেও তিন বছর ভাটায় কাজ করেছে সে। অল্প টাকায় কাজ করানো যায় বলে ইটভাটায় শিশু শ্রমিকদের রয়েছে বিশেষ চাহিদা। শিশুদের দিয়ে ভাটায় সাধারণত মাটির বাহন চালানো, কয়লা বহন এবং ইট বানানো ও পোড়ানোর মূল শ্রমিকদের সহযোগিতা করা, শুকানো ও ভ্যানে করে আনা-নেওয়ার কাজ করানো হয়। ঝুঁকি থাকলেও পরিবারের অর্থাভাবে এসব কাজ করতে বাধ্য হয় তারা। দীর্ঘ ছয় মাস ভাটায় কাজ করে অনেকেই আক্রান্ত হয় নানা রোগে।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. জিয়াউর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। দীর্ঘ সময় সেখানে কাজ করার ফলে কোমরে ও ঘাড়ে ব্যথা হয়। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালুতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হয়। রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
কর্মসংস্থান সংকটের কারণে প্রতিবছরই উপকূলীয় এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষ ছয় থেকে সাত মাসের জন্য কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়েন। এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও সাতক্ষীরার শ্যামনগরের জনপ্রতিনিধিদের মতে, এ সময়ে (অক্টোবর-নভেম্বর) শুধু শ্যামনগর উপজেলা থেকেই লক্ষাধিক মানুষ দেশের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করতে যান। এর মধ্যে দুই-তিন হাজারের মতো নারী শ্রমিক এবং অন্তত ১০ হাজার শিশু শ্রমিক ।

