
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। উপকূলীয় এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ কোন না কোন ভাবে এই বনের ওপর নির্ভরশীল। বছর জুড়ে বনের মধ্যে বয়ে চলা নদ-নদীতে মাছ ধরার বৈধ পাশ, পোনা আহরণ, মাছ ধরে ও শুটকি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে লাখো মানুষ।
প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় উপকূলের মানুষদের। নারী পুরুষের দিনরাত সংগ্রামে জোগাড় হয় দু’মুঠো খাবার। বেশির ভাগেরই জানা নেই তাদের অধিকারের কথা। নোনাজলে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। তার পরও জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনের নদ-নদীতে চিংড়ি রেণু আহরণ করছেন সাতক্ষীরা উপকূলের ১৫-২০ সহস্রাধিক নারী।
কর্মসংস্থানের অভাবে এসব নারী ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা অর্জন করছেন। কখনো বাঘ, আবার কখনো কুমিরের আক্রমণের শিকারও হতে হয় তাদের। তাছাড়া দীর্ঘ সময় লবণ পানিতে থাকায় এসব নারীর জরায়ুসহ শারীরিক অন্যান্য সমস্যাও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সমুদ্রগামী জেলেদের সহযোগিতা করা হলেও সুন্দরবনে জেলেদের সহযোগিতার ব্যবস্থা নেই। তবে সুন্দরবনের জেলেদের ভিজিএফ’এর আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন ও পাশের পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালীনি, মুন্সিগঞ্জ এবং রমজান ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার নারী প্রতিদিন সুন্দরবনের নদ-নদীতে চিংড়ি রেণু সংগ্রহ করেন।
সুন্দরবন সংলগ্ন চকবারা গ্রামের গৃহবধূ আকলিমা খাতুন ও খাদিজা বেগম জানান, বনে বাঘ, জলে কুমির জেনেও উপকূরীয় খোলপেটুয়া নদীতে ৮-১০ বছর ধরে তারা চিংড়ি রেণু আহরণ করে আসছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত নদীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জাল টেনে একেকজন দেড় শত থেকে দুইশত টাকা উপার্জন করেন, যা তাদের সংসারে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
এলাকায় চিংড়ি ঘের হওয়ার কারণে কৃষিকাজ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে উপকূলীয় এলাকার পুরুষরা কাজ হারিয়ে দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছে।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম জানান, সুন্দরবনের উপকূল এলাকার নদ-নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখো মানুষ। গাবুরা ইউনিয়নে কমপক্ষে চার হাজার হতদরিদ্র নারী সুন্দরবনের খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ ও কালিঞ্চি নদীতে চিংড়ি এবং পারশে মাছের রেণু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রেণু পোনা আহরণ করতে গিয়ে অনেকে বাঘ ও কুমিরের আক্রমণের শিকারও হন।
তিনি আরও জানান, জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা কর্মসংস্থানের অভাবে এসব নারী ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা অর্জন করছেন।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ফারহানা আরিফ এই প্রতিবেদককে জানান, দীর্ঘ সময় কোনো নারী যদি নদীর লবণ পানিতে ভিজে থাকেন, তবে তার জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। তাছাড়া অনিয়মিত মাসিক বা জরায়ুর ক্ষত বা শক্ত হয়ে যেতে পারে।
তিনি আরও জানান, এছাড়া অন্যান্য চর্ম বা পানিবাহিত রোগও হতে পারে। মাঝেমধ্যে সুন্দরবন এলাকা থেকে এসব নারী চিকিৎসা নিতে এলে তাদের দীর্ঘক্ষণ নোনা পানিতে না থাকার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।চিংড়ির রেণু পোনা আহরণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। নদীতে ভেসে আসা ‘হোয়াইট গোল্ড’ খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এ উপকূলের মানুষ। তবে রেণু পোনা আহরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ আইনত নিষিদ্ধ জেনেও তারা ধরেন। কেন না, এই পোনা বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চালাতে হয় তাদের। সম্প্রতি উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নদীতে অনেক নারী-পুরুষকে পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানছেন। নদী থেকে উজানে ভেসে আসা বাগদা ও গলদার রেণু পোনা ধরার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ নেট দিয়ে তৈরি করা একধরনের জাল পেতে অপেক্ষা করছেন। কেউ নদী তীরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জাল টেনেই চলেছেন। কেউ আবার নৌকায় বসে মাঝনদীতে জাল পেতেছেন। জালে আটকে পড়া ক্ষুদ্রাকৃতির গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে নদীর চরে রাখা গামলাতে উঠিয়ে রাখছেন। সুন্দরবনের গা ঘেঁষা শ্যামনগর উপজেলার দীপ ইউনিয়ন গাবুরার সোরা গ্রামের বাসিন্দা হামিদ গাজী সেখানে জাল নিয়ে খোলপোটুয়া নদীতে নেমেছিলেন। আলাপকালে তিনি বলেন, এলাকায় অন্য কোনো কাজ না থাকায় রেণু পোনা ধরা আইনত নিষিদ্ধ জেনেও জীবিকার তাগিদে এ কাজ করি আমি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ ধরে যা আয় হয়, তাতেই চাল কিনে কোনোরকমে চলে আমার সংসার। নদী থেকে ধরা চিংড়ির রেণুগুলো খুব ভালো মানের হয়। বড় ঘের ব্যবসায়ীরা সব কিনে নিয়ে যান। খোলপোটুয়া নদীর তীরের ডুমুরিয়া গ্রামের মমতাজ বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু ধরি আমি। এসব ধরে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। শুধু তিনি নন, খোলপোটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের তীরে এমন হাজারো মানুষ চিংড়ির রেণু ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তিনি আরো বলেন, এগুলো বিক্রি করতে বাইরে কোথাও যেতে হয় না। ফুড়িয়ারা (বেপারি) এখান থেকেই কিনে নিয়ে যায়। শ্যামনগর পরিবেশ উন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি আব্দুল হলিম বলেন, উপকূলে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় মাছ শিকারই তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। তাই অবৈধ জেনেও উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ জীবিকার তাগিদে রেণু পোনা ধরা ধরেন। পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সাতক্ষীরা ইউনিটের সমন্বয়ক এস এম শাহিন আলম বলেন, বর্তমানে উপকূলীয় আশাশুনির শ্রীউলা, প্রতাপনগর, আনুলিয়া ও শ্যামনগরের কাশিমাড়ি, কৈখালী, রমজাননগর, মুন্সীগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, আটুলিয়া, পদ্মপুকুর ও গাবুরার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবার রেণু ধরা ও ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। অভাব-অনটনের এ জনপদের মানুষের সচ্ছলতা ফিরে আসার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসব চিংড়ির রেণু।কিছুদিন আগের কথা। উপকূলীয় জেলা খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ আর শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে অনুভব করলাম, রিপোর্ট পড়া বা খবর শোনার সঙ্গে বাস্তবে দেখার কত ফারাক! নিজে না দেখলে বা সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে না শুনলে, এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না। গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। সেই লবণাক্ততাকে কেউ অধিক অর্থ উপার্জনের পথে লাগাচ্ছে, কেউ এটাকে প্রজেক্ট হিসেবে নিয়ে সংস্থার কাজের সুযোগকে চলমান রেখেছে। জোর গলায় কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তা মোকাবিলায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। প্রতিদিন পূর্বদিকে সূর্য ওঠার মতো সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের যে বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। এই পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে, নদী শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ভয়ংকরভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। দুই-একটি নলকূপ, যেখানে খাওয়ার উপযোগী পানি পাওয়া যেত, এখন সেখানেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির জন্য পানি নারীদের সংগ্রহ করতে হয়। পানি-আনা পাত্র নিয়ে পানির জন্য নারীদের দীর্ঘপথ হাঁটতে হয়। বাড়ি ফেরার পথে গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত যেখানে যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। এমন আশ্চর্য কথা শুনলে কিংবা চোখের সামনে দেখলে, শরীর শিউরে ওঠে। শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি দরকার সেই পানি নারীকে সংগ্রহ করতে হয়। ফলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি নারীকেই হতে হয়েছে।
খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলের নারীদের কাছ থেকে জানা গেল, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে তাদের চুল এবং ত্বকের প্রচণ্ড ক্ষতি হচ্ছে। শরীরের রঙ কালো হয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুত বার্ধক্য চলে আসছে। এ ছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা লবণাক্ত পানিতে থাকে। এ কারণে তারা প্রজননসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। লবণাক্ততার কারণে সেখানে ফসল হয় না। কাজের খোঁজে পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা সন্তান ও বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্ব নিয়ে বাড়িতে থেকে যায়। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে নারীর। পুরুষ বাড়িতে না থাকায়, নারীকে তখন ভীষণভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। লবণাক্ত পানির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততাপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। সেজন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা অপারেশন করে শরীর থেকে জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব’ শীর্ষক রিসার্চ রিপোর্টে জানা গেল, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা ঋতুস্রাবের সময় ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে আবারও সেটা ব্যবহার করে। এ ছাড়া লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি। উপকূলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত, ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের জরায়ু কেটে ফেলার পর, অনেকের স্বামী দ্বিতীয় বা ততোধিক বিয়ে করছেন বা স্ত্রীকে ডিভোর্স দিচ্ছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়েছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেড়েছে। এ ছাড়া দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ, গোসল, কৃষিকাজ, গবাদি প্রাণী পালন, চিংড়িপোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীরা সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। মনে হলো, ‘পানিই জীবন’ এই কথাটি আজ যেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের জীবনে বিশেষ করে নারীদের জন্য। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এখন লবণাক্ত পানির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। এই লবণাক্ততা শুধু মাঠের ফসল নষ্ট করছে না, মাটি আর পানির ভারসাম্যও ভেঙে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে নারীদের দেহে আর জীবনে যা কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপার নয়, এটা এখন নারীর জন্য টিকে থাকার সংগ্রামের প্রশ্ন। ৪২ বছর বয়সী শ্যামনগরের ফারজানা বেগমের কথা বলি। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনি চিংড়িপোনা সংগ্রহ করতে লবণাক্ত পানিতে থাকেন। তার চামড়া অদ্ভুতভাবে খসখসে হয়ে গেছে। শুনলাম, তার ইউটেরাসে অনেক দিন ধরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কখনো হাসপাতালে যেতে গিয়ে ‘পয়সা নেই’ বলে আশপাশ থেকে ঘুরে এসেছেন। বাড়িতে জানিয়েছেন হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। কয়রা উপজেলার ৩৫ বছর বয়সের তাজিমায়া। তিনি চেষ্টা করেছেন, দ্বিতীয় সন্তান নিতে। তবে তার প্রথম সন্তান হওয়ার পর বারবার গর্ভপাত হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে এলাকার পানির অতিরিক্ত লবণাক্ততা। গবেষণায় দেখা গেছে, কয়রা অঞ্চলের পানিতে ইলেকট্রিক কন্ডাকটিভিটি এবং টোটাল ডিজলভড সলিডস-এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ। এই মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা তাজিমায়ার প্রজনন অঙ্গের ক্ষতি করেছে এবং তার নিয়মিত মাসিকচক্রকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিয়েছে। ১৫ বছর বয়সের মুক্তা জানাল, ঋতুস্রাবের সময় তারা পুরনো কাপড় ব্যবহার করে। যা লবণাক্ত পানিতে ধোয়ার ফলে প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণ হয়। স্কুলে গিয়ে বাথরুম ব্যবহার করতে ভয় পায়। উপকূলীয় অঞ্চলে ঋতুস্রাবের সময় নোনাজলে পুরনো কাপড় ধুয়ে ব্যবহার করতে গিয়ে সংক্রমণ ও জরায়ুর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অনেক কিশোরী নিজেরাই মাসিক বন্ধ রাখার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খাওয়া শুরু করেছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মাসের পর মাস পিল খেয়ে মাসিক বন্ধ রাখছে তারা যা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নিয়মিতভাবে পিল খাওয়ার ফলে মেয়েদের বন্ধ্যত্বের ঝুঁকিও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
উপকূলীয় নারীর দিন শুরু : সাতক্ষীরার শ্যামনগর কিংবা খুলনার কয়রার যে নারীরা প্রতিদিন ভোরে বাড়ির পেছনের চিংড়ি ঘেরে নামেন, তাদের কাছে ভোর মানেই কাজের শুরু। জোয়ার নামলেই তারা কোমর পানিতে নেমে চিংড়িপোনা ধরতে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দীর্ঘসময় লবণাক্ত পানিতে থাকার ফলে নারীদের ত্বকে ফুসকুড়ি, চুল উঠে যাওয়া, চামড়ায় কালো দাগ, চুলকানি, এমনকি পায়ের গোড়ালিতে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে।
গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব ও জরায়ু ক্যানসার : সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও লবণাক্ত পানির সরাসরি প্রভাব পড়ছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যে। বিভিন্ন গবেষণায় যেমন ‘আইসিডিডিআর,বি’ ও ‘ব্র্যাক’ পরিচালিত স্বাস্থ্য জরিপ) দেখা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের মধ্যে সময়ের আগেই গর্ভপাতের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। পানির উচ্চ লবণাক্ততার ফলে অনেকে সন্তানধারণে ব্যর্থ হচ্ছেন বা গর্ভপাতের শিকার হচ্ছেন। আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো, জরায়ু ক্যানসার। খুলনা অঞ্চলের একাধিক স্বাস্থ্যকর্মী জানিয়েছেন, গত এক দশকে জরায়ুসংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক সময় গোপনীয়তা ও সামাজিক সংকোচের কারণে নারীরা চিকিৎসার জন্যও আসতে পারেন না।
সময়ের আগেই বার্ধক্য : খুলনার পাইকগাছা উপজেলার ৩৮ বছর বয়সী নারী ফাহিমা বেগমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মুখে বলিরেখা, গাল শুকিয়ে গেছে, দাঁতে ব্যথা, শরীরে শক্তি নেই। তিনি বললেন, ‘আগের কালে শরীরী বল ছেলো, বত্তমানকালে হাঁটতিও কষ্ট হয়। চুল পড়ি গেছে, গা-গতরের রঙ মরি গেছে। সারে মুখভরি দাগ। কী হয়িছে তা কিডা জানে, আমি হতো বুঝিনে। ডাক্তার ক’লো পানির জন্যি ইরাম হয়িছে।’ গবেষকরা বলছেন, উচ্চমাত্রার স্যালাইন পানির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সংস্পর্শ শরীরের কোলাজেন নষ্ট করে, যা ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখার জন্য জরুরি। এ ছাড়া সোডিয়াম ক্লোরাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহে বিঘœ ঘটায়। যার ফলে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়ে দ্রুত।
শিশুও ঝুঁকির বাইরে নয় : এ সংকট শুধু নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের সন্তানরাও শারীরিক জটিলতায় ভুগছে। গর্ভাবস্থায় মা লবণাক্ত পানি পান করলে বা সেই পানিতে কাজ করলে তার প্রভাব পড়ে অনাগত শিশুর ওপরে। জন্মের পর শিশুর প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও দুর্বলতা দেখা দেয়। ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের ৪০ শতাংশ শিশু জন্মের পর থেকেই কোনো না কোনো স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছে। যার মূল কারণ হিসেবে পানির লবণাক্ততা দায়ী।
লবণাক্ততা বাড়ছে কেন : বিজ্ঞান বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বারবার ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় নদীতে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে। তার ওপর স্থানীয়ভাবে নিরাপদ পানির উৎস, যেমন পুকুর ও নলকূপও এখন লবণাক্ত হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কোনো সঠিক ব্যবস্থা নেই। ফলে গরমকালে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়।
করণীয় : এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।
পানির বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা : বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ (রেইনওয়াটার হারভেস্টিং) প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পানি নিরাপদকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা।
নারী স্বাস্থ্যসেবা সহজপ্রাপ্য করা : প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিক স্থাপন করা। জরায়ু ক্যানসার স্ক্রিনিং ক্যাম্প আয়োজন করা।
নিরাপদ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ : চিংড়িপোনা ধরা নারীদের জন্য বিকল্প আয়মূলক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা (যেমন ঘরে তৈরি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, বেতের পণ্য ইত্যাদি)।
জলবায়ু অভিযোজনমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : স্থানীয় নারী নেত্রীদের মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল কৃষি, স্বাস্থ্যবিধি এবং পানি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা।
