ডেস্ক রিপোর্ট : থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর ফল। দু’পাশে সারি সারি গাছে ধরেছে আঙুর, মাথার উপর বাঁশের মাচায় ঝুলছে সবুজ আঙুর,একেক থোকায় শ-খানেক আঙুর।আঙুর চাষ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এলাকার অনেকেই। তা দেখতে যেমন মানুষ ভিড় করছেন তেমনই আঙুর চাষের পরামর্শ ও চারা সংগ্রহ করছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা।ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নের ঘোপপাড়া গ্রামের ইসলাম বিশ্বাসের ছেলে আলামিনের আঙুরের ক্ষেতের চারপাশে জাল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে সিমেন্টের খুঁটির ওপর বিশেষ সুতায় বোনা জাল বিছিয়ে বান তৈরি করা হয়েছে। যে বান বা মাচাংয়ের ওপর দিয়ে বেয়ে চলে গেছে আঙুর গাছের লতা। সারাক্ষেতে মাচাংয়ে লতিয়ে যাওয়া আঙুর গাছের ডগায় থোকায় থোকায় লাল, সাদা, কালোসহ কয়েকটি রঙের আঙুরের থোকা ঝুলছে।ঝিনাইদহ,কালীগঞ্জ,কোটচাদপুর, মহেশপুর শুর হয়েছে বানিজ্যিক ভাবে আঙ্গুর চাষ। কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৫৯ শতক জমিতে আঙ্গুর চাষ করেছেন। বিশেষ করে তরুণ কৃষি উদ্যাক্তরা আঙ্গুর চাষে রঙিন স্বপ্ন বুনছেন।কালীগঞ্জ কৃষি অফিস জানান,, বনখিদ্দা গ্রামের আবু জাহিদ ১৩ শতাংশ জমিতে, গোমরাইল গ্রামের ১৩ শতাংশ জমিতে ইমদাদুল হক, বড় ঘিঘাটি গ্রামে ১৩ শতাংশ জমিতে নজরুল হক, একই গ্রামের নুরুল ইসলাম ১ বিঘা জমিতে, ২ শতাংশ জমিতে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সাখাওয়াত শেখ, ঘোপপাড়া গ্রামের আল-আমিন হোসেন ৭ শতাংশ জমিতে, একই গ্রামের ইমরান হোসেন ১৭ শতাংশ জমিতে এবং নলভাঙ্গা গ্রামে মমিনুর রহমান ১৩ শতাংশ জমিতেআঙ্গুরচাষকরেছেন।চাষকৃতআঙ্গুরেরক্ষেতগুলোতেএকোলা,বাইকুনুর,জয়সিডলেস,ভ্যালেজ,ব্লাকম্যাজিক,সিলভা,অনুশুকা,মালিকচুমাং,ভাইকিং,অস্ট্রেলিয়াকিং,আর্লিরেড সহ নানা প্রজাতির আঙ্গুরের চারা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে চাষ করছেন এলাকার কৃষকেরা। উপজেলার আঙ্গুর চাষী নুরুল ইসলাম জানান, আমার ৩৩ শতাংশ জমিতে ২৫ মাস আগে ১৬ জাতের আঙ্গুর চারা রোপন করেছি। এপর্যন্ত আমার প্রায় ৬ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এখন ফুল দেখা যাচ্ছে, ভালো বাজার পেলে আশা করছি লাভোবান হবো।চাষি ইমরান হোসেন বলেন, ১৬ শতাংশ জমিতে ৭ প্রকার জাতের ৮০টি আঙ্গুর গাছ আছে আমার বাগানে। ৩১০ টাকা কেজি দরে প্রায় ২০ কেজি আঙ্গুর ইতিমধ্যে তিনি শহরে বিক্রি করেছেন।
উপজেলার মহেশপুরের আব্দুর রশিদ নামের এক কৃষক। তিনি তিন বিঘা জমিতে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ১০ থেকে ১২ জাতের প্রায় ৫০০ গাছ চাষ করছেন। থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা লাল, খয়েরি ও কালো আঙ্গুর দেখতে শত শত দর্শনার্থী তার বাগানে ভিড় করছে। আব্দুর রশিদ ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যুগিহুদা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে।
আব্দুর রশিদের বাগান খেকে চলতি মৌসুমে এক সপ্তাহ হলো আঙ্গুর সংগ্রহ শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ ক্যারেট আঙ্গুর সংগ্রহ করছেন। প্রতি ক্যারেটে ১০ থেকে ১২ কেজি আঙ্গুর থাকে। প্রতি কেজি আঙ্গুর পাইকারী ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা বিক্রি করছেন। স্থানীয়,সিলেট,চট্রগ্রাম ও ঢাকার ব্যাপারীরা ক্ষেতে এসে নিয়ে যাচ্ছেন। সামনে এখনো ১৫ থেকে ২০ দিন একইভাবে আঙ্গুর বিক্রি করা যাবে। সে হিসাবে এবছর তিনি ১৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা আঙ্গুর বিক্রি করতে পারবেন। গেল বছর এই তিন বিঘা জমি থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকার আঙ্গুর বিক্রি করেছিলেন।২০২০ সালে প্রথম ১০ কাঠা জমিতে ছমছম ও সুপার সনিকা জাতের ৭৫ টি আঙ্গুরের গাছ রোপন করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও ইউরোপের ইটালি থেকে এসব চারা সংগ্রহ করেন। বর্তমানে তার তিন বিঘা জমিতে ইতালি ও ইউক্রেনে চাষ হওয়া বাইকুনুর এবং ট্রাসফিগারেশন চিনের ডাসুনিয়া সহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫ শত আঙ্গুরের গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ বছর ফল পাবেন বলে আশা করছেন কৃষক আব্দুর রশিদ। প্রথম আঙ্গুর চাষ করতে বিঘা প্রতি তার ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এ পরিমাণ টাকা চারা ক্রয়, বেড়া দেওয়া, বাগানের উপর নেট দেওয়া ও পরিচর্যার কাজে খরচ হয়। বর্তমানে তার বাগান পরিচর্যা করতে প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আঙ্গুরচাষী আব্দুর রশিদ জানান, বিভিন্ন সময় ইউটিবে কৃষি কাজ সংক্রান্ত অনেক ভিডিও দেখতাম। এছাড়া বিভিন্ন কৃষকদের মাধ্যমে খোজ রাখতাম কোথায় কোন চাষ হচ্ছে। নতুন কিছু মনে হলেই সেখানে ছুটে যেতাম। সেখান থেকে চাষ পদ্ধতি রপ্ত করে নিজে চাষ করতাম।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেতাইদুর্গাপুর গ্রামের আরিফুল ইসলাম। পরীক্ষামূলক ভাবে আঙ্গুরে চাষ করেছেন আরিফুল। ২০২৩ সালে পরীক্ষামূলক ১০টি সবুজ জাতের চারা রোপন করেন তিনি। সফলতা পেয়ে ২০২৪ সালে বাণিজ্যিক ভাবে ১৭ শতক জমিতে আঙ্গুর চাষ শুরু করছেন। অনলাইনের মাধ্যমে ভারত ও চীন থেকে চারা সংগ্রহ করে ১০০ গাছ লাগিয়েছেন। তার বাগানে একুলো, বাইকুনুর, ব্লাক ম্যাজিক, ভেলেজ সিলভাসহ কয়েক জাতের আঙ্গুর গাছ রয়েছে। কোটচাঁদপুর উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামে আঙ্গুর চাষ করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন লিটন মাস্টার। গত দেড় বছর পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুল আলিম ওরফে লিটন মাস্টার ১৭ শতক জমির উপর বাইকুনার, ও একুলা কালো জাতের অষ্টেলিয়ান মিষ্টি আঙ্গুরের চাষ শুরু করেন। ১৭ শতক জমিতে সর্বমোট খরচ হয়েছে ১ লক্ষ টাকা। প্রথম অবস্থায় প্রতি কেজি ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করেছি।এখনো দেড় লক্ষ টাকার আঙ্গুর বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছি।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা আঙ্গুর চাষ করছেন বানিজ্যিব ভাবে।এ জেলার মাটিতে আঙ্গুর চাষ করা সম্ভব। সুস্বাদু আর ফলন ভালো হওয়ায় আশপাশের কৃষকরাও আঙ্গুর আবাদে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আঙ্গুর উৎপাদনে জৈব বালাইনাশক পরামর্শসহ নানা ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সেই সাথে অন্য কৃষকদেরও উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ঝিনাইদহের ৪ উপজেলায় আঙ্গুর চাষে সফল কৃষকরা

Leave a comment