
১৫ বছরে হারিয়েছে ২০০০ পুকুর
নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য
মানা হচ্ছে না পরিবেশ আইন
শেখ আব্দুল হামিদ : খুলনা মহানগরীতে পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়া এবং উন্মুক্ত জলাশয় কমে যাওয়ায় পরিবেশগত সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। নগরায়ণ, আইনের প্রতি উদাসীনতা এবং সংরক্ষণের অভাবে পুকুরগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জলবায়ূ পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং খুলনার স্থানীয় পরিবেশ ও জনজীবনে কঠিন সংকট সৃষ্টি করছে।
খুলনা মহানগরে ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে উন্মুক্ত জলাশয় বা পুকুর। এক দশকে মহানগর এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজারের মতো জলাশয়। আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও এসব পুকুর ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বড় বড় ইমারত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মহানগরে ১৭১টি পুকুর থাকলেও যার অধিকাংশই সংরক্ষণের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। পুকুর কমে যাওয়ায় বাড়ছে এ অঞ্চলের তাপমাত্রা, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, যা ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকিস্বরূপ। ৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের খুলনা নগরীতে গেল ৩০ বছরে পাকা দালান ও আবাসিক ভবন মোট ভূমির ২৯ ভাগ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ ভাগে। দ্রুত বর্ধনশীল নগরায়নের বলি হচ্ছে এই অঞ্চলের পুকুর ও জলাভূমি। ব্যক্তিগত পুকুরের পাশাপাশি সরকারি পুকুর ভরাট করেও তৈরি হচ্ছে স্থাপনা। কেসিসির তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার পুকুর অথচ পরিবেশ আইন ২০১০ অনুযায়ী পুকুর ও জলাধার ভরাট করা বেআইনি। তিন দশক আগেও নগরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই বড় ছোট দিঘি-পুকুর ছিল, যেগুলো একদিকে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতো, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাখত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখন সেসব জলাশয় দখল আর ভরাট হয়ে একের পর এক দালানকোঠা, মার্কেট ও সড়কে রূপ নিয়েছে। অনেক পুকুর ভরাট করে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে আবাসিক ভবন, হোটেল কিংবা পার্ক। যেমন খানজাহান আলী রোডের তারের পুকুরের জায়ড়ায় গড়ে উঠেছে জাতিসংঘ শিশুপার্ক, গোলকমনি পুকুরের জায়গায় এখন গোলকমনি পার্ক, ফেরিঘাটের পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে বাসস্ট্যান্ড।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সবশেষ জরিপ বলছে, বর্তমানে নগরীতে মাত্র ১৭১টি পুকুর রয়েছে। কিন্তু এর বেশিরভাগই কচুরিপানা, আবর্জনা আর অবহেলার কারণে অচল হয়ে আছে। এই যেমন জোড়াকল বাজারের পাশে বগির পুকুর হিসেবে পরিচিত পুকুরটি গত প্রায় ৫ বছর ধরে এমন কচুরিপানায় পূর্ণ। নতুন বাজার বস্তি এলাকার এই পুকুরটি আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছে তাও ৫ বছর ধরে। একই অবস্থা তালতলা পুকুরসহ নগরীর অধিকাংশ উন্মুক্ত জলাশয়ে। এসব পুকুরে এক সময়ে নিয়মিত গোসল করা, সাঁতার শেখা, মাছ চাষ সবকিছুই হতো। পুকুরগুলো সংরক্ষণ করে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি স্থানীয়দের।
নিরালা এলাকার বাসিন্দা বয়স্ক মোহাম্মাদ আলী বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় প্রতিদিন পুকুরে গোসল করতাম, সাঁতার শিখতাম। গরমের দিনে পুকুরপাড়ে বসে হাওয়া খাওয়া ছিল অন্যরকম আনন্দ। এখন সব ভরাট হয়ে গেছে, জলাশয় নেই বললেই চলে।’ খালিশপুরের গৃহিণী নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘আগে বাসার পাশের পুকুর থেকে আমরা রান্নার জন্যও পানি ব্যবহার করতাম। এখন সেই পুকুরটিতে আবর্জনা ফেলা হয়, দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এতে মশার উপদ্রবও বেড়ে গেছে।’ নতুন বাজার এলাকার দোকানদার আমীর হোসেন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই এলাকায় হাঁটু পর্যন্ত পানি জমে যায়। আগে কাছের পুকুরে পানি চলে যেত, এখন পুকুর না থাকায় রাস্তাই ড্রেন হয়ে গেছে।’ পরিবেশবিদরা বলছেন, জলাশয় হারিয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এতে নগরের তাপমাত্রা বাড়ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে ক্রমেই নিচে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছর ধরে প্রতি বছর গড়ে এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে খুলনায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘জলাশয় সংকুচিত হওয়ায় নগরবাসী ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের মুখে পড়েছে। আইন থাকলেও প্রয়োগ না হওয়ায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও পুকুর ভরাট হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে খুলনা অচিরেই বাসযোগ্যতা হারাবে।’
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবিরুল জব্বার বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ১৮টি পুকুর সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা নিয়েছি। তবে নগরীর সব জলাশয় একসঙ্গে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। নাগরিকদের সচেতন হতে হবে।’
এদিকে আইনে নিষিদ্ধ হলেও পুকুর ভরাট হওয়া খুব একটা আটকাতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পারভেজ আহমেদ বলেন, কোথাও পুকুর ভরাটের খবর পেলেই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেই। তবে স্বীকার করতেই হবে, বাস্তবে দখল-অবহেলার কারণে অনেক পুকুর হারিয়ে যাচ্ছে।