ক্রীড়া প্রতিবেদক : কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় গ্যালারিতে বসে সারাক্ষণ বাংলাদেশের ফুটবলারদের উৎসাহ দিয়ে গেল এক দল স্কুল ছাত্র-ছাত্রী। তাদের কন্ঠে মিছিল, “উই লাভ বাংলাদেশ’, উই লাভ বাংলাদেশ”। সাবিনা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমার পায়ে যখনই বল পড়েছে তাদের কন্ঠের আওয়াজ যেন হিমালয় ছুঁতে চেয়েছে।
কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মোটেও হতাশ করেনি বাংলাদেশ। রবিবার সাফের সেমিফাইনালে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়েছিল ভুটানের। কি অসাধারণ মিল! যেন সেই একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন। সেই একই মাঠ। দুই বছর আগের সেমিফাইনালই যেন ফিরিয়ে আনল বাংলাদেশ। সেবার হারিয়েছিল ৮-০ গোলে। এবার ভুটানকে ৭-১ গোলে হারিয়ে সাবিনা, স্বপ্নারা উঠে গেল স্বপ্নের ফাইনালে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফের ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে তৃতীয়বার উঠল সাফের ফাইনালে।
ভুটানের রক্ষণে সারাক্ষণ এ দিন ত্রাস ছড়িয়েছেন ময়মনসিংহের মেসি তহুরা। এই ম্যাচে তিনি হ্যাটট্রিক করেছেন। জোড়া গোল করেছেন সাবিনা। ১টি করে গোল ঋতুপর্ণা চাকমা ও শিউলি আজিমের। ভুটানের একমাত্র গোলটি দেকি লাজমের। সিনিয়র সাফে এটাই তহুরার প্রথম হ্যাটট্রিক। জাতীয় ও বয়সভিত্তিক মিলিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে তহুরার গোল হলো ৫৪ টি।
আগামী ৩০ অক্টোবর ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল ও ভারতের মধ্যকার য়ী দল।
এবারের টুর্নামেন্টে ভুটান বদলে যাওয়া এক দল হয়ে নেপাল এসেছে। সাফের পাঁচবারের রানার্স আপ নেপালকে প্রথম ম্যাচেই রুখে দেয় তারা। নেপালের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে ভুটান। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে ৪-১ গোলে। এরপর মালদ্বীপের জালে ১৩ গোল দেয়।
যতোই গতবার ভুটানকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিক না কেন মোটেও তাদের হালকাভাবে নেয়নি বাংলাদেশ। শনিবার শেষ অনুশীলনেও মারিয়া মান্দা একই কথা বলেছিলেন। নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলেন।
ভুটান বরাবরই শারীরিক গড়ন ও স্কিলে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। টিকিটাকা ফুটবলে অভ্যস্ত সাবিনাদের কাছে এবারও পাত্তা পায়নি ভুটান।
বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডরা যতোবার ভুটানের রক্ষণে ঢুকেছেন, ততবারই যেন আতঙ্কে থেকেছেন ভুটানের গোলরক্ষক।
ভারতের বিপক্ষে আগের ম্যাচে মাত্র একটাই পরিবর্তন আনেন এদিন কোচ পিটার বাটলার। বা পায়ে ব্যাথা পাওয়া শামসুন্নাহার জুনিয়রের বদলে একাদশে ঢোকান মোসাম্মৎ সাগরিকাকে। যে সাগরিকা ভুটানের বিপক্ষে গত জুলাইয়ে থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে অভিষেকে হ্যাটট্রিক করেছিলেন।
রক্ষণে বাংলাদেশের আফঈদা খন্দকার, মাসুরা পারভীন, শামসুন্নাহারা সিনিয়ররা ছিলেন চীনের দেওয়াল। কখনও কখনও রক্ষণ সামলে আক্রমণেও উঠেছেন তারা।
তবে এই ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকর ফুটবলার ছিলেন ঋতুপর্ণা চাকমা। বামপ্রান্ত দিয়ে বারবার ভুটানের রক্ষণে ঢুকেছেন। এবং বিপদে ফেলেছেন ভুটানি ডিফেন্ডারদের।
ম্যাচের ৭ মিনিটে তার প্রথম গোল সেই আক্রমণেরই ফল। তহুরা খাতুনের বাড়িয়ে দেওয়া বলে ঋতুপর্ণা দুর্দান্ত শট নিলেন। বলটি ভুটানের গোলরক্ষক সঙ্গীতা মঙ্গারের মাথার ওপর দিয়ে ঢুকল জালে (১-০)। মিনিটখানেক পরই আরেকটি গোল হতে পারতো বাংলাদেশের। কিন্তু সাগরিকার হেড এবার গোললাইন ক্লিয়ার করেন ভুটানের ডিফেন্ডার দর্জি দন।
কিন্তু এর পর থেকেই বাংলাদেশের মেয়েদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে বাংলাদে। ম্যাচের ২৫ মিনিটে সাবিনা নিজের প্রথম গোল পেতে পারতেন এবারের সাফে। অথচ টুর্নামেন্টের গত আসরের গোল্ডেন বুট পুরস্কার জেতা (৮ গোল) সাবিনার শট সাইড পোস্টে লেগে ফেরে। অবশ্য ঠিক পরের মিনিটেই মনিকার ক্রস থেকে প্লেসিংয়ে সাবিনা খাতুন করেন ৩-০। পেয়ে যান নিজের প্রথম গোল।
ম্যাচের ৩৫ মিনিটে তহুরার গোলটি ছিল দেখার মতো। মারিয়া মান্দার বাড়িয়ে দেওয়া বলটি তহুরা বক্সের সামনে নামিয়ে নেন। এরপর শরীর বাঁকিয়ে বাঁ পায়ে নেন দারুণ শট। ভুটানের গোলরক্ষক শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তার মাথার ওপর দিয়ে বল ঢুকল জালে (৪-০)।
পঞ্চম গোলটি বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৭ মিনিটে। শুরুতে এক ডিফেন্ডারকে কাটান তিনি। এরপর ভুটানের আগুয়ান গোলরক্ষককে কাটিয়ে আস্তে করে বল পাঠান জালে। এরপর দুই দিকে দু হাত প্রসারিত করে উদযাপন করেন গোলের।
গত দুদিন ধরে তাকে নিয়ে যেসব গুঞ্জন, কোচের সঙ্গে যে দূরত্ব- এসবেরও যেন পরোক্ষে জবাব দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
ভুটান অবশ্য গোল শোধের চেষ্টা করে গেছে সারাক্ষণ। এরপর ৪২ মিনিটে একটি গোলও পরিশোধ করেন দেকি লাজন। ব্যাক পাস থেকে আসা বল আফঈদা ক্লিয়ার করতে পারেরনি। সুযোগে গোল করেন লাজন। এই গোলের সুবাদে সাফের গোল্ডেন বুট জেতার দৌড়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। বর্তমানে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৮ গোল এই স্ট্রাইকারের।
দ্বিতীয়ার্ধেও বাংলাদেশের মেয়েরা একই ছন্দে ফুটবল খেলেছে। যে কারণে ম্যাচের ৫৮ মিনিটে সাফে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক পেলেন তহুরা। কর্ণার থেকে উড়ে আসা বলে শিউলি করেন সপ্তম গোলটি করেন ম্যাচের ৭২ মিনিটে। বাকি সময়ে বেশ কয়েকজনকে বদলি নামিয়েছেন বাটলার। কিন্তু স্কোর লাইনে কোনও বদল আসেনি।