
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : উপকূলের ১৯ জেলার ২ কোটি শিশুরা অন্ধকার জগতে এরমধ্যে খুলনার দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়নের আনিস মোল্লা (৩৫)। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর আর ২০০৯-এর আইলা তার সাজানো জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সবকিছু হারিয়ে বাঁধের ওপর কেটেছে জীবনের পরবর্তী সাতটি বছর। ইচ্ছে থাকলেও দুই সন্তানকে আর লেখাপড়া করাতে পারেননি। একমাত্র মেয়েকে নিরুপায় হয়ে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থসংকটে ছেলের লেখাপড়া বাদ দিয়ে কর্মে যুক্ত করেছেন। এমন ঘটনা দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এখন অহরহ ঘটছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব এখন দৃশ্যমান। আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুরাও জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশে নয়, উপকূলীয় দ্বীপরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবনে জলবায়ুগত সমস্যার প্রভাব পড়েছে। দেশে দেশে এখন ঝড়, বন্যা, খরা আর সুপেয় পানির সংকট। পানি সংকটের কারণে শিশুরা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর মানুষ ১০ ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। তথ্য মতে, গত ১ দশকে বরফ গলার হার ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর স্থলভাগ। ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেসব উপকূলীয় দেশ অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে সেসব দেশের প্রথম সারিতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যেক দেশ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর জন্য দায়ী উন্নত দেশসমূহের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন।
জলবায়ুগত দুর্যোগে ঘরবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর শিশুরা অর্থ উপার্জনের জন্য যেকোনো কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছে! এতে করে শিশুরা নানাবিধ শোষণ ও নির্যাতনের ঝুঁকিতে পড়ছে। দায়িত্ব নিতে না পেরে অনেক পরিবার মেয়ে শিশুদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে এক পর্যায়ে কাজের খোঁজে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে করে এসব পরিবারের শিশুরা পাচার হওয়াসহ যৌন হয়রানির ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। ইউনিসেফ-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঝুঁকির মধ্যে থাকা প্রায় দুই কোটি শিশুর মধ্যে নদীভাঙন এলাকাগুলোয় বাস করছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশু। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে রয়েছে ৪৫ লাখ শিশু আর খরার ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ শিশু। এসব শিশুর পরিবার বিভিন্ন কারণে শহরমুখী হওয়াসহ পরিবারের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে ঋতুচক্র বদলে গেছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা। স্থানচ্যুত হয়ে মানুষ অভিবাসী বা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ভুগতে ভুগতে অনেক পরিবার সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। এসব পরিবার তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
উপকূলে নদীভাঙনের কবলে পড়ে বহু শরণার্থী শিশু ইতিমধ্যে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলের শিশুরা মহাসংকটের সম্মুখীন। সবমিলিয়ে উপক‚লের শিশুরা ভালো নেই। জলবায়ুগত সমস্যা প্রকৃতির পরিবর্তনশীল বাস্তবতা। এ সমস্যা থেকে অতি দ্রুত মুক্তিরও লক্ষণ নেই! কার্যকর সমাধান বের না করলে পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহের জন্য কী পরিণতি অপেক্ষা করছে তা সময়-ই বলবে। শিশুদের নিয়ে চিন্তাটা একটু বেশিই। কেননা শিশুদের জন্য কেমন পৃথিবী অপেক্ষা করছে তা নির্ভর করছে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা মোকাবিলা করা যাবে তার উপর। বর্তমানে যে হারে উন্নত দেশসমূহে কার্বন নিঃসরণ চলছে সেই হার চলমান থাকলে শিশুদেও টেকসই ভবিষ্যৎ যে অনিশ্চিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই!
