বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে ভারতে পাচার করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার নারী। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার নারীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পাচার হওয়া এসব নারীর অনেককে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। নারী পাচারের ঘটনায় রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’সহ সাতজনকে ভারতে গ্রেপ্তারের পর যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। সাজা হওয়ার কারণে টিকটক হৃদয়সহ সাতজনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশে দায়ের করা অন্তত ছয় মামলার তদন্ত গত এক বছর ধরে আটকে আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ‘টিকটক’ ব্যবহারকারী ১০৫ জনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়েছে। অনেক ‘টিকটক’ ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে
সম্প্রতি নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। ১৩টি মামলার মধ্যে ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে দুটি এবং সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন শাহ পরান থানা, সুনামগঞ্জ ও বরগুনায় একটি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
প্রথম মামলাটি হয়েছিল আলোচিত টিকটকার ইয়াসিন আরাফাত অপুর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে মারধর ও বেআইনি সমাবেশের অভিযোগ উঠেছিল। বেশ কিছুদিন জেল খেটে বের হওয়ার পর তিনি এখন আবার টিকটকে সক্রিয় হয়েছেন। টিকটকারদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে চারটি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পাঁচটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে। টিকটক হৃদয় তরুণীদের কুষ্টিয়ায় নিয়ে শূটিংয়ের কথা বলে ভারতে পাচার করে দেন। গত বছর ভাটারা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় দেওয়ান রসুল হৃদয়সহ দুজনের বিরূদ্ধে। তিনিও টিকটকে এক কিশোরীকে নায়িকা বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি করেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক কামরুল আহসান বলেছেন, বাংলাদেশে বেআইনি এমন কনটেন্ট প্রচার না করার ব্যাপারে টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা বাংলাদেশে টিকটক ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনকারীদের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। কিছু অপরাধের তদন্ত নিয়ে সিআইডি টিকটকের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে বসে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, এ দেশের আইনে বৈধ নয়, এমন কনটেন্ট আপলোড করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। টিকটকের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে অপরাধীদের তথ্য চেয়েছে সিআইডি। টিকটক অপরাধের তথ্য দিতে সম্মত হয়েছে।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতে বাংলাদেশী তরুণী পাচার করার অভিযোগে রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’সহ অন্তত ২০ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে। মানব পাচারের অভিযোগে মামলাটির তদন্ত করছে হাতিরঝিল থানার পুলিশ। বাংলাদেশে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ভারতে ধরা পড়ে আদালতের বিচারে সাজা হয়ে গেছে টিকটক হৃদয়সহ সাতজনের। এ কারণে তাদেরকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টিও অনিশ্চিত। ভারতে বাংলাদেশি তরুণীকে ধর্ষণের দায়ে রিফাতুল ইসলাম হৃদয় ওরফে ‘টিকটক হৃদয়’সহ সাত বাংলাদেশীকে গত ২০ মে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। ভারতে সাজা হওয়া রিফাতুল ও অন্য ছয় আসামি এখন দেশটির কারাগারে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশে কবে নাগাদ মামলার তদন্ত শেষ হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না হাতিরঝিল থানা পুলিশ।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, রিফাতুলসহ যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সে সব মামলার তদন্ত শেষ হতে আরও সময় লাগবে। কারণ এসব মামলায় অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের খুঁজে বের করে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করতে হবে। এসব মামলায় ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও অনেকে পলাতক। তাদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। তাদের মধ্যে ১১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় এই মানব পাচার চক্রের সদস্যসংখ্যা হবে ৪০ থেকে ৫০।
বাংলাদেশ থেকে পাচারের শিকার এক তরুণী গত বছরের ২৭ মে ভারতের বেঙ্গালুরুতে নির্যাতন ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। তাকে নির্যাতনের একটি ভিডিও চিত্র ভাইরাল হয়। নির্যাতনে জড়িত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রিফাতুল ওরফে টিকটক হৃদয়কে শনাক্ত করে বাংলাদেশ পুলিশ। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা তখন হাতিরঝিল থানায় রিফাতুলসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা করেন। এরপর ভারতে পাচারের শিকার আরও পাঁচজন তরুণী রিফাতুলের নাম উল্লেখসহ অন্যদের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেন। এই ছয় মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ২৬ আসামির মধ্যে তিনজন জামিনে আছেন। বাকিরা কারাগারে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর বিভাগের একজন আইনজীবী বলেছেন, মানব পাচারের মামলায় ভারতীয় তদন্ত সংস্থা দ্রুত তদন্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ জন্য বিচারও হয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় দ্রুত তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া উচিত।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা ছয়টি মানব পাচার মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, নিম্নবিত্ত পরিবারের এসব তরুণীকে মূলত চাকরি দেওয়ার নাম করে ফাঁদে ফেলে যশোর ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। পরে ভারতের মুম্বাই, বেঙ্গালুরুসহ দেশটির বিভিন্ন শহরের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ভারত থেকে ফিরে আসা এক তরুণী মামলার অভিযোগপত্রে লেখেন, চাকরির ফাঁদে ফেলে রিফাতুল ওরফে টিকটক হৃদয় তাকেসহ তিনজন তরুণীকে ভারতে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। রিফাতুল ও তার সহযোগীদের হাতে তরুণী একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও মানবাধিকার সংগঠনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতে পাচার হওয়া প্রায় দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে এখনো প্রায় ১০ হাজার নারী ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন। এসব নারীকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়। কত নারী পাচার হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। শুধুমাত্র উদ্ধার হওয়া নারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী পাচার হওয়া নারীর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পাচার হওয়া নারীর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানব পাচারের একই ধরনের মামলায় ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে বিচার কার্যক্রম শেষে সাজা দিয়ে দিতে পেরেছে সেই দেশের আদালত। অথচ বাংলাদেশে একই ধরনের মামলার তদন্ত কার্যক্রমই শেষ করা গেল না। বিলম্বিত বিচারে ভুক্তভোগীরা একপর্যায়ে আসামিদের সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য হন। এর ফলে আসামিদের বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়।