গাজী জাহিদুর রহমান, তালা : কপোতাক্ষ নদ অববাহিকায় তালা উপজেলার পাখিমারা বিলের শত শত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক দীর্ঘ ৮ বছরেও ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। এছাড়া পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কার ও টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু না হওয়ায় ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারের প্রায় ৮শ’ কোটি টাকার কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্প। বিগত ৮ বছরে পাখিমারা টিআরএম বিলে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪৬ কোটি ৬৬ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৪৮ টাকা বকেয়া রয়েছে। ক্ষতিপূরণের টাকা কৃষকদের পরিশোধ না করায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকার কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পের মধ্যে পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাখিমারা বিলের কৃষকদের ১৫৬২ একর জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই বছরের জন্য ১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অদ্যাবধি কোনও কৃষক তা পায়নি। এমনকি টিআরএম চালুও হয়নি। ফলে টিআরএমভুক্ত বিলের জমি মালিকরা তাদের জমি নিজেদের দখলে নিয়ে সেখানে এখন ধান ও মাছ চাষ করছে। ২য় পর্যায়ের জনগণের পক্ষ থেকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়টি ইতিমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, কপোতাক্ষ নদ অববাহিকার ভূক্তভোগী ১৫ লক্ষ মানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)’ অনুমোদন করেন। ২৬১ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটি ২০১১-১২ অর্থ বছরে শুরু হয়ে ২০১৭ সালের জুনে শেষ হয়। প্রকল্পটির প্রধান দুটি বিষয় ছিল: ৯০ কি.মি নদী খনন এবং তালা উপজেলার জালালপুর, খেশরা ও মাগুরা ইউনিয়নে অবস্থিত পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন। পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন হওয়ায় বিশাল বিলে নদের পলি অবক্ষেপিত হয়ে কপোতাক্ষ নদ খনন পরবর্তীতে নাব্যতা ধরে রাখে। এতে নদ অববাহিকার ১৫ লক্ষ অধিবাসী প্রায় ১০ বছর জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়। এখনও ২-৩ বছর নদীর নাব্যতা জনগণের উপকারে আসবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে জুলাই’ ২০২০ থেকে জুন’ ২০২৪ পর্যন্ত (২য় পর্যায়) প্রকল্প সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটির মূল কাজ: পাখিমারা বিলে টিআরএম অব্যাহত রাখা এবং নদী খনন। কিন্তু ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের প্রায় ৪ বছর অতিবাহিত হলেও টিআরএম ব্যবস্থা পুনরায় বাস্তবায়নে কোন অগ্রগতি নেই। এদিকে ২০২০ সালে জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারের চাপে পাখিমারা বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে জালালপুর, খেশরা ও মাগুরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে তৈরি ওই বাঁধ কিছুদিনের মধ্যে ভগ্নদশায় পরিণত হয়। আবার টিআরএম চালু না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা পেরিফেরিয়াল বাঁধ তুলে চাষাবাদ শুরু করেছে। এমতাবস্থায় প্রকল্পের স্বার্থে ও জনগণের দাবীর মুখে পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কারের অজুহাতে ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে টিআরএম বিলের সংযোগ খালের মুখ বেঁধে দেয়া হয়, যা’ এখনও বন্ধ রয়েছে। একারণে, কপোতাক্ষ নদের ভবিষ্যৎ ও নদ খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতা নিয়ে এখন আশংকা দেখা দিয়েছে।
তালার বালিয়া গ্রামের আব্দুল আলিম মোড়ল জানান, টিআরএম বিলে তার ৮ বিঘা করে জমি আছে। ২০১১ ও ২০১২ সালে সরকার থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও অদ্যাবধি আর কোন টাকা তারা পাননি। এবিষয়ে সাতক্ষীরা ডিসি অফিসে অনেক বার যোগাযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি।
গৌতমকাটি গ্রামের মো. আলাউদ্দীন সরদার বলেন, এই বিলে তাদের ২২ বিঘা জমি রয়েছে। ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও আর কোনও টাকা না পাওয়ায় তিনি এখন সেখানে মাছের ঘের করছেন।
তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান বলেন, কপোতাক্ষ নদ খননের প্রথম পর্বে ২৬১ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় পর্বে ৫৩১ কোটি ৭ লক্ষ টাকা সরকার বরাদ্দ দিলেও টিআরএম ভুক্ত বিলের জমি মালিকরা মাত্র দুই বছর ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। যে কারণে জমি মালিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন সেখানে চাষাবাদ করছে। এছাড়া বিলের পেরিফেরিয়াল বাঁধ সংস্কারে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নাই। এরফলে সরকারের প্রায় ৮শ’ কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়াসহ কপোতাক্ষ নদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ক্ষতিপূরণের মোট ৪০ কোটি ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৯১২ টাকার মধ্যে কৃষকরা দুই বছরে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে ১০ কোটি ১২ লক্ষ ৭২ হাজার ৭৬৪ টাকা। গত ৬ বছরে বকেয়া রয়েছে ২৯ কোটি ৮৮ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৪৮ টাকা। এছাড়া ২য় ফেজের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৬ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অদ্যবধি কোন টাকা পায়নি। বিগত ৮ বছরে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওনা ৪৬ কোটি ৬৬ লক্ষ ৭৪ হাজার ১৪৮ টাকা। ক্ষতিপূরণের টাকা কৃষকদের পরিশোধ না করায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।
জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু বলেন, ঠিকমতো ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় পাখিমারা বিলের কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। জমি মালিকরা ক্ষতিপূরণ পেলে তাদের কোনও আপত্তি থাকতো না।
ভুক্তভোগী এলাকার কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বলেন, বকেয়াসহ ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার অতিব জরুরি হলেও কর্তৃপক্ষ তা আমলে না নেওয়াতে টিআরএম চালুর বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তাছাড়া নদীর তলদেশ জোয়ার বাহিত পলি দ্বারা এমনভাবে ভরাট হয়েছে যা ২-৩ বছরের মধ্যে নদীর অকাল মৃত্যু হবে বলে অভিজ্ঞজনেরা আশংকিত। যে কারণে প্রকল্পের আওতায় টিআরএম বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
এবিষয়ে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, দ্বিতীয় ফেইজে ৬৯ কিলোমিটার নদী খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মোট কাজের প্রায় ৫৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শেখ মঈনুল ইসলাম জানান, ২য় ফেজের কাজের জন্য জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দেয়া হলে তারা মাত্র দুই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম দেয়ায় এই টাকা নেয়া হয়নি। এ কারণেই জমির মালিকরা দুই বছরের ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি বলে জানান তিনি।