সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : চোখ মুছছিলেন আজগার আলী(ছদ্মনাম)। বললেন, ‘ছেলেকে ফিরে পেয়ে মনে হলো আমি আবার জন্ম নিলাম।’ কয়রার এই বৃদ্ধের মুখে স্বস্তির সঙ্গে আতঙ্কের ছাপ। ডাকাতেরা বলেছিল, ৩০ হাজার টাকা না দিলে ঘরে ফিরবে ছেলের লাশ।
গত ১৮ আগস্ট পশ্চিম সুন্দরবন এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বাবা বলেন, ‘অনেক কষ্টে ধারদেনা করে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করে ছেলেকে ফিরিয়েছি।’ তাঁর ছেলে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে আটক ছিলেন তিন দিন। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না, দিনরাত ডাকাতদের নৌকা বাইতে হতো।
ছেলেকে জিম্মি করেছিল ‘দুলাভাই বাহিনী’র ডাকাতেরা। ডাকাত দলের এই নাম কোনো তামাশার বিষয় নয়। এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়, নির্যাতন আর মুক্তিপণের আতঙ্ক।
একসময় সুন্দরবনের ত্রাস ছিল ‘ইলিয়াস বাহিনী’, বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনের গভীর পর্যন্ত ছিল তার দাপট। ইলিয়াস আত্মসমর্পণ করেন, ইতিমধ্যে মারাও গেছেন। গত বছরের আগস্টে ইলিয়াসের বোনের স্বামী রবিউল নতুন দল গড়ে তুললে স্থানীয় লোকজন এর নাম দেন ‘দুলাভাই বাহিনী’।
ছেলেকে জিম্মি করেছিল ‘দুলাভাই বাহিনী’র ডাকাতেরা। ডাকাত দলের এই নাম কোনো তামাশার বিষয় নয়। এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়, নির্যাতন আর মুক্তিপণের আতঙ্ক।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ৩২টি দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, গত বছর সরকার পতনের ডামাডোলের সুযোগে দুলাভাই বাহিনীসহ সুন্দরবনে আবার সক্রিয় হয়েছে অন্তত ১৪টি দস্যুদল। তারা নিয়মিত অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। আত্মসমর্পণকারীদের অন্তত ১১ জন আবারও দস্যুতায় ফিরেছেন।
এ কাজে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক উপকূলের প্রভাবশালী একশ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী, যাঁরা এলাকায় ‘কোম্পানি মহাজন’ নামে পরিচিত। তাঁদের নির্দেশে জেলেরা নদীতে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরেন। তাঁরাই দস্যুদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে দেন, প্রায় সময় মুক্তিপণও পাঠান। এতে দস্যুদের হাতে যায় টাকার জোগান, অস্ত্রের মজুত আর বিষে নষ্ট হয় সুন্দরবনের পরিবেশ।
সুন্দরবনে দস্যুতা ফেরার বিষয়ে গত জুলাই থেকে অনুসন্ধান শুরু করে প্রথম আলো। অনুসন্ধানে নেমে কথা বলেছি বনজীবী, আত্মসমর্পণকারী সাবেক দস্যু ও গোপনে দস্যুতায় জড়ানো ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাঁদের বয়ানে উঠে এসেছে ডাকাতদের সংগঠিত গোপন জীবন, নদীর ভেতর ভাসমান ঘাঁটি আর নৌকায় বন্দী অসহায় মানুষের গল্প।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, গত বছর সরকার পতনের ডামাডোলের সুযোগে দুলাভাই বাহিনীসহ সুন্দরবনে আবার সক্রিয় হয়েছে অন্তত ১৪টি দস্যুদল। তারা নিয়মিত অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। আত্মসমর্পণকারীদের অন্তত ১১ জন আবারও দস্যুতায় ফিরেছেন।
ফয়েজ আলীর ছেলে সুন্দরবনের পাটাকাটা এলাকা থেকে ডাকাতের ফাঁদে পড়ে যান। বনের খালে কাঁকড়া ধরার সময় তিনি হঠাৎ দেখেন, পাঁচটি নৌকায় অস্ত্রশস্ত্রধারী বনদস্যুরা ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগোচ্ছে। ভয়ে নৌকা বেয়ে খালের মধ্য দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয়নি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে দস্যুরা তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল।
গত ৩১ জুলাই কয়রা উপজেলার একটি বাজারে গিয়ে শুনি, স্থানীয় দরিদ্র বনজীবী জহিরুল ইসলাম (নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ছদ্মনাম দেওয়া হলো) চার দিন ধরে বনদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন। তাঁর মেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমরা গরিব, বনে না গেলে খাবার চলে না। জিম্মির বিষয়ে কাউকে জানালে ডাকাতেরা আব্বাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই পরিচিতদের কাছেই সাহায্য চাইছি।’
সুন্দরবনে দস্যুদের আগাম চাঁদা দিয়ে বনে যাচ্ছেন জেলেরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীরে
ধারকর্জ করে ২০ হাজার টাকা জুটিয়ে মুক্তিপণ দিয়ে গত ২ আগস্ট বাড়ি ফেরেন জহিরুল। পরদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করি। তাঁর কণ্ঠে তখনো ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের জোলাখালী খালে ঢুকতেই দুলাভাই বাহিনীর ১১ ডাকাত তিনটি নৌকা নিয়ে ঘিরে ধরে, সবার হাতে ছিল বন্দুক। এক সপ্তাহ ধরে আটকে ছিলাম, দিনে একবার খেতে দিত, বাকি সময় নৌকা বাইতে বাধ্য করত।’
ডাকাতেরা তাঁর কাছে ৩০ হাজার টাকা চেয়েছিল। অনেক অনুনয়ের পর ২০ হাজার টাকায় রাজি হয় এবং শর্ত দেয়, পরেরবার বনে ঢুকলে বাকি ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।
মধু সংগ্রহে যাওয়া মৌয়াল ও গোলপাতা কাটতে যাওয়া বাওয়ালিদেরও ডাকাতদের মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে। কয়রার একটি গ্রামের একজন মৌয়াল বলেন, সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে এখন ডাকাতেরও ভয়। তাঁদের নৌকার সাতজন মৌয়াল ডাকাত দলের হাতে ধরা পড়লে ৫২ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ডাকাতমুক্ত না হলে আগামী মধু আহরণ মৌসুমে বনে যাবেন না।
আমরা গরিব, বনে না গেলে খাবার চলে না। জিম্মির বিষয়ে কাউকে জানালে ডাকাতেরা আব্বাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই পরিচিতদের কাছেই সাহায্য চাইছি।
সুন্দরবনে ডাকাত শরীফ বাহিনীর কাছ থেকে জিম্মি জেলেদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। গত ১০ এপ্রিল
এবার গোলপাতা কাটতে গিয়ে তিন দল ডাকাতকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন আরেকটি গ্রামের একজন বাওয়ালি। তিনি বললেন, বনে ডাকাতি বন্ধ না হলে অনেকেই আর সুন্দরবনের ব্যবসা চালাবেন না।
ডাকাতেরা গত ২৬ জুলাই কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের আবু সাঈদের (ছদ্মনাম) নৌকা আটক করেছিল। সেদিন কয়রা নদীসংলগ্ন জেলের খাল এলাকায় ডাকাত আফজালের বাহিনী মোট ১৬টি জেলে নৌকা ধরে। নৌকাপ্রতি ২০ হাজার ৪০০ টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়।
২ আগস্ট বিকেলে আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে দেখি, জরাজীর্ণ ঘরের বারান্দায় তাঁর স্ত্রী ছোট বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন। চোখেমুখে আতঙ্ক আর কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, জাহাঙ্গীর বাহিনীর ডাকাতদের পানি খাইয়েছিলেন তিনি। সেই রাগে আফজাল বাহিনীর লোকজন তাঁকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে পিটিয়েছে। এর পর থেকে তাঁর শরীরে তীব্র ব্যথা, কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারের কাছে ওষুধ নিতে গেছেন।
কয়রার আরও অন্তত ১০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, ২০১৮ সালে দস্যুদের আত্মসমর্পণের পর বনে শান্তি ছিল। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে আবার শুরু হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। জিম্মি জেলে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে মুক্তি পাচ্ছেন।
নাগরিক সংগঠন ‘উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলন’-এর সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম ২ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদ ককে বলেন, নজরদারির অভাবে দস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ছোট দলগুলো বড় বাহিনী হয়ে উঠবে। বনজীবীর জীবিকা, পর্যটন ও সরকারের রাজস্ব হুমকির মুখে পড়বে। দস্যুভয়ে এ বছর মৌয়ালদের মধু আহরণ প্রায় ৩৫ শতাংশ কমেছে।
কয়রার আরও অন্তত ১০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, ২০১৮ সালে দস্যুদের আত্মসমর্পণের পর বনে শান্তি ছিল। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে আবার শুরু হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়। জিম্মি জেলে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে মুক্তি পাচ্ছেন।
সুন্দরবন ঘেঁষা উপকূলীয় এলাকা ঘুরে বনজীবী জেলে ও আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের সঙ্গে কথা বলেছি। জেলেরা দিনরাত বনদস্যুর ভয়ে সন্ত্রস্ত। বলেশ্বর থেকে রায়মঙ্গল নদী জুড়ে এই ভয় ছড়িয়ে আছে। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দুবলার চরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের পরিবারও দুশ্চিন্তায় থাকে। অন্যদিকে দস্যুরা থাকে প্রশাসনের হাতে আটক হওয়ার আতঙ্কে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘কোম্পানি মহাজন’ নামে পরিচিত বেশ কয়েকজন মাছ ও কাঁকড়া ব্যবসায়ী দস্যুদের সঙ্গে আঁতাত করে বনজুড়ে নিজেদের ব্যবসা বিস্তার করছেন। নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা ও বনদস্যুতