জন্মভূমি রিপোর্ট : রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের মিলকি দেয়াড়া গ্রামের ভ্যানচালক মোঃ মোশারেফের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাজেদা বেগম (২৯)। ১০ মে দুপুরে নগরীর আল সেবা ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন। রাতে ওই প্রসূতি ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করলে সেবিকারা বলেন-এই সময় শুয়ে আছে, যে কারণে এ অবস্থা, এটা কিছু না। পরদিন ১১ মে সকালে ক্লিনিকের লোকেরা রোগীর স্বামীকে বলেন- একজন ভালো ডাক্তার এসেছেন তাকে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা দিতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে ২৭শ’ টাকা দিয়ে তিনটি ইনজেকশন আনতে হবে। তার একটি ইনজেকশন পুশ করার পর ওই ক্লিনিকের লোকেরা এসে বলেন, নবজাতকের মায়ের প্রেসার একেবারে লো হয়ে গেছে, আপ করা যাচ্ছে না। তাকে অন্য কোনো চিকিৎসালয়ে নিতে হবে। তখন ভিকটিমের স্বজনেরা তাকে প্রথমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার আইসিইউতে ভোর রাত চার টার দিকে তার মৃত্যু হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা বলেন- ওই নারীর হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। নিহতের স্বামী দৈনিক জন্মভূমিকে এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ভ্যান চালিয়ে গড়ে প্রতিদিন ৫-৬শ’ টাকা আয় হয়। সেই টাকা দিয়ে স্কুল পড়ুয়া দুই সন্তান এবং নবজাতকের দুধ কিনতে চরম বেগ পেতে হচ্ছে। তিনি এই অকাল মৃত্যুর জন্য ওই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে দায়ি করে দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
শহরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে অদক্ষ ডাক্তারদের চিকিৎসায় এবং দায়িত্বে অবহেলায় মাঝে-মধ্যেই মানুষ মরছে। কেউ-কেউ ভুল চিকিৎসায় পঙ্গু হতে বসেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
খুলনা সিটির বিভিন্ন প্রান্তে ২শ’ ৫০ টি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনেস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে ১শ’ ৪১ টি ডায়গনেস্টিক সেন্টার। বাকী ১শ’ ৯ টি ক্লিনিক। কয়েকটি ক্লিনিকে রোগ-পরীক্ষা নিরিক্ষার কাজও চলে। চলতি অর্থবছর শেষ হতে চললেও ১শ’২৩ টি ক্লিনিক ও ডায়গনেস্টিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ এখনও লাইসেন্স নবায়ন করেনি। কোনো-কোনোটির গত তিন-চার অর্থ বছরেও নবায়ন হয়নি। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দাকোপ উপজেলার উত্তর বানিশান্তা গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য রামমোহন মিস্ত্রির স্ত্রী শিবানী বিশ^াস (২২) কে সিজার করানোর উদ্দেশ্যে গত ২২ মার্চ নগরীর বেস্ট কেয়ার ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোনো পরীক্ষা-নিরিক্ষা ছাড়াই ওই গর্ভবতীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তার স্বামী অভিযোগ করেন। যদিও এ ব্যাপারে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
রামমোহন বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে ডাঃ সুইটি ওটিতে প্রবেশ করেন। সিজারের পর রাত ৮ টার দিকে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তখন ডাক্তার বলেন, প্রসুতির রক্তের প্রয়োজন দ্রুত যোগাড় করেন। ভিকটিমের স্বামীসহ স্বজনরা রক্ত যোগাড় করে এসে দেখেন- ডাক্তার চলে গেছেন। তখন ক্লিনিকের লোকেরা শিবানীকে দ্রুত এ্যামব্যুলেন্সে করে শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে ভর্তি করেন। পরদিন সকালে ওই নারীর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। এই মৃত্যুর জন্য রামমোহন সংশ্লিষ্ট গাইনি ডাক্তারকে দায়ি করেছেন।
রূপসা উপজেলার শোলপুর গ্রামের খান মেহেদী হাসান (৪০) গত ১১ মার্চ পায়ে সামান্য ক্ষত নিয়ে টুটপাড়া মোড় এলাকার স্টার ক্লিনিকে যান। তখন ক্লিনিকের মালিক জনৈক ফেরদাউস হোসেন নিজেই রোগীর মিনি অপারেশন করে সেখানে ভর্তি করে নেন। এরপর ১৬ দিন ধরে ওষুধ এবং ড্রেসিং বাবদ মেহেদীর কাছ থেকে প্রতারণা করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে অন্য আরেকটি ক্লিনিকে যেয়ে অপারেশন করান। এখনও তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ভিকটিম এসব তথ্য জানান।
পেটে ব্যথা জনিত কারণে দৈনিক জন্মভূমির স্টাফ রিপোর্টার মামুন খানের স্ত্রী শায়লা শারমিন (৩০) কে গত ১৩ মার্চ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক ডাঃ সানজিদা হুদা সুইটির প্রাইভেট প্রাকটিসের স্থান গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে নেয়া হয়। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার রিপোর্ট দেখে ওভারিয়ান সিস্টে আক্রান্ত বলে রোগীকে শনাক্ত করেন। পরামর্শ দেন-দ্রুত অপারেশন করতে হবে, নতুবা সিস্ট ফেটে ইনফেকশন হয়ে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। বলেন, এটি খুবই সাধারণ অপারেশন। ২০-২৫ মিনিট সময় লাগতে পারে।
১৪ মার্চ রোগীর পেটে ভীষন ভাবে ব্যথা শুরু হলে তাকে খুলনা সদর থানাধীন গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডা: সুইটি তাকে অপারেশনের আগের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থাপত্র দেন এবং ১৫ মার্চ দুপুর দেড়টায় অপারেশনের সময় নির্ধারণ করেন। দুপুর একটার পর ওয়ার্ড বয় এবং একজন আয়া শায়লাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। সেখানে ভিকটিমকে সান্তনা এবং কথা বলে সাহস যোগাবার একপর্যায়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডাঃ দিলিপ কুমার কুন্ডু রোগীর স্বামীকে ওটি থেকে বের করে দেন। ছবি তোলার কোনো চেষ্টা না করা স্বত্তেও ডাঃ দিলিপ স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে ছবি কিংবা ভিডিও করা হতে বিরত থাকতে আদেশ দেন।
খুলনা জেনারেল হাসপাতালের একজন এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ বলেন, এনেসথেসিয়া দুই ভাবে দেয়া হয়। একটি জেনারেল, এতে রোগীকে দফায়-দফায় ওষুধ প্রয়োগ করে পুরো শরীর অজ্ঞান করা হয়। আরেকটি স্পাইনাল এনেসথেসিয়া। এতে রোগীর শরীরের অর্ধাংশ অবশ করা হয়। এ কাজে বুপিভিং নামের এক ধরণের ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। ওভারিয়ান সিস্টের ধরণ সিম্পল হলে অবশ করে অপারেশন করা হয়। দু’ ঘন্টার মধ্যে তার সংজ্ঞা ফেরৎ আসে। শায়লা শারমিনের টিবিএস আলট্রাস্নো পরীক্ষার রিপোর্টে সিস্টের ধরণ ছিল সিম্পল। যদিও ডাঃ দিলিপ তাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দিয়েছিলেন।
ডাঃ দিলিপ কুমার কুন্ডু (যিনি নিহত নারীর এনেসথেসিয়া করেছিলেন) বলেন, রোগীর হার্ট, কিডনি, লিভারসহ শরীর অন্যান্য অঙ্গের নিরাপত্তায় তাকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেয়া হয়েছিল। এ কাজে প্রপোকল নামের ইনজেকশন একাধিকবার ব্যবহার করা হয়। এমনকি তাকে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশনের আগেও এনসথেসিয়া দেয়া হয়েছিল। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিরাপদ রাখার জন্যই যদি জেনারেল এনেসথেসিয়া দেয়া হয়েছিল, তবে তার হার্ট এ্যাটাক হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনেসথিয়ায় ব্যবহৃত ওষুধের রি-এ্যাকশন। নাভির নিচে স্পাইনাল এনসথেসিয়া দিলে অপারেশনের সময় রোগী ব্যথা অনুভব করেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৫ মার্চ দুপুর দুই টা ১০-১২ মিনিটের দিকে ডাঃ সুইটি অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে ঝড়ো গতিতে বেরিয়েই তিনি বলেন, মে-বি রোগীর কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়েছে। তাকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্তত পাঁচ ব্যাগ। আগে রক্তের কথা বলেন নি কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি একজন ওয়ার্ড বয়কে ধমক দেন। ভিকটিমের স্বজনেরা রক্তের ব্যবস্থা করতে-করতে অন্তত ৪০ মিনিট কেটে যায়। তখন রোগীকে রক্তের ব্যাক-আপ হিসেবে ডাঃ দুইটি ইনজেকশন পুশ করেন। ওটির জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল-সেখানে অবস্থানরতরা কোক খাচ্ছেন। হাসি-ঠাট্টা করছেন। দুই জন তার মুখে এ্যামরোব্যাগ মেশিনের দ্বারা পাম্প দিচ্ছেন। তখন তার পেট ফুলে ওঠে। এরপর ডাঃ সুইটি বলেন, তার সিস্ট লিক করেছে। ব্লিডিং হচ্ছে। আইসিইও ব্যাক-আপ আছে এমন চিকিৎসালয়ে নিয়ে অপারেশন করতে হবে। এরপর তিনি, ডাঃ দিলিপসহ ক্লিনিকের লোকেরা তাকে সিটি মেডিকেলে নিয়ে অপারেশন করেন এবং সেখানকার আইসিইউতে রেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
ডা: দিলিপ বলেন, ল্যাপারস্কপিক অপারেশনের আগে রোগীকে কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে পেট ফোলানো হয়। এতে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে সিস্টের অবস্থান শনাক্ত করে অপারেশন করতে সুবিধা হয়। কিন্তু কার্বন ডাই অক্সাইড দেয়ার আগেই তিনি হার্ট এ্যাটাক করেন। পরে সে অবস্থা থেকে রিকভারি হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সার্জন তাকে পেট কেটে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন।
রোগীকে অপারেশনকারী ডাঃ সানজিদা হুদা সুইটি বলেন, এনেসথেসিয়া দেয়ার পরেই রোগীর কার্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়। পরে সেটা রিকভারি করে। টিউমার ছিদ্্্র হয়ে যাওয়ায় ব্লিডিংএর কারণে তার পেট ফুলে ওঠে। ধারণা ছিল রোগী ভালো হয়ে যাবে। তাই গরীব নেওয়াজে ঝুঁকি না নিয়ে খুলনা সিটি মেডিকেলে নিয়ে যাই। টিউমার অপারেশনের পর আইসিইউতে রাখা হয়। পরে রোগী রেসপন্ড করলেও আর ফেরেনি। পরবর্তীতে শহীদ শেখ আবু নাসের হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২৬ মার্চ সকালে শায়লার মৃত্যু হয়।
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ মোঃ মঞ্জুরুল মুর্শিদ দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, ভুল চিকিৎসায় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের কাছ থেকে অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে তদন্ত করে দোষিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যেসব ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি, সেগুলোর ব্যাপারে ইন্সপেকশন চলছে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত