শেখ রাজিয়া নাসের ১৬ নভেম্বর ২০২০ পরলোকগত হয়েছেন। তিনি আমার শহর খুলনার একজন অভিভাবক স্থানীয় মানুষ। আমার জীবনে বুঝতে শেখার পর থেকে প্রায় পৌনে চার দশকের স্মৃতি আছে তাঁকে ঘিরে। আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন ডলিবু’ নামে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চরম দু:সময়ে তিনি অভিভাবকের মত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অনেককে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। সাহস, মনোবল ও আত্মবিশ্বাস গঠনে স্মর্তব্য ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পরিবারের প্রায় সকল সদস্যসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। পনের আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অবস্থানকালে ঘাতকের বুলেটে প্রাণপাত হয় রাজিয়া নাসেরের স্বামী বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ আবু নাসেরের। রাজিয়া নাসের সে মুহূর্তে সন্তান সম্ভবা। জাতির পিতার পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি এ মরণঘাতী আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন ডলিবু’ ও তাঁর সন্তানেরা। তখন চলার মত ব্যবস্থা নেই, প্রায় সকলেই মুখ ফিরিয়ে থাকে, সন্তানদের স্কুলে পড়াশুনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। চরম সঙ্কটের মাঝেও ভেঙ্গে না পড়ে তিনি জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে ব্রতী হয়েছেন। শুধু একা নয় খুলনার বিপণ্ন আওয়ামী লীগারদের সকলকে জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ করার দায়িত্ব নীরবে পালন করেছেন।
আমার আট-নয় বছর বয়সে তাঁর কাছে শুনেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরের পনের আগস্ট জাতির পিতার পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সাথে বত্রিশ নম্বর বাড়িতে শাহাদাৎবরণের পূর্বাপর ঘটনাটি। যা সিনেমাটিক এক ট্রাজেডি। শেখ আবু নাসের ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ যশোহর হয়ে খুলনা যাওয়ার জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দরে চলে আসেন। বিমানে ওঠার অপেক্ষারত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু খবর পাঠিয়ে তাঁকে আবার ফিরে আসতে বলেন আরো কয়েকদিন থেকে যাবার জন্য। স্মৃতি থেকে যতটা মনে করতে পারি ঘটনাটি ছিল এমনই। ঐ রাতেই ঘাতকেরা হত্যাযজ্ঞ চালায় জাতির পিতার ঐতিহাসিক বাড়িতে।
বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) শেখ আমান হাসান ছিলেন ডলি বু’র জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হেলাল উদ্দীন, এমপি’র ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ক্লাসমেট। তাঁর কাছে শোনার সুযোগ হয়েছিল পঁচাত্তরের পনের আগস্ট শেখ হেলালের জন্য কেমন ছিল। ঐ দিন সকালে প্রাত:রাশের পর অন্যদিনের মত ক্লাসে যাবার জন্য একাডেমি ব্লকে না যেয়ে সকল ক্যাডেটকে হাউসে পাঠানো হয়। এরপর ক্লাসে যাবার ঘন্টা আর বাজছিল না। … ঢাকায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জের ধরে তৎকালীন মেডিক্যাল অফিসার দশম শ্রেণির বালক ক্যাডেট হেলালের প্রতি জীঘাংস হয়ে ওঠে। যা প্রিন্সিপল ক্যাপ্টেন অব. করিমুদ্দিন আহমেদ-এর কঠোর হস্তক্ষেপে ঘটতে পারেনি। পনের-ষোল বছরের একজন শিশুকে হত্যার ইচ্ছা দশ বছরের শিশু শেখ রাসেলের বুক বুলেটে বিদীর্ণ হওয়ারই ধারাবাহিকতা ছিল। যশোহরে অবস্থানকারী ঘাতক চক্রের দোসরদের পক্ষ থেকেও চাপ দেয়া হয় ক্যাডেট হেলালকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। অধ্যক্ষ করিমুদ্দিন সেদিন দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমি সকল ছাত্রের কাস্টোডিয়ান। এ অন্যায় আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না। রক্ষা পান শেখ হেলাল। ডলিবু’র পরিবারের ১৯৭৫ পরবর্তী বৈরী অবস্থায় জীবন সংগ্রামের অনেক ঘটনা’র একটিমাত্র হল ক্যাডেট শেখ হেলালকে হত্যাচেষ্টা। এরকম অগণন জীবনঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যাপিত জীবন কেটেছে তাঁর।
ওয়ান ইলেভেনের পরবর্তী দুই বছর আমি মাঝে মধ্যেই ঢাকা ও খুলনায় ডলিবু’র সাথে দেখা করেছি। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাকে বলেন : ‘এখন ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া অসুস্থ, তাই চুপচাপ। সে ভারতে মোরারাজজি দেশাইকে হাইকোর্ট দেখায় ছাড়া লোক। ’ ইন্দিরা গান্ধীর শাসনাবসানের পর (১৯৭৭) মোরারাজজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিদ্বেষবশত: তাঁর পূর্বসূরীর গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি বৈরী হয়ে ভারতে কর্মরত বিদেশী বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর কর্তনের হিসাব তলব করেন। এর জবাবে ছোটখাটো আইনের প্রতিও বরাবরের শ্রদ্ধাশীল ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর প্রদত্ত যথাযথ করের বিপরীতে পাওয়া প্রত্যয়নপত্র সহকারে প্রতিউত্তর করেন।
একবার দেখা হল যখন তিনি সজনে ডাঁটা রান্নার জন্য প্রস্তুত করছিলেন। গুলশান এক’র ভাড়া বাড়িতে। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষ করে ফিরেছেন। সজনে ডাঁটার দিকে দেখিয়ে বললেন সিঙ্গাপুরে দুই-তিনটির প্যাকেট বিক্রি হয় সেদেশীয় এক ডলার দামে। বিদেশে কৃষি পণ্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে কত যে লাভ!
১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম আমলে তাঁর কাছে গল্প শুনেছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাথার কাছে দু’তিনটি ফোন রেখে প্রায় জেগে রাত পার করেন। কখন-কোথায় কী অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। … গঙ্গা-যমুনা নামে তখনকার লেটেস্ট শাড়ি তিনি পছন্দ করেন, পরিধান করেন।
তিনি খুলনার ষষ্ঠ ও সপ্তম দশকের ছাত্র নেতাদের অনেককেই চিনতেন। তাঁদের জন্য রাজনীতি ও সরকারে ভাল কিছু করা বা উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। ১৯৯৪ সালে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে খুলনায় সাবেক ছাত্রনেতা, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের (খুলনা জেলা শাখা) যুগ্ম আহবায়ক মাহাবুবুল আলম হিরণের মনোনয়ন লাভে তাঁর অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল। দলীয় প্রতীকবিহীন সেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেসিসি’র আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীর প্রতীক ছিল চেয়ার।
খুলনার শেরে বাংলা রোডস্থ তাঁদের বাড়িতে ১৯৮৩ কি ’৮৪ সালে খুব নিকট থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে দেখার সুযোগ হয়। আমার মা কবি-সাংবাদিক আক্তার জাহান রুমা’র এক বছরের অগ্রজ-অগ্রজা ছিলেন শহিদ শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৭৮ সালে তাঁদের নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ডলিবু’র সৌজন্যে আমার মা নির্বাসন থেকে সদ্য দেশে ফেরা শেখ হাসিনাকে তাঁদের হারানোর কষ্ট ব্যক্ত ও সমব্যথী হওয়ার সুযোগও সেদিন হয়ত পেয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালেই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আমার মা’র মৃত্যু হয়।
ডলিবু’ দায়িত্ব সচেতন ও শানিত কর্তব্যবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তাঁর এক ফিকে হয়ে আসা সম্পর্কের আত্মীয়া’র মৃত্যু হয় ২০০৬ সালে। পরিবারের কারো-কারো বিরূপতা থাকলেও তিনি তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ-দোয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সব কিছু অগ্রাহ্য করে। আমরা তো বর্তমান ও বিদ্যমান সম্পর্ক দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বেশিরভাগ কাজ করি। কেবলমাত্র ঔচিত্যের বিবেচনায় অনেকটা ঝামেলাপূর্ণ উদ্যোগ নি ক’জনা।
অষ্টম দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত আমার তেমন স্মৃতি নেই। এরপর থেকে আমাদের পরিবারের জন্য তাঁর অবদানের উল্লেখ থেকে অপরাপর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুবর্তী পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধের ধারণা পাওয়া যাবে। আমার পিতা হুমায়ূন কবীর বালু ২০০৪ সালের ২৭ জুন বোমা হামলায় নিহত ও আমি আহত হই। ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য আসার সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটে আসেন। তখনও তাঁর শারীরিক অবস্থা বার্ধক্যজনিত কারণে খুববেশী বাইরে বের হওয়ার মত না। ১৯৯৫ সালে আমার পিতার একটি রোড এক্সিডেন্ট হয়। তিনি একইভাবে তখনো দেখতে আসেন। ১৯৯৯ সালে সংবাদ প্রকাশ করায় একদল বিরূপ হয়ে আমাদের বাড়ি-অফিস ঘেরাও করে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয় সকলকে। তিনি ততদিনে ঢাকায় প্রায় স্থায়ী হয়ে গেছেন। ঢাকা থেকে ফোন করে খোঁজ খবর নেন, সহানুভূতি প্রকাশ করেন। সাহস দেন আমার বাবাকে।
তিনি অত্যন্ত প্রখর রাজনৈতিকবোধ সম্পন্ন, ইতিহাসবেত্তা, ব্যবস্থাপনা দক্ষ, আধুনিক মনস্ক মানুষ ছিলেন। অর্থনীতি ও সমসাময়িক বিষয়জ্ঞান ছিল প্রশংসনীয়। শেষ বয়সেও (আশি উর্দ্ধ) অনেক টেলিফোন ও মোবাইল নম্বর মুখস্থ রাখতে পারতেন। সাল-তারিখ স্মরণ ও স্মৃতিশক্তি ছিল দারুন। তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা খুলনা থেকে ১৯৯৬ সালে চলে গিয়ে ঢাকায় স্থায়ী হন। তখন থেকে এবছর পর্যন্ত সুধা সদন, গুলশান-১, ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে গুলশান-২, এরপর বনানীর সিতারা, জাতিসংঘ রোড, বারিধারায় যেখানে যেখানে থেকেছেন, সবখানেই তাঁর সাথে দেখা করতে গেছি। আমাদের এবং তাঁদের পরিবারের অনেক দু:সময়ে, স্বস্তিদায়ক সময়েও। আওয়ামী লীগ ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে যখন কঠিন বাস্তবতা অতিক্রমণ করতে হচ্ছে তখনও তাঁকে দেখেছি আত্মবিশ্বাসী, আশাবাদী, পরিবর্তনের নিশ্চয়তায় প্রত্যয়ী। আরো পরে তাঁর আত্মবিশ্বাসকেই জয়ী হতে দেখেছি।
তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধও প্রবল। পঁচাত্তর পরবর্তী ক্রান্তিকালে যাঁরাই পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আমৃত্যু স্মরণ রেখেছেন। এ বোধ একইভাবে সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর সন্তানদের মাঝেও। কৃতজ্ঞতা স্বীকারের এই অনুপম গুণটির প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বিষয়টির অনুল্লেখে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
আমার মনে তাঁর বিলাসবহুল নয় অথচ রুচিশীল পরিপাটি খুলনার বাড়িটির ছবি অম্লান রয়ে গেছে। চীনা পোরসেলিনের পটারি, দেয়ালে অস্টিন গাড়ির বিভিন্ন সময়ের পেন্সিল স্কেচ ফ্রেম করা, প্রশস্ত বারান্দা, ফ্লোরে শাদা-কালো ডায়মন্ড কাট মোজাইক নকশা বত্রিশ নম্বরের বারান্দার অনুরূপ। তিনি একটি ইজি চেয়ারে বারান্দায় বসতেন, কথাবার্তা বলতেন। ডলিবু’র বাড়িতে একাধিক সেন্টার টেবিলে শিল্পী রাশার তৈরি জাতির পিতার আবক্ষ ভাস্কর্য সাজানো ছিল। আর বাইরে থেকে আসা পোষা রাজহাঁসের জোর আওয়াজ শোনা যেত। মুরুব্বীরা বলতেন রাজরক্ত যাঁদের, তাঁদের কাছাকাছিই রাজহাঁস এত উচ্চকণ্ঠ হয়। আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে প্রায় অনতিক্রম্য দূরত্বে, তখন পাগলপরা সমর্থকরা এভাবেই নানা লৌকিকতায় মানসিক শক্তি পেয়েছেন।
লেখক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির মিডিয়া স্পেশালিস্ট