গবেষণা যা বলছে: প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত বছর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৫ লাখের বেশি মানুষ তাঁদের নিজস্ব আবাসস্থল থেকে স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি সম্পর্কিত ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। শুধু বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ুগত প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার কোটি কোটি শিশু। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক এলাকার শিশুরা জলবায়ুগত সমস্যার শিকার হচ্ছে বেশি। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শিশুরা দ্রুত খাপ খাইয়ে নিয়ে পারছে না। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’ জানিয়েছে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ৭৬ ভাগ শিশু ইতিমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ উচ্চ তাপমাত্রায় ভুগছে। সংখ্যার বিচারে ঝুঁকিপূর্ণ এসব শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪৬ কোটি।বিশ্বের কোনো অঞ্চলের মধ্যে এই হার সর্বোচ্চ।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’-এর অপর একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে (বন্যা, খরা, ঝড়, দাবানল) ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪ কোটি ৩১ লাখ শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীন, ভারত ও ফিলিপাইনসের মতো দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত (৬ বছরে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ) হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এসব দেশের মানুষ বেশি বাস্তুচ্যুত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের লাখ লাখ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। তথ্য বলছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। আর জলবায়ু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি আছে এ দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও প্রকৃতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির আধার এখন ধুঁকছে। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে পুরো উপক‚ল জুড়ে। ফলশ্রুতিতে উপকুলের শিশুদের জীবনে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে লবণাক্ত পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা। লবণ পানি পান করার কারণে শিশুরা নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। দীর্ঘসময়ব্যাপী লবণ পানি পান করার কারণে শিশুদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা জেলায় লবণাক্ততার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তথ্য বলছে, সাতক্ষীরা ও খুলনার কিছু কিছু এলাকায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ১০ পিপিটি (লবণাক্ততা পরিমাপক মাত্রা) পর্যন্ত। পানির অপর নাম জীবন। আর সেই পানি যদি লবণাক্ত বা দূষিত হয়ে পড়ে তবে তা শুধু শিশুদের উপর নয় সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের আবাদী জমির ৩০ ভাগ উপকূলীয় এলাকায়। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত।চিরসবুজ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপর লবণাক্ততার প্রভাব বেড়েই চলেছে। সুপেয় পানির অভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের মানুষের সার্বিক জীবনব্যবস্থায় বিরূপ পড়েছে এবং পড়ছে। এলাকার গরিব-অসহায় মানুষদের বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। পানির জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। যেসব পরিবার বিশুদ্ধ পানির জন্য অর্থ ব্যয় করছে তাদের হয়তো কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু যেসব পরিবার বিশুদ্ধ পানি কিনছে না তাদের লবণাক্ত পানি পান করে জীবন চালাতে হচ্ছে! চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করা শিশুদের অধিকাংশই লবণ পানি পান করছে। আবার মাটির গভীর থেকে পানি তোলার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। লবণাক্ত পানির প্রভাবে এলাকার ফসল উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সার্বিকভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে! নানামুখী সংকটে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকার সন্ধানে শহরে অভিগমন করছে। সব দিক বিবেচনায় উপকূলীয় এলাকায় শিশুরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীতে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে বাল্যবিবাহ। বিশ্বে বাল্যবিবাহ প্রবণ শীর্ষ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। ২০২০ সালে ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল)-এর এক প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে শীর্ষে। তথ্য মতে, ২০১৮ সালে বাল্যবিবাহের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাংলাদেশে যত বাল্যবিবাহ হয় তার এক-তৃতীয়াংশ হয় উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় জেলাসমূহ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও ভোলায় বাল্যবিবাহ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। একের পর এক দুর্যোগে ক্ষত-বিক্ষত উপকূলের পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা যেন