
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সাতক্ষীরায় টানা ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এতে জেলার পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও মৎস্য চাষিরা।
মঙ্গলবার(১৫ জুলাই) ভোর থেকে শুরু হওয়া বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে বিল, খাল, পুকুর ও রাস্তাঘাট। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষক।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত জেলায় ১৫৫
মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪ জুলাই— ২২৯ মিলিমিটার।
অফিসটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, সাগরে লঘুচাপের কারণে গত কয়েকদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সোমবার থেকে বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে জুলাইজুড়েই বৃষ্টিপাতের প্রবণতা থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেন, চলমান বর্ষণে সাতক্ষীরায় এখন পর্যন্ত মোট ২৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবারও বজ্রসহ মাঝারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
পৌরসভার কামালনগর, রাজারবাগান, গদাইবিল, বদ্দিপুর কলোনি, মুনজিতপুর, কাটিয়া, গড়েরকান্দা, ইটাগাছা সরেজমিনে ঘুরে দেখে গেছে, অধিকাংশ মানুষের বাড়ির উঠানে পানি, অনেক ঘরের মধ্যেও পানি প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার আলিপুর, কাশেমপুর, বকচরা, বালিয়াডাঙ্গা, বাবুলিয়াসহ ১৪ ইউনিয়নের এসব অঞ্চলের বহু পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ায় অনেকেই মাচান বানিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।
কলাগাছের ভেলায় চলাফেরা করতে দেখা গেছে কিছু পরিবারকে। পানিবন্দি পরিবারগুলোতে রান্নাবান্না বন্ধ রয়েছে। চুলায় আগুন জ্বালানো তো দূরের কথা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন তারা।
টানা বর্ষণে জেলার আমনের বীজতলা, আউশ ধান ও সবজিক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে বহু মাছের ঘের।
সাতক্ষীরা পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে দেখা দিয়েছে চরম জলাবদ্ধতা। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমরসমান। ফলে স্থানীয়দের চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার কামালনগর এলাকার বাসিন্দা শরিফা বেগম বলেন, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শ্যামনগর থেকে সাতক্ষীরা শহরে এসে বাস করছি। কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই, প্রতিবছর বৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে পানি ওঠে। আমাদের এলাকা কমপক্ষে ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে।
টানা বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে জেলার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ। শত শত পুকুর ও চিংড়ি ঘের একাকার হয়ে গেছে।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালীনি এলাকার মৎস্য চাষি গোলাম হোসেন বলেন, এ বছর আমি দুটি পুকুরে রুই, কাতলা ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করেছিলাম। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পুকুর ডুবে গিয়ে সব মাছ হয়তো ভেসে গেছে।
মৎস্য চাষিদের দাবি, খাল-নদীর সঙ্গে পুকুরের সংযোগ হয়ে বহু পুকুর ও ঘেরের সীমানা হারিয়ে গেছে। ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ভেসে গিয়ে কয়েক লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক মাধব চন্দ্র দত্ত বলেন, সোমবার ভোর থেকে নতুন করে আবার শুরু হওয়া বর্ষণে সাতক্ষীরা শহরতলীর নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এতে পানিতে তলিয়ে গেছে বিল, খাল, পুকুর ও রাস্তাঘাট। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকরা। জলাবদ্ধতা আমাদের একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। আমরা স্থায়ী সমাধান চাই।
প্রশাসনের উদ্যোগ
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইস গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ কিলোমিটার খাল ও সেচনালা সংস্কার করা হয়েছে।
কৃষিতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ১৬২ হেক্টর আউশ, আমন বীজতলা ১০৬ হেক্টর, ৪৪ হেক্টর শাক সবজির ক্ষতি হয়েছে। এতে টাকার অঙ্কে দেড় কোটির টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। সদর ছাড়া বাকি ছয় উপজেলায় আমাদের ভালো ফলন হবে হবে। আশা করছি, আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।সাতক্ষীরা, ২জুলাই থেকে টানা ১৫ দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডসহ সদর, তালা, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার নিম্নাঞ্চলের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।
এদিকে আমনের বীজতলা, আউশ ধান ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য মৎস্য ঘের। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেননি মৎস্য ও কৃষি বিভাগ।
এছাড়াও শহরের আশপাশের প্রায় শতাধিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিশেষ করে চলমান এইচএসসি ও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বিপাকে পড়েছেন।
এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিকল্পিত নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ দোকানপাট, বসতবাড়ি, রান্নাঘর, বাড়ির আঙিনা ও রাস্তাঘাটে পানি জমে আছে। ডুবে গেছে টিউবওয়েল। সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থাও। চরম দুর্ভোগে রয়েছে এলাকাবাসী।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, গত ১০ দিনে সাতক্ষীরায় ৩৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যার মধ্যে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ মিলিমিটার। আজ বৃষ্টির পরিমাণ কিছুটা কমলেও এ মাস জুড়েই বৃষ্টিপাত হবে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের কামালনগর, ইটাগাছা, বাঁকাল, বারুইপাড়া, পলাশপোল, মধুমোল্লার ডাঙি, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, বদ্দিপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, রথখোলা, রাজারবাগান, গদাইবিল, মাঠপাড়া, পার-মাছখোলা ও পুরাতন সাতক্ষীরার মতো নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা পৌরসভার ৬, ৭ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের।
ইটাগাছা বিলপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হাসান বলেন, ঘের মালিকরা বিলে পানি আটকে রেখেছে। বাইপাসের স্লুইস গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি খাল দিয়ে নদীতে নামতে পারছে না। ফলে রাস্তাঘাট ও বাড়িসহ সবখানে পানি।
বদ্দিপুর কলোনির গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, ১০ বছর ধরে এমন জলাবদ্ধতায় ভুগছি। কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এবার রান্নাঘরে পানি ঢুকে হাঁড়ি-পাতিল নষ্ট হয়ে গেছে। সাপ, পোকামাকড় ঘরে ঢোকায় রাতে ঘুমাতে পারছি না। সন্তানদের নিয়ে নিরাপদ জায়গায় থাকতে হচ্ছে।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ লাইন। পুলিশ লাইনের প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে রিজার্ভ অফিসের সামনের রাস্তা, ব্যারাক সংলগ্ন রাস্তা, অস্ত্রাগার আঙিনা এবং রেশন স্টোরের আঙিনায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বাসসকে বলেন, সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ লাইনে টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। পানি জমে থাকায় সেবা প্রত্যাশীদের অফিসে আসতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া পুলিশ সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নোংরা পানিতে চলাফেরার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়তে হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ব্যাপারে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ যেন এক জলাশয়। কলেজে প্রবেশ করতেই কাদামাটি ও পচা পানির গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয়। শিক্ষার্থীরা জানায়, প্রতিদিন ভেজা জামা-কাপড় পরে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। মনে হয়, নদী পার হচ্ছি।
পাটকেলঘাটা আমিরুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কালীগঞ্জের মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ স্কুল, বদ্দিপুর প্রাইমারি স্কুলসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ভেলা, বাঁশ বা জুতা হাতে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। স্কুল মাঠগুলোতেও জমেছে পচা পানি। এর মধ্যেই বিদ্যায়লয়গুলোতে চলছে অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা।
কালীগঞ্জের মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত বৈদ্য জানান, জলাবদ্ধতার কারণে বিদ্যালয়ের আঙিনায় হাঁটাচলা করাই দায়। শিক্ষার্থীরা অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দিচ্ছে।
অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই দুর্যোগের মধ্যে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা থাকায় স্কুল কামাই করতেও পারছে না। শিশুরা ঠান্ডা ও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শহরতলির উত্তর কাটিয়া, ইটাগাছা, কুখরালি, ব্রহ্মরাজপুর, ঝাউডাঙ্গা, ফিংড়ি, আগরদাঁড়ি, বাঁকাল এবং তালতলা এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের এক শিক্ষক বলেন, প্রতি বছর এমন হয়, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। কলেজের ভেতরেও কোনো ড্রেন নেই। তাই প্রতিবছরই বর্ষায় আমরা পানিবন্দি অবস্থায় থাকি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মনির হোসেন জানান, এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন বীজতলা, আউশ ধান ও সবজির ক্ষেত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন বীজতলা, বরবটি, সিম, শসাসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত। ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। পানি নামলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করা সম্ভব হবে। এর জন্য কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ জানান, অতিবৃষ্টির কারণে গত কয়েক বছর ধরে সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।। পানি নিষ্কাশনের জন্য গত বৃহস্পতিবার ইটাগাছা বিলে গিয়ে ঘের মালিকদের তিন দিনের মধ্যে অবৈধ নেটপাটা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। জলবদ্ধতা নিরসনে সাতক্ষীরার খালগুলো খনন করা হয়েছে। শহরের প্রাণ সাহের খাল, বেতনা নদী ও কুঞ্জুর স্লুইসগেট খুলে দেওয়া হয়েছে।
আশা করা যায় বিকেলের মধ্যে জলাবদ্ধ এলাকার পানি প্রাণ সায়ের খাল দিয়ে বেতনা নদীতে পড়বে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, শুধু উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে জলাবদ্ধতার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয়দের অংশগ্রহণে বাঁধ নির্মাণসহ সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।