নীতিগত সহায়তা ও বাজেট বরাদ্দ : জাতীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় নারী স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। স্থানীয় সরকারকে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে নারী-কেন্দ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্দেশ দেওয়া। লবণাক্ত পানির ভয়াবহতা কেবল জলবায়ুর সমস্যা নয়, এটা এখন হয়ে উঠেছে নারীর বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এই সমস্যা এখনই মোকাবিলা না করলে নারীরা স্বাস্থ্য, মর্যাদা ও অধিকার হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের কথা তুলে ধরতে হবে বিভিন্ন আলোচনা, গণমাধ্যম, নীতিনির্ধারকদের টেবিলে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ভার সবচেয়ে বেশি বহন করছেন উপকূলের এই সাধারণ নারীরা, যারা নীরবে চিংড়িপোনা ধরছেন, সন্তানকে বাঁচাতে সারাদিন যারা নোনাজলে ডুবে থাকছেন।
বাংলাদেশের উপকূল বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ড। একদিকে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য আর অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশির মিতালি। নির্মল এই ছবির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব অভিশাপ। তার নাম লবণাক্ততা।
সমুদ্রের লোনাজল আজ শুধু পানিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি মিশে গেছে এই অঞ্চলের মানুষের রক্ত, ঘাম আর প্রতিদিনের সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের অগ্রভাগে রয়েছেন অদম্য নারীরা। জলবায়ু পরিবর্তন আর মানবসৃষ্ট সংকটকে সঙ্গী করে তাঁরা কীভাবে টিকে থাকেন, সেই গল্পগাথাই আজ আমাদের উপজীব্য।
আশির দশকে চিংড়িকে ‘ব্লু গোল্ড’ বা ‘সোনালি সম্ভাবনার’ স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রণোদনা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার হাজার হেক্টর ধানখেত রূপান্তরিত হয়েছিল চিংড়ির ঘেরে। রপ্তানি আয় বাড়ার এই লোভনীয় হাতছানিতে লবণাক্ত পানি সচেতনভাবে প্রবেশ করানো হয় মিঠাপানির অঞ্চলে।
স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চক্রের ছত্রচ্ছায়ায় কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন চলতে থাকে। যে জমিতে একসময় সোনার ধান ফলত, তা ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে। এর সামাজিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ক্ষমতা আর অর্থের জোরে কৃষকের জমি দখল হয় এবং একটি ভূমিহীন শ্রেণির জন্ম হয়। এই সামাজিক ভাঙনের প্রথম ও সবচেয়ে বড় শিকার হন নারী ও শিশুরা। যে চিংড়িকে ভাবা হয়েছিল আশীর্বাদ, তা-ই যেন আজ উপকূলের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপের নাম। এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে নারীদের।
উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র অভাব। একটি ওয়াটার ট্যাংক হয়তো একটি গ্রামের পানির চাহিদা মেটাতে পারে, কিন্তু যখন পুরো একটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন হয় সমন্বিত ও বৃহৎ আকারের পরিকল্পনার। যার অভাবে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় নারীদের। কারণ, এখানকার প্রায় সব পরিবারের খাওয়ার পানি নারীদেরই সংগ্রহ করতে হয়।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ফাতেমা বেগমের কথাই ধরা যাক। তাঁর দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। পরিবারের সবাই যখন ঘুমে, তাঁকে ছুটতে হয় নিরাপদ পানির সন্ধানে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে তাঁকে পানি বয়ে আনতে হয়। লবণাক্ততার কারণে গ্রামের বেশির ভাগ নলকূপ আর পুকুর এখন ব্যবহারের অযোগ্য। কাঁখে ভারী কলসি আর পায়ে কাদা মেখে এই পথ পাড়ি দেওয়া তাঁর প্রতিদিনের রুটিন। তাঁর এই যাত্রায় সঙ্গী হয় গ্রামের অন্যান্য বাড়ির নারীরা।
পানি এনেই শেষ নয়, এখানকার অনেক নারীকেই ছুটতে হয় নদীতে অথবা চিংড়ির ঘেরে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোনাপানিতে চিংড়ির পোনা ধরে সেগুলো ঘেরে ছাড়া বা মাছের খাবার দেওয়ার কাজ করতে হয়। পায়ের আঙুলের ফাঁকে লবণাক্ত পানির কারণে ঘা হয় অনেকেরই। এ ছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যা তো লেগেই থাকে। তীব্র যন্ত্রণা হলেও কাজ থামানোর উপায় নেই। কারণ, তাঁদের আয়ের ওপর সংসারের অনেকটা নির্ভর করে। দিন শেষে বাড়ি ফিরে আবার রান্নাবান্না আর সংসারের হাজারো কাজ। নিজের শরীরের দিকে তাকানোর ফুরসতটুকুও তাঁর মেলে না। এই গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রামের ঘটনা নয়, এটিই উপকূলের অনেক গ্রামের হাজারো নারীর প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
উপকূলীয় নারীর জীবন এক অনন্ত সংগ্রামের নাম। দিনের বড় একটি সময় তাঁদের লবণাক্ত পানিতে নেমে কাজ করতে হয়, যা তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। লবণাক্ত পানির আগ্রাসন শুধু মাটির গভীরে নয়, নারীর শরীরের গভীরেও পৌঁছেছে। দীর্ঘক্ষণ লোনাপানিতে কাজ করার ফলে নারীদের মধ্যে চর্মরোগ, খোসপাঁচড়া ও চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো জরায়ুর সংক্রমণ। অপরিষ্কার ও লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে বহু নারী মাসিকের সময় জটিলতায় ভোগেন এবং জরায়ুর ইনফেকশনসহ দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হন। সামাজিক লজ্জা ও দারিদ্র্যের কারণে তাঁরা সহজে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না।
এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপ্রতুলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে একটি নিরাময়যোগ্য রোগও দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই শারীরিক সংকট কেবল নারীদের একার নয়, এটি প্রভাব ফেলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। অসুস্থ মায়েদের সন্তানেরা প্রায়ই অপুষ্টি আর নানা জটিলতা নিয়ে জন্মায়।
তবে উপকূলের এসব নারী শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়ে বসে থাকেননি। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমালে সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে নারীর ওপর, যা তাঁদের জীবনসংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে। তাঁরা এই লবণাক্ততাকে সঙ্গী করেই খুঁজে নিয়েছেন নতুন পথের দিশা। প্রতিকূলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে তাঁরা হয়ে উঠেছেন একেকজন সফল উদ্যোক্তা।
যে লবণাক্ততা তাঁদের ধান চাষ কেড়ে নিয়েছে, সেই লোনাজলেই তাঁরা শুরু করেছেন কাঁকড়া চাষ। পরিবারের পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এসব নারী কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। এর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। ফাতেমার মতো নারীরাও এখন চিংড়ি ঘেরের কাজের পাশাপাশি বাড়ির উঠানে ছোট খাঁচায় কাঁকড়া চাষ করছেন।
এর পাশাপাশি গৃহস্থালির সার্বিক দায়িত্বও তাঁরা সামলান। বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি পালন কিংবা গবাদিপশু চরানো তাঁদের দৈনন্দিন কাজের অংশ। এসব থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে সন্তানের পড়াশোনার খরচ বা পরিবারের ছোটখাটো চাহিদা মেটানো হয়। অনেকে আবার হস্তশিল্পের মতো সৃজনশীল কাজেও নিজেদের যুক্ত করেছেন। নকশিকাঁথা বোনা বা স্থানীয় উপকরণ দিয়ে শোপিস তৈরি করে তাঁরা বাড়তি আয়ের সংস্থান করছেন। এই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তাঁদের শুধু আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে না, পরিবারে তাঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে নারী আগে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারতেন না, তিনিই আজ পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তপ্রণেতা।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকটে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বড় ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। লবণাক্ততা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন ও তা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বিভিন্ন এনজিও নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে সেলাই ও অনেক বিকল্প পেশার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এসব উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় লাখো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া প্রকল্পগুলো অনেক সময়ই সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছায় না অথবা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। নারীদের জন্য নেওয়া প্রশিক্ষণগুলোও অনেক সময় বাজারজাতকরণের অভাবে পুরোপুরি সফল হতে পারে না। ফলে এসব নারীর টিকে থাকতে হয় মূলত নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই
শ্যামনগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন এমন ২৩ হাজার ৫৩৫ জন জেলেকে মৎস্যজীবী কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার নদনদীতে এভাবে অপরিকল্পিতভাবে মাছের পোনা আহরণের ফলে মৎস্য সম্পদ এখন অনেকটা হুমকির মুখে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম এই প্রতিবেদককে জানান, সমুদ্র গামী জেলেদের সহযোগিতা করা হলেও সুন্দরবনে জেলেদের সহযোগিতার ব্যবস্থা নেই। তবে সুন্দরবনের জেলেদের ভিজিএফ’এর আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