আরও খারাপ হচ্ছে। অনেকে কাজ হারাচ্ছে। ফলে উপকূলের অভিভাবকরা নিজের কিশোরী হওয়া মেয়েটাকে আর ঘরে রাখতে চাচ্ছে না! কিশোরী মেয়েটাকে দ্রুত বিয়ে দেওয়াটাই তাদের জন্য যেন অনেক বেশি স্বস্তির! অনেক পরিবার উপকূল ছেড়ে শহরে এসে তাদের মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছে। উপকূলে লবণাক্ততার সাথে দীর্ঘদিন বসবাস করার ফলে বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া নারীদের জরায়ু সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে উপক‚লের জীবনব্যবস্থা দিনের পর দিনাচ্ছে। উপক‚লে কাজের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। অপরদিকে জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। কাজ হারিয়ে অনেক পরিবার দরিদ্র থেকে চরম দারিদ্র্যের কবলে পড়ছে। এককথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপক‚লের জীবন বিপর্যস্ত। নদীভাঙনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বহু পরিবার শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। শহরে এসেও উদ্বাস্তু শিশুরা বিভিন্ন শ্রমের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের শিশুদের যে পড়ালেখার প্রয়োজন আছে তা হয়তো দরিদ্র পরিবারের পিতামাতা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে! এমনকি বহু দরিদ্র পরিবার শিশুর পড়াশোনাকে অলাভজনক কাজ হিসেবে মনে করছে! গবেষণা বলছে, শিশুশ্রমের সাথে যুক্তরাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শিশুশ্রমের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন পরোক্ষভাবে সেইসব কারণকে ত্বরান্বিত করছে। বাড়তি অর্থের আশায় দরিদ্র পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে বহু শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হচ্ছে। এতে হয়তো সাময়িকভাবে পরিবারের কিছুটা অর্থনৈতিক সহযোগিতা হচ্ছে বটে! তবে সার্বিকভাবে শিশুর জীবনকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বর্তমানে শিশুশ্রমের সাথে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ শিশু। বেসরকারি তথ্য বলছে, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৫-১৪ বছর বয়সী মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯ ভাগ। বাংলাদেশে বর্তমানে শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত সঠিক পরিসংখ্যান নেই বললেই চলে! তবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে শিশুশ্রমের সাথে যুক্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।
‘বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন-২০১৬’ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে। যদি এখনই শিশুশ্রম বন্ধে কার্যকর, পরিকল্পিত ও বাস্তসম্মত পদক্ষেপ না নেওয়া যায় তাহলে শিশুশ্রমমুক্ত দেশ গড়া স্বপ্নই থেকে যাবে।
জলবায়ু সমস্যার কারণে অনেক শিশু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে পড়েছে। একটা সমস্যা কাটিয়ে না উঠতেই আরেকটা সমস্যার কবলে পড়ে শিশুরা দিশেহারা। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান হল মনের সুস্থতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর মতে স্বাস্থ্য হল ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়। কিন্তু জলবায়ুগত সমস্যার কবলে পড়া শিশুদের ক্ষেত্রে ঘটছে তার উল্টো। শিশুদের মানসিক বিকাশ মূলত তিন ক্ষেত্র থেকে হয় যথা: পরিবার, বিদ্যালয় ও সামাজিক অবস্থা। এই তিন জায়গার কোনোটা থেকেই শিশুর মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। জলবায়ুগত সমস্যার কবলে পড়া শিশুদের কাউন্সেলিং করা হয় না। অনেক শিশু সমস্যার কাছে হার মেনে বিপথে চলে যাচ্ছে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির কাছে খাপ-খাইয়ে উঠতে পারছে না। শরণার্থী শিশুদের মানসিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। সাধারণত শরণার্থী শিশুরা অন্য শিশুদের তুলনায় সাহায্য-সহযোগিতা কম পায়। জলবায়ুগত সমস্যার কারণে ঠিক কতভাগ শিশু মানসিক সমস্যায় জর্জরিত তার সঠিক
পরিসংখ্যান নেই। এ নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার আলাদা করে শিশুর জন্য কখনো ভাবে না! শিশুর পুষ্টি নিয়ে দরিদ্র পরিবারের সদস্যদের হয়তো কোনো ধারণাই নেই! সবচেয়ে বড় কথা, জলবায়ু পরিবর্তনে একটার পর একটা দুর্যোগের শিকারও করোনা মহামারির বাস্তবতায় আয়-রোজগার কমে যাওয়ার দরুন পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! নতুন বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে মূল্যস্ফীতি। পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় যেখানে মেপে মেপে পা ফেলতে হচ্ছে সেখানে পুষ্টির দিকে নজর দেওয়া কি সম্ভব? ফলশ্রুতিতে উপক‚লবর্তী অঞ্চলসমূহে দারিদ্র্যের সংখ্যা বাড়ছে। দরিদ্র পরিবারের হাজার হাজার শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। উপকূলের বহু দরিদ্র পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। ঠাঁই নিচ্ছে শহরের কোনো বস্তিতে, নদীর তীরে বেড়িবাঁধে কিংবা রেললাইনের পাশে। নিজেরাই যেখানে জীবনযাপন ও খাদ্যের জোগাড় করতে ক্লান্ত সেখানে পরিবারের শিশুদের পুষ্টির চিন্তা করা রসিকতা ছাড়া আর কী! অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য। তবে অন্যভাবে চিন্তা করলে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টিজ্ঞান না থাকলেও শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার দারিদ্র্য হয়েছে এবং এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। উপক‚লবর্তী জেলাসমূহে দারিদ্র্য বেশি, ঠিক সেই কারণেই উপক‚লের শিশুরা অপুষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেও বেশি। পরিবারের আয় কমে গেলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হবে- এটাই স্বাভাবিক! চরম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে! স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। পুরো দেশের অবস্থা যখন এই তখন উপক‚লের অবস্থা সহজে অনুধাবনযোগ্য।
ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা শিশুদের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি অভীষ্ট সফলভাবে অর্জন করতে হলে এবং শিশুদের জন্য নিরাপদ ও টেকসই পৃথিবী গড়তে জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি অভিযোজনের বিকল্প নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে সবার আগে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগতে থাকা বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের থেকে অনেক বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় জেলাগুলোতে আঘাত হানছে। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই অন্য একটি দুর্যোগ আঘাত হানছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলো এককথায় ধুঁকছে। উপকূলীয় জীবনব্যবস্থা এলোমেলো করে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব। উপকূলের শিশুদের জীবন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেই ভবিষ্যৎ শিশুদের জীবন এখন এলোমেলো। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তাপদাহ, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জীবনব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে অনেক আগে থেকেই। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূলের লাখ লাখ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কাজ হারিয়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। অর্থ দিয়েও বিশুদ্ধ পানি মিলছে না। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীভাঙনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। উপকূলে জীবনযাত্রার খরচ এখন আগের থেকে বেড়েছে। বিপরীতে তাদের আয়ের উৎস দিন দিন সংকুচিত হয়েছে এবং হচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল ‘ইউনিসেফে’র ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। ইউনিসেফের ২০২১ সালের অন্য আরেক প্রতিবেদন মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। উপকূলের শিশুদের জীবন দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে হাজার হাজার পরিবার শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে জীবনের তাগিদে বাধ্য হচ্ছে শহরে আসতে। উপকূলে মানুষের কাজ কমে যাচ্ছে, জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, অন্যসব জেলায় জনসংখ্যা বাড়লেও উপকূলের জেলাগুলোতে বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে উল্টো কমে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের জীবনব্যবস্থায় চরম বৈষম্য তৈরি করছে। দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশুরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে উপকূলের শিশুরা সেসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জলবায়ু সমস্যাগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পেছনে বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে উপকূলের শিশুরা অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের হাজার হাজার শিশু রোগগ্রস্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার তাদের শিশু সন্তানদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ খারাপ জেনেও শুধু বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো এসব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে! জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে শহরে পাড়ি জমানো পরিবারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। শহরের বস্তিতে কিংবা রেললাইনে ঠাঁই নেওয়া এসব পরিবারের শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে শিশুরা দোকান, কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিচ্ছে। শহরে এসে অনেকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও জলবায়ু উদ্বাস্তু বেশিরভাগ শিশু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছে হার মেনে বিপথে চলে যাচ্ছে। পিতামাতার হাতে টাকা না থাকলে আর শিশুর পেটে ক্ষুধা থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে। উপকূলের প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থা তো আরও খারাপ। যেখানে জলবায়ু দুর্যোগের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর সাধারণ শিশুদের জীবন অগোছালো সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবনধারণের অবস্থা সহজে অনুমেয়।
