শেখ মাহতাব হোসেন, ডুমুরিয়া : ডুমুরিয়া (খুলনা )বিগত শতাব্দীর ৯০ দশকে এলাকায় জলাবদ্ধতার সূত্রপাত ঘটে এবং ২০০০ সালের পর থেকে এ সমস্যা স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়। জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো পলি দ্বারা নদী ভরাট হয়ে যাওয়া। জোয়ারের প্রান্ত সীমা থেকে নদী ভরাট হতে হতে তা ক্রমশঃ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে প্রতি বৎসর নদীতে ৪-৫ ফুট পলি জমা হয় এবং ৫-৬ কিঃমিঃ নদী মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। নদীর মৃত্যু হলে সে সব জায়গায় জোয়ার উঠতে পারে না, মৃত নদী কচুরিপনা, শ্যাওলা ও আগাছায় পূর্ণ হয়ে যায় এবং নদীতে নৌ চলাচল করতে পারে না।
জলাবদ্ধতার তীব্রতা কি পরিমাণ হবে সেটা নির্ভর করে মূলতঃ বৃষ্টিপাতের উপর। এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেই বসতি এলাকা প্লাবিত হয়ে যায় এবং প্রায় ৩-৪ মাস যাবত বসতি এলাকা জলমগ্ন থাকে। বিল এলাকায় পানি থাকে ৬-৯ মাস, এমনকি বিলের অনেক অংশ সারা বৎসর জলমগ্ন থাকে। এলাকায় নীচু ধরণের যেসব বসতি এলাকা আছে সেইসব এলাকায় সাধারণতঃ দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর মানুষেরা বসবাস করে। এসব এলাকার অবস্থান হয় বিলকিনারে নতুবা বিলের মধ্যে। বিল উপচিয়ে প্রথমেই এই সব এলাকায় পানি উঠে। দরিদ্র মানুষদের ঘরবাড়ী নড়বড়ে যা প্লাবিত হলে সহজে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বাড়ীঘরে পানি উঠলে বসবাসে বড় ধরণের সমস্যার সৃষ্টি হয়। হাঁস-মুরগী, গবাদি পশু পালন এবং চলাচলের সমস্যা, নলকূপ, ল্যাট্রিন পানিতে ভেসে একাকার হয়ে যায়, দেখা দেয় পানি বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। আছে সর্পভীতি, পানিতে শিশু ডুবে মরার আশংকা, খাদ্য সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব।
জলাবদ্ধতা প্রতি বৎসরের ঘটনা হওয়ায় দরিদ্র মানুষদের বিক্রী করার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নাই। এসব মানুষদের কেউ ধার দেনাও দিতে চায় না। ফলে বহু মানুষের স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে বাড়ীঘর ছেড়ে উঁচু কোন রাস্তায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শহর-বন্দর-বস্তিতে যেয়ে আশ্রয় নেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। প্রতিবৎসরই স্থানান্তরিত হওয়ার এ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলাবদ্ধতায় এলাকার প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। জলাবদ্ধতার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য জমির মালিকরা নিজে অথবা লীজ দিয়ে এলাকায় মাছ চাষের প্রচলন ঘটিয়েছে। কিন্তু অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভাইরাস সহ অজ্ঞাত রোগব্যাধি, নদী থেকে পানি প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে মাছ চাষও ঝুঁকিপূর্ণ এবং অলাভজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে অনেক জায়গায় পানি সেচে বোরো চাষাবাদ করা হয়। এটিও ব্যয়বহুল, দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষীর পক্ষে উৎপাদন খরচ জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ে।একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোন এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীবর্নৈা সেই এলাকার ভূ-প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠে। কোন কারণে ভূ-প্রকৃতির ও টিউ ঘটলে এলাকার উৎপাদন প্রণালী ও জীববৈচিত্র্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের এ এলাকায় ভূ-প্রকৃতির প্রধান ৪টি উপাদান হলো এলাকার জনপদ, বিল-খাল, নদ-নদী এবং দক্ষিণে অবস্থিত সুন্দরবন।
জনপদের বসতি এলাকা প্লাবিত হলে অনেক গাছপালা মারা যায় বা বিপন্ন হয়ে পড়ে। খাল বিল দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ থাকলে পানি দূষিত হয়ে যায়, পানি বাহিত রোগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ এই দূষিত পরিবেশে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এলাকার বিল-খাল এখন মাছ চাষের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে বিলে খালে যে প্রাকৃতিক মাছ ও উদ্ভিদ জন্মাতো বা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের যে বিচরণ ছিল তা এখন আর নাই। বিল মাছ যেমন কৈ, শিং, মাগুর, শোল, বোয়াল, চ্যাং, বালে প্রভৃতি মাছ এখন আর খাল বিলে তেমন একটা দেখা যায় না। বিলে জন্মাতো হোগলা, পাতি, শাপলা, শালুক, কলমি বা চেচো, বাজো, ভোেতড় প্রভৃতি ঘাস তা আর জন্মানোর সুযোগ নাই। দেখা যায় না পাখীদের বিচরণ বা উভচর প্রাণির চলাফেরা। নদীতীরে জন্মাতো ওড়া, কেওড়া, হরগোজা, গোলপাতা প্রভৃতি গাছপালা। নদীতে ছিল মাছের প্রাচুর্য্যতা, দেখা যেতো হাঙ্গর, কুমির, শুশুক, ডলফিন, ছাতিম, কচ্ছপ বা মৎস্য শিকারী অসংখ্য পাখিদের বিচরণ। চলতো রঙ বেরঙের পাল তোলা অসংখ্য নৌকা, কোন কোন নদীতে লঞ্চ বা স্টিমার। এসবই এখন কেবলমাত্র স্মৃতি।