
গাজী জাহিদুর রহমান, তালা : তালা উপজেলার এক সময়ের প্রাচীনতম মাদুর শিল্প বিলুপ্ত হতে চলেছে। কাঁচামাল সংকট এবং বাজারে কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলার ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পটি অচিরেই বিলুপ্ত হতে চললেও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে সুনীল মন্ডল নামের এক ব্যক্তির। যিনি প্রায় ৭০ বছর ধরে তালা উপজেলা জুড়ে মাদুর বিক্রি করছেন। সুনীল মন্ডল তালা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামের স্বর্গীয় হরেন মন্ডলের পুত্র।
সুনীল মন্ডল যুবক বয়স থেকেই উপজেলার জুড়ে মাদুর বিক্রি করছেন। অত্র এলাকার বহু বছরের পুরনো মাদুর শিল্প। এ অঞ্চলের ২০০ থেকে ৩০০ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিলো এ মাদুর শিল্প। কিন্তু কাঁচামাল সংকটের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় মাদুর শিল্প বর্তমানে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কালের বির্বতনে সেই প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এই কুটির শিল্পটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখনও মাদুর শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে মাদরা গ্রামটিতে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মাত্র দুই-একটি পরিবার। তাদের মধ্য অন্যতম হলেন সুনীল মন্ডল।
তথ্যমতে, এখনও গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে অতিথি এলে মাদুর পেতে বসতে দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। তবে শহরে ধনী পরিবারেও অনেক সময় কারুকার্যশোভিত মাদুরের দেখা মেলে। মেলের তৈরী মাদুর গরমে দিনে আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যসম্মত। তীব্র গরমে শীরের ঘাম শুষে মাদুর দেহ শীতল করে। আর গ্রামের অতিথিরা মাদুরে শুয়ে প্রকৃতির হাওয়ার আরামদায়ক ঘুম উপভোগ করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাদুর শিল্পে ভাঁটা পড়ে। মাদুর শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল মেলে একসময় পতিত জমিতে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে মেলের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মেলে জন্মে ছোট ছোট জলাশয়ে, খাল বিলে এবং নদীর চরে। বর্তমানে যে মেলে পাওয়া যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এছাড়াও প্লাস্টিক শিল্পের বিপ্লব, প্রয়োজনী উপকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বিলুপ্ত হতে চলেছে মেলের তৈরী মাদুর।
মাদরা গ্রামের প্রায় শত বছর বয়সী সুনীল মন্ডল জানান, ‘ আমাদের গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের নারী-পুরুষ মাদুর বুননের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। কিন্তু এখন আর তেমন কেউ মাদুর তৈরি কিংবা বিক্রি করে না। আমি প্রায় ৭০ বছর ধরে মাদুর বিক্রি করি। আমার ২ পুত্র সন্তান ও ১ কন্যা সন্তান আছে। বড় ছেলে ব্যবসা ও ছোট ছেলে মাছ চাষ করে।’
আপনি এখনো কেন মাদুর বিক্রি করেন এমন প্রশ্ন করা হলে সুনীল মন্ডল বলেন, এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। ইচ্ছা হলেও ছাড়তে পারি না। তাই সকাল হলে মাদরা গ্রাম থেকে প্রায় ৭-৮ কিঃমিঃ রাস্তা পাড়ি দিয়ে তালা বাজারে হেটে আসি। যদি মাদুর বিক্রি হয় ভালো, না হলে আবার বাড়ি ফিরে যায়।
অন্যরা কেন মাদুর বিক্রয় ছেড়ে দিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও প্রতি কাউন মেলের দাম ছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। ফলে এক জোড়া মাঝারি ধরণের মাদুর উৎপাদনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ বাজারে এ মাদুরের প্রতি জোড়ার পাইকারি দাম ৮০০ টাকা। এতে এক জোড়া মাদুরে ২০ থেকে ৩০ টাকার বেশি লাভ থাকছে না। ফলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আধুনিক প্লাষ্টিক শিল্পের আধিক্যে চাহিদা কম অন্যদিকে একটি মাদুর তৈরিতে যে পরিমাণ খরচ হয় বাজারে ঠিক সে পরিমাণ দাম পাওয়া যায় না। তাই এ ব্যবসা আর কেউ করতে চায় না।
নিহার রঞ্জন, পরিমল কুমার, দীনেশ কুমার মন্ডলসহ এলাকার কয়েকজন বলেন, প্রায় ২শত বছর পূর্বে আমাদের দাদা তার দাদা এই মাদুর শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের বাবা-দাদুরাও এই পেশায় জড়িত ছিলেন। বর্তমানে মাদুর তৈরী করতে মেলের দাম আকাশ ছোঁয়া। তাই কাঁচামাল সংকট এবং বাজারে কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় প্রাচীনতম মাদুর শিল্প বিলুপ্ত হতে চলেছে। সরকার যদি ভর্তুকি প্রদান পূর্বক শিল্পটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে তাহলে অনেকেই এই পেশায় পুনরায় ফিরে আসতেন বলে জানান তারা।
তালা উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি অফিসার শুভ্রাংশু শেখর দাশ বলেন, মেলেচাষ কিংবা মাদুর তৈরির জন্য কোন ভর্তুকি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রদান করা হয় না।