বছরের পর বছর মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার সময় এসেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমির এ উপকূলীয় অঞ্চলে ভবিষ্যতের শিশুদের কথা ভেবে হলেও আলাদাভাবে নজর দিতে হবে। জলবায়ু সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের মানুষ এখন উপকূলে থাকতে চাচ্ছে না। আবার শহরে পাড়ি জমানো উপকূলের মানুষ শহরে আসলেই যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে তাও নয়। শহরে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ তৈরি হচ্ছে। দুর্যোগে বিপর্যস্ত উপকূলে সমস্যা ও বৈষম্য এভাবে বাড়তে থাকলে উপকূলীয় জনপদ একসময় জনশূন্য হয়ে পড়বে। দেশের একটি অংশ অর্থাৎ উপকূলীয় শিশুদের টেকসই ও উন্নত জীবন ব্যতিরেকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে এটা ধরে নিয়েই উপকূলীয় জনপদে জীবনব্যবস্থা সাজাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তথা অভিযোজন কর্মসূচির আওতায় বিশেষ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। করোনাকালে এমনিতেই গরিব মানুষের জীবনব্যবস্থায় নৈতিবাচক প্রভাব তার উপর আবার মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জনপদের জীবনধারা বিপর্যস্ত। উপকূলীয় জনপদে জীবনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ও শিশুবান্ধব সহায়ক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও টেকসই পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা, উপকূলের শিশুদের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামীর উন্নত বাংলাদেশ সম্ভব না।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম সুপেয় পানির আধার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির আধার এখন ধুঁকছে। লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে পুরো উপকূলজুড়ে। সুপেয় পানির সংকট ভুগছে উপকূলের শিশুসহ সব বয়সের মানুষ।না।বণাক্ততা ফসল উত্পাদনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পানির প্রবাহজনিত ভারসাম্যতার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থলভাগের দিকে চলে আসে। ফলে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি বৃদ্ধির কারণে লোনাপানি স্থলভাগে প্রবেশ করে। ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে লবণাক্ততাও বাড়বে। সন্দেহ নেই, কম বৃষ্টির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রভাব আরো বেশি মাত্রায় প্রভাব ফেলবে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা জেলায় লবণাক্ততার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এক এলাকার লবণাক্ততা আশপাশের অন্য এলাকায় মাটির ওপরও প্রভাব বিস্তার করছে।
দেশের আবাদি জমির ৩০ ভাগ উপকূলীয় এলাকায়। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, দেশের উপকূলবর্তী প্রায় ৫৩ শতাংশ অঞ্চল লবণাক্ততা দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৮.৬ লাখ হেক্টর উপকূলীয় এলাকার মধ্যে ১০.৫৬ লাখ হেক্টর এলাকা বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ত। লবণাক্ততাসহ জলবায়ুগত বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের মানুষ এলাকা ছাড়ছে। উদ্বাস্তু শিশুরা উপকূল ছেড়ে অন্য স্থানে গেলেও সেখানেও যে বিশুদ্ধ পানিপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে সে নিশ্চয়তা নেই। উপকূলের অধিকাংশ গ্রামে বিশুদ্ধ পানির একমাত্র ভরসা ‘গভীর নলকূপ’ (ডিপ টিউবওয়েল)। গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন গ্রাম পর্যায়ে হাজার হাজার লিটার পানি ওঠানো হচ্ছে। উপকূলের হাজার হাজার গ্রামের প্রায় সব পরিবারে এখন টাকা দিয়ে বিশুদ্ধ পানি কিনতে হচ্ছে। যেসব পরিবার বিশুদ্ধ পানি কিনতে পারছে না তাদের লবণ পানি পান করে জীবন চালাতে হচ্ছে!
লবণ পানি খাওয়া ও স্নান করার কাজে ব্যবহার করায় শিশুদের চর্মরোগ ও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ফুসকুড়ি, খোসপাঁচড়া, চুলকানির মতো সাধারণ সমস্যা লেগেই আছে। লবণ পানি পান করার কারণে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগতে ভুগতে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উপকূলের লবণাক্ত এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে পানি তুলতে তুলতে একটা সময় পানির স্তর স্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাবে। ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়া গেলে তখন উপকূলবাসীর সবার পানি কোত্থেকে আসবে? উপকূলে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তায় এনজিও ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে এলাকায় এলাকায় যে পুকুর ফিল্টার (পিএসএফ) ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলোও ঠিকঠাক কাজ করে না। এগুলো একবার নষ্ট হলে চালু করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।
উপকূলের শিশুদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা লবণাক্ততা। শিশুরা যদি বিশুদ্ধ পানি না পায় তাহলে সুস্থ ও স্বাভাবিক ভবিষ্যত্ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলে লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের তাত্ক্ষণিক কোনো পদ্ধতি নেই। বোধ করি এ সমস্যা বাড়বে নাকি কমবে তা সময়ই বলবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও অভিযোজনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি উপকূলের মিষ্টি পানির জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে গুরুত্ব দিয়ে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত