
দশমিনা(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার শীত মৌসুমে বিভিন্ন সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেদে সম্প্রদায় বসবাস করছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাসমান অবস্থায় বসবাস করা এই সম্প্রদায়ের নাগরিকরা নানাবিধ সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তাদের কোন ভোটের রাজনীতি নেই। কে জিতল আর কে হারল সে খবর তারা রাখে না। অথচ কয়েকশ’ বছর ধরে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষকে যাযাবর চরিত্র নিয়ে সমাজ-সভ্যতায় তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে,সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। সর্দাররা বংশক্রমেই সরদার হয়। সর্দারের দৃষ্টিতে অপরাধ করলে বেদে সমাজে জুতা পেটা,অর্থ দন্ডসহ নানা ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। সরদার বললেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে অভাব অনটনের কারণে। কেউ কেউ পুকুর কিংবা ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা রূপা তুলে দেয়ার কাজ করে থাকে। কেউ দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাটবাজারে। বেদে বহরের বয়স্করা জানালেন, বেদের মধ্যে রয়েছে অনেক উপ-সম্প্রদায়। যেমন, মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার, বান্দরওয়ালা, সওদাগার, কুড়িন্দা, হাতলেহেঙ্গা, মিশ্চিয়ারি, গাড়লী। মালবৈদ্যরা প্রধানত সাপ খেলা দেখায় ও দাঁতের পোকা তোলে। বাজিকরেরা ম্যাজিক দেখায় ও জাদুটোনা করে। শালদাররা মাছ ধরে, নদী থেকে ঝিনুক তুলে মুক্তা বের করে এবং চুড়ি বিক্রি করে থাকে। যৌতুকবিহীন বিয়েতে কাজী বা রেজিস্টারের প্রয়োজন হয় না। শিক্ষা কি এরা জানে না। ভোটাধিকার প্রয়োগে নেই এদের আগ্রহ। এই রকম সমাজ সভ্যতার অনেক কিছুই অজানা। এই মানুষেরা নদীর কয়েক ফুট উঁচু ঢেউ কিংবা প্রকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারে, নদী আর সাগর জলের আচর-আচরণ এদের নখদর্পণে। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষাও এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এরা প্রধানত পোয়া, রামছোস (তাপসী), ট্যাংরা, গলসা, পাঙ্গাশ, কাওন প্রভৃতি মাছ ধরে। মইয়া জাল দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। এ সমপ্রদায় প্রতিটি নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর মাছ ধরায় পারদর্শী। এতসব অবদানের পরেও বেদে সম্প্রদায় আমাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। নানা সমস্যা-সংকট এদের আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। এরা ভূখন্ডে কয়েক শত বছরের পুরনো বাসিন্দা হলেও এদের নেই কোনো প্রকার নাগরিক অধিকার। নেহাত ভেসে কচুরিপানা কিংবা নদীর জলে যাওয়া খড়কুটোর মতোই মানবতারা আজীবন নদীর পানিতে ভেসে বেড়ায়। নাগরিক পরিচয় সংকট এদের প্রবল। এই সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি নাম স্বাক্ষর করতে পারে না। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া স্থায়ী ঠিকানা না থাকা এবং ভূমি সমস্যার কারনে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এই সম্প্রদায়ের কোন মানুষের মৃত্যু হলে কোন জায়গা না থাকায় কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো। বর্তমানে মানবিকতার কারনে নদীর পাড়ে বা কোনো ভূ-স্বামীর পরিত্যক্ত ভিটের দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে যাযাবর ব্যক্তির লাশ। কালের বিবর্তনে বেদে সম্প্রদায়রা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।

