
দশমিনা(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি : পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার শীত মৌসুমে বিভিন্ন সমতল ভূমিতে একদল বেদে সম্প্রদায় বসবাস করছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাসমান অবস্থায় বসবাস করা এই সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত নাগরিক সেবা থেকে নেই। সারা বছর বিভিন্ন সমতল ভূমিতে অস্থায়ী তাবুতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থায়ী কোন ঠিকানা পাওয়া না গেলেও ভূমিতে অস্থায়ীভাবে তাদের বসবাস। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় করে ছুটে চলা তাদের নিত্যদিনের সাথী। খালের পাশে এক একটি বেদে দলে ১০ থেকে ১৫ টি নৌকা সারিবদ্ধ হয়ে নোঙ্গর করে তারা জীবন ও জীবিকার জন্য কখনও বড়শি দিয়ে মাছ ধরা কিংবা পল্লী জনপদে গিয়ে ঝাড়ফুক ও সিঙ্গা লাগানোই তাদের প্রধান পেশা।
আধুনিক যুগেও জীবনযুদ্ধে জীবিকার সন্ধানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান বেদেনীরা। ‘সিঙ্গা লাগাই, দাঁতের পোক ফালাই’- বেদেনীদের এখন সুর আর কারও মনে নাড়া দেয় না। আগের মতো কেউ আর চাল, ডাল, শাক-সবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যান না। বদল প্রথা নেই আর এ সংসারে। অর্থের প্রবল নেশায় স্থলের মানুষেরা ভাতের সঙ্গে মাছ আর বস্ত্র আছে কিনা, খবর রাখে না কেউ। অসহায় হয়ে পড়েছে এসব মাছ ধরা লোকগুলো। বেদেরা স্থলে আর মানতাদের নদীতেই সংসার। কেমন আছে ঠিকানা বিহীন জীবনে এই যাযাবর বেদে ও মানতা সম্প্রদায়রা। নিজ ভূখণ্ডে বাস করেও যারা পরবাসী! সমাজ সভ্যতা গড়ার কাজে প্রতিনিয়ত নিবেদিত প্রাণের লোকগুলো কেমন আছে? বিষধর সাপ নিয়ে খেলা, বিষাক্ত জীবন নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌপথে চলাচল করত এই সম্প্রদায়রা। এখন নৌ পথেই বাঁধ, স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে । বেদেরা এখন সড়কপথে এসে পথ থেকে প্রান্তরে জনগুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারের সংলগ্নে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠোপথে। তবে দিন দিন এ বেদে সম্প্রদায় সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানা পণ্য এখন তাদের হাতে উঠেছে। বেঁচে থাকার নিরান্তর সংগ্রমেই আজ তাদের ভিন্ন পথে চলা বৈকি। তারপরও যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তেমনই আশ্রয় নেয়া পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা সদরের খালে ঠাঁই নিয়েছে একটি বেদেবহর। এই বহরে রয়েছে ১০টি পরিবার, তাদের মোট লোক সংখ্যা শতাধিক। এই বহরের সরদার মো. ফরিদ সরদার। কথা হয় সরদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা! আজ এখানে আছি, কাল ওখানে, বেদেবহরের মেয়েরাই আয়-রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে, সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে। পুরুষরা সারাদিন ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। সরদার বললেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে অভাব-অনটনের কারণে। কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা-রূপা তুলে দেয়ার কাজ করে। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাট-বাজারে। নদীর কলতানে যাদের ঘুম ভাঙা আর ঘুমোতে যাওয়া তেমনি অপর একটি সভ্যতার নিগৃহীত সম্প্রদায় মানতারা। তেঁতুলিয়া-বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর বাঁকে খালে তাদের দেখা মেলে। জন্ম থেকে নদীর জলে খেলা করতে করতে ওরা বড় হয়। এরকম একজন জসীম সরদারের স্ত্রী রুনু বেগম (৩৯)। ১৫ বছরের স্বামীর সংসারে হাল ধরতে নৌকার হাল ধরতে হয়েছে। কিশোরী বয়সের বিবাহিত জীবন আজ জীর্ণছিন্ন, রোগাক্রান্ত শরীর, পুষ্টিহীনতায় ভুগেও রুনু বেগম রেহাই পাচ্ছে না সংসার নামক যন্ত্রণা থেকে। ৬ সদস্যের পরিবারে ৪ সন্তানের জননী আজ। উপজেলার বগীর একই খালের আদম আলী (৩৩)। ছদুসহ (৩৭) ৩০টির অধিক নৌকায় প্রায় পৌনে শতাধিক লোকের বাস। এদের প্রত্যেকের গড়ে ৪-৫টি সন্তান রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন খালে রয়েছে এরকম প্রায় শতাধিক লোকের বসবাস। পুঁজি জোগানোসহ এই সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্য সহায়তায় নেই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তারা সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত