ক্রীড়া প্রতিবেদক : দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। ফুটবলে যে দেশে কখনোই সে রকমভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে ফুটবলে কিছু না করতে পারলেও একজন ফুটবলারে মজেছিল পুরো দেশ। সাদাকালো টিভির পর্দায় একজন ফুটবলার জয় করে নিয়েছিলেন ছোট্ট এই দেশটির কোটি মানুষের মন। তিনি ডিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনাকে ৮৬ বিশ্বকাপটা যিনি একাই জিতিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আর্জেন্টিনায় রয়েছে বিশ্বের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি। কিন্তু তবুও বাঙালির চোখে এখনও ম্যারাডোনাই সেরা।
বিশ্ব ফুটবলের কিংবদন্তি ফুটবলার দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার ৬৩তম জন্মদিন আজ। ১৯৬০ সালে ৩০ অক্টোবর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ভক্তদের কাছে ‘এল পিবে দে অরো’ (সোনালি বালক) ডাকনামে পরিচিত ম্যারাডোনা তার খেলোয়াড়ি জীবনের অধিকাংশ সময় আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স এবং নাপোলির হয়ে একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন।
ফুটবলের লম্বা ইতিহাস ম্যারাডোনার গল্পের রচনা শুরু হয়েছিল ১৬ বছর বয়স থেকে। অল্প বয়সেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান নিজের মেধা ও ফুটবল দক্ষতায়। ছোট দৈহিক গড়নের এই বালকের কল্যাণে আর্জেন্টিনা জিতে ১৯৭৯ সালে জাপানে হওয়া যুব বিশ্বকাপ । যেখানে গোল্ডেন বলের খেতাবও উঠেছিল ম্যারাডোনার হাতে। সেদিনই ফুটবল বিশ্ব বুঝে গিয়েছিল তাকে শাসন করতে নতুন এক রাজা আসছে।
মাত্র দুই দশকের পেশাদার ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা খেলেছেন ছয়টি ক্লাবে। ষোল বছর বয়সে পা দেওয়ার ঠিক দশদিন আগে নিজ শহরের ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে অভিষেক ঘটে তার, বর্তমানে যাদের হোম গ্রাউন্ডের নামকরণ হয়েছে ম্যারাডোনারই নামে।
তবে ক্লাব ক্যারিয়ারে বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলিসহ নানা ক্লাবে খেলেছেন তিনি। তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো নাপোলিকে একক কৃতিত্বে চ্যাম্পিয়ন করা। তিনি ক্লাবটির অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে ক্লাবটিকে নিয়ে যান ইতিহাসের সফলতম পর্যায়ে।
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার ম্যারাডোনা মূলত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ারজুড়ে খেললেও মাঝেমধ্যে দ্বিতীয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবেও খেলেছেন। ম্যারাডোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং গণমাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ফুটবলারের অধিনায়কত্বে আর্জেন্টিনা ১৯৮৬’র ফুটবল বিশ্বকাপ জয় লাভ করে। ২০২২ সালের আগে যেটি ছিল আর্জেন্টিনার সর্বশেষ সাফল্য। । সেই আসরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন ‘হ্যান্ড অব গড গোল’ এবং শতাব্দীর সেরা গোলটি। এরপর ১৯৯০ বিশ্বকাপেও দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। তবে সেবার পশ্চিম জার্মানির কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় আর্জেন্টিনার।
এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি আবার আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু অবৈধ মাদক পরীক্ষায় ফেল করার কারণে তাকে আর্জেন্টিনা ফিরে যেতে হয়।
তার জীবনের পরের দিকে ম্যারাডোনা মাদকে আসক্তি নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এবং ১৯৯১ সালে তার শরীরের মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়লে তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরলেও স্বাভাবিক ছন্দে দেখা যায়নি ম্যারাডোনাকে। ১৯৭৭ সালে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের পর ক্লাব ও জাতীয় দল মিলে আর্জেন্টাইন মহাতারকা ক্যারিয়ারে মোট গোল করেছেন ৩৪৬টি। তার ৩৭তম জন্মদিনে ১৯৯৭ সালে তিনি পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেন। সেসময় তিনি আর্জেন্টিনার বড় দল বোকা জুনিয়ার্সে খেলছিলেন।
২০০৮ সালে ম্যারাডোনা জাতীয় দলের প্রধান কোচ হন। তবে ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে হেরে আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নেয়। ব্যর্থ বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার কোচের পদ থেকে অবসর নেন ম্যারাডোনা। তবে ক্যারিয়ারের একটা বড় সময়জুড়ে তিনি মাদকের সমস্যা নিয়ে ভুগেছেন।
ফুটবল বিশ্বের অনন্য এই জাদুকরের মৃত্যু ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর। ম্যারাডোনা হয়তো এখন জীবিত নেই। তার মৃত্যুর পরেই নাপোলি শিরোপা জিতেছে, আর্জেন্টিনা জিতেছে বিশ্বকাপ। ম্যারাডোনা তার জীবদ্দশায় সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পারেননি। জন্মদিনে এটিই হয়তো আর্জেন্টিনার ভক্তদের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।