
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা উপকূলীয় এলাকাগুলোয় সুপেয় পানির সংকট অত্যন্ত তীব্র। চারপাশে বিস্তীর্ণ জলরাশি থাকলেও কোনো পানিই পানযোগ্য নয়। এমনকি এই পানি গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। পানির সন্ধানে এখানকার মানুষ দূর–দূরান্তে ছুটে বেড়ায়। চড়া দাম দিয়েও অনেক সময় পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। নারীরা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে পানি সংগ্রহ করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রের লোনাপানি খুব সহজে মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ও তীব্রতা, যার ফলে উপকূলীয় বাঁধ ভেঙে কিংবা উপচে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়। অন্যদিকে, উজানের নদীগুলোয় স্বাদুপানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া এবং নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সমুদ্রের পানি দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে।
এই প্রাকৃতিক কারণগুলোর পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে আশির দশকে ‘ব্লু গোল্ড’ বা ‘সোনালি সম্ভাবনা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া চিংড়ি চাষ এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে পরিকল্পিতভাবে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়ে চিংড়িঘের তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে আর্থিক সচ্ছলতা আনলেও দীর্ঘ মেয়াদে মাটির উর্বরতা চিরতরে নষ্ট করে দিচ্ছে, স্বাদুপানির ভূগর্ভস্থ স্তর দূষিত করছে এবং মিঠাপানির প্রাকৃতিক আধারগুলো ধ্বংস করছে।
এই সংকট কেবল পানীয় জলের অভাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেছে। লবণাক্ত পানি ব্যবহারে চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানির জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে নারীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন এবং মেয়েরা শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ছে।
এই সংকট মোকাবিলায় গত কয়েক দশক ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন থেকেই যায়। ষাটের দশকে উপকূলীয় জনগণকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে পোল্ডার বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘কোস্টাল এমব্যাঙ্কমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সিইআইপি)’-এর মতো বড় প্রকল্পের মাধ্যমে সেই বাঁধগুলোকে আরও উঁচু ও শক্তিশালী করা হয়েছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে ব্র্যাকের মতো বেসরকারি সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং) জন্য ট্যাংক স্থাপন শুরু হয়, যা একটি জনপ্রিয় কমিউনিটিভিত্তিক সমাধান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর পাশাপাশি, মিঠাপানির আধার হিসেবে পুকুর পুনঃখনন এবং পানি পানের উপযোগী করতে পুকুর-বালি ফিল্টার (পিএসই) স্থাপনের মতো স্থানীয় প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একবিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে গত দশকে, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সৌরশক্তিচালিত রিভার্স অসমোসিস (আরও) প্ল্যান্ট স্থাপন করে লবণাক্ত পানিকে সুপেয় পানিতে রূপান্তরের আধুনিক প্রযুক্তিও আনা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু এই প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলো বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি সমাধানই সমস্যার কোনো একটি দিক নিয়ে কাজ করে, কিন্তু সামগ্রিক চিত্রকে বদলে দিতে পারে না। কমিউনিটিভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা কেবল বর্ষা মৌসুমের কয়েক মাসের জন্য কার্যকর থাকে।
শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-মে), যখন পানির চাহিদা ও লবণাক্ততা দুটোই সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, তখন সংরক্ষিত পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় এই ব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, পুকুর বা পিএসই ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ; কারণ, একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস মুহূর্তেই মিঠাপানির একমাত্র আধারটিকে লবণাক্ত করে তুলতে পারে। সবচেয়ে আধুনিক সমাধান হিসেবে পরিচিত আরও প্ল্যান্ট প্রযুক্তিগতভাবে কার্যকর হলেও এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা প্রকট। এর স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিশেষ করে ফিল্টার মেমব্রেন পরিবর্তনের খরচ এতটাই বেশি যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই পানি সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই প্ল্যান্ট থেকে নির্গত বর্জ্য বা ঘন লবণাক্ত পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন না করায় তা স্থানীয় পরিবেশে মিশে দূষণ আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছে। একইভাবে, উপকূলীয় বাঁধগুলো বন্যা থেকে সুরক্ষা দিলেও পোল্ডারের ভেতরে আটকে পড়া লবণাক্ততা দূর করতে বা স্বাদুপানির জোগান দিতে পারে না, ফলে মানুষ ‘রক্ষিত কিন্তু অবরুদ্ধ’ অবস্থায় জীবনযাপন করে।
মূল সমস্যাটি হলো আমাদের প্রকল্পভিত্তিক ও বিচ্ছিন্ন মানসিকতা। আমরা সংকটকে একটি সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের অংশ হিসেবে না দেখে আলাদা আলাদা সমস্যা হিসেবে বিচার করছি। এর পেছনের মৌলিক দুর্বলতাগুলো হলো:
প্রথমত, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের তীব্র অভাব। প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে কাজ করায় কোনো উদ্যোগই পূর্ণাঙ্গতা পায় না।
দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির নিজস্ব সমাধানকে উপেক্ষা করে ব্যয়বহুল প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের দিকে ঝোঁকা। ম্যানগ্রোভ বন তৈরি, জলাভূমি সংরক্ষণ ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার মতো প্রাকৃতিক উপায়গুলো আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত, স্থানীয় জ্ঞান ও অংশগ্রহণকে উপেক্ষা করা। যে নারীরা প্রতিদিন পানির জন্য সংগ্রাম করছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে নীতিমালা প্রণয়নের সময় গুরুত্বই দেওয়া হয় না, ফলে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সমাধান ব্যর্থ হয়। সবশেষে, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার আধিক্য। বেশির ভাগ উদ্যোগই প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যকারিতাও হারিয়ে ফেলে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো একক জাদুকরি সমাধান নেই। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত, প্রকৃতিভিত্তিক ও জনগণকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত শতবর্ষী ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ এই পথের একটি যুগান্তকারী রূপরেখা, যার অধীনে উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনার আওতায় নদী খনন, স্বাদুপানির প্রবাহ বৃদ্ধি এবং কৌশলগতভাবে পোল্ডার ব্যবস্থাপনার মতো উদ্যোগগুলো দ্রুত ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
শুধু কংক্রিটের বাঁধ নয়, ‘গ্রে’ (কংক্রিটভিত্তিক) ও ‘গ্রিন’ (প্রকৃতিভিত্তিক) অবকাঠামোর একটি সুষম সমন্বয় ঘটাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, পোল্ডারের ভেতরে নিয়ন্ত্রিতভাবে স্বাদুপানি ঢুকানো এবং পলি ব্যবস্থাপনার জন্য ‘টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট’ (টিআরএম)-এর মতো কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা শুধু পানির সংকটই মোকাবিলা করবে না, বরং পলি জমিয়ে ভূমির উচ্চতাও বৃদ্ধি করবে। পাশাপাশি, বৃষ্টির পানি ও বর্ষার মিঠাপানিকে পরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভে রিচার্জ করার জন্য ‘ম্যানেজড অ্যাকুইফার রিচার্জ (এমএআর)’ প্রযুক্তি শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির একটি নির্ভরযোগ্য ভূগর্ভস্থ আধার তৈরি করতে পারে।
সবশেষে, এসব পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকতে হবে স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারীদের। তারাই এই সংকটের প্রধান ভুক্তভোগী এবং তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই হতে পারে সমাধানের মূল চাবিকাঠি। পানি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত স্থানীয় কমিটিগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচ্ছিন্ন প্রকল্পের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসে প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও মানুষের শক্তিকে একসুতোয় গাঁথতে পারলেই কেবল দক্ষিণাঞ্চলের এই দীর্ঘস্থায়ী সংকট থেকে টেকসই উত্তরণ সম্ভব।