সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর:সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা এখন আর নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিবছর বর্ষা এলেই শহরের অর্ধেকের বেশি এলাকা পানির নিচে চলে যায়। এবারের চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু পানি, ঘরের ভেতরে কোমরসমান পানি জমে গেছে। রান্নাবান্না, চলাফেরা, স্যানিটেশন-সবকিছুই থমকে গেছে। শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন বাসিন্দারা। কোথাও কেউ ভেলায়, কেউ আবার প্লাস্টিক কক্সশিটে করে শিশু ও মালপত্র নিয়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সাতক্ষীরায় ২৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায়ই হয়েছে ১০২ মিলিমিটার। এই অতিবৃষ্টির কারণে পৌর এলাকার অন্তত ১৫টি এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কামালনগর, ইটাগাছা, পলাশপোল, মধুমোল্লারডাঙি, রাজারবাগান, রসুলপুর, গদাইবিল, রথখোলা, পার-মাছখোলা ও বদ্দিপুর কলোনিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা দিয়েছে পৌরসভার ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে।
তবে শুধু অতিবৃষ্টি নয়, জলাবদ্ধতার জন্য স্থানীয়রা দায়ী করছেন দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা, প্রভাবশালীদের দখল এবং দায়িত্বহীন প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে। শহরের খালগুলোর যথাযথ খনন হয়নি। বরং অনেক জায়গায় কৃত্রিমভাবে খালের পাড় উঁচু করে খননের অভিনয় হয়েছে। প্রকৃত গভীরতা না মানায় খালগুলো পানি নিতে পারছে না। অন্যদিকে, প্রভাবশালী ঘের মালিকরা বিভিন্ন খালের মুখে বাঁধ ও নেটপাটা বসিয়ে মাছ চাষ করছেন, যার ফলে বিল ও খালের পানি নদীতে নামতে পারছে না। উল্টো সেই পানি শহরের ভেতরেই ফিরে আসছে।কুখরালি এলাকার বাসিন্দা ইকরামুল হাসান বলেন, “প্রভাবশালীরা বিলের মুখ বন্ধ করে মাছের ঘের করছে। তাদের মাছ বাঁচাতে গিয়ে আমরা শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছি।” বদ্দিপুর কলোনির গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, “প্রতিবছর এমন হয়। রান্নাঘরে পানি উঠে হাঁড়ি-পাতিল নষ্ট হয়ে গেছে। সাপ-মাকড় ঢুকে ঘুমানো যাচ্ছে না।” এইচএসসি পরীক্ষার্থী আফসানা মিমি বলেন, “পানি কিনে খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন হাঁটু পানি মাড়িয়ে পরীক্ষা দিতে যাই। প্রশাসনের লোকজন শুধু আশ্বাস দেয়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না।”
সমস্যার পেছনে আছে প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং সমন্বয়ের অভাব। সমাজকর্মী সাজেদুল ইসলাম মনে করেন, নদী ও খাল খননের নামে যে কাজগুলো হয়, তার বেশিরভাগই লোক দেখানো। প্রকৃত গভীরতা অনুযায়ী খনন না হওয়ায় এবং খালগুলো দখলমুক্ত না করায় পানি সরে যেতে পারছে না। তিনি বলেন, “পাড় উঁচু করে খালের মুখ বন্ধ করে রেখে খননের নামে টাকা উঠানো হয়েছে। এভাবে জলাবদ্ধতা বাড়বে বই কমবে না।”বিশিষ্ট আইনজীবী ও নাগরিক সংগঠক ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, “প্রতিবছর আমরা একই দৃশ্য দেখি। পৌর কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর ঠিকাদার পালিয়েছে, তাই কাজ হয়নি। মানে হচ্ছে-তদারকি হয়নি। এই দায় আর এড়ানো যাবে না। পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনকে এক টেবিলে বসিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান নিয়ে কথা বলেন ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের সাধারণ সম্পাদক মো. হোসেন আলীও। তিনি বলেন, “খাল-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে। সব প্রাকৃতিক নালা ও খাল পুনঃখনন করতে হবে প্রকৃত গভীরতা অনুযায়ী। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। টেন্ডার ভিত্তিক কাজ নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান দরকার, যেটা প্রতি বছর বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করা হবে নাগরিক ও প্রশাসনের যৌথ নজরদারিতে।”তিনি আরও বলেন, “দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে কোনো উদ্যোগই ফলপ্রসূ হবে না। এবার বাস্তব কাজ ছাড়া সাতক্ষীরাবাসী আর আশ্বাসে ভরসা রাখবে না।”
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ কিলোমিটার খাল ও সেচনালা সংস্কার করা হয়েছে। স্লুইস গেট খুলে দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। প্রাণসায়ের খালে পানি ফেলার সুযোগ তৈরি হলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হবে বলেও জানান তিনি।তবে স্থানীয়দের মতে, এই ধরনের খন্ড খন্ড প্রকল্প বা সময়মতো প্রস্তুতি না থাকায় সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং দরকার একটি সমন্বিত, টেকসই এবং রাজনীতিমুক্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। শহরের প্রতিটি ড্রেনেজ লাইন আধুনিকায়ন, নিয়মিত খাল খনন, প্রকৃত গভীরতা অনুসারে কাজ, সব অবৈধ বাঁধ ও ঘের উচ্ছেদ, স্লুইস গেট সচল রাখা এবং বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ-এই সবকিছু একসঙ্গে বাস্তবায়ন করলেই কেবল সাতক্ষীরাবাসী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে পারে।জলাবদ্ধতা এখন আর শুধুমাত্র বর্ষাকালীন এক মাসের দুর্ভোগ নয়। এটি শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতির ওপর একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাতক্ষীরাবাসী আশ্বাস নয়, এবার বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায়। রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সাতক্ষীরাকে বাঁচানোর সময় এখনই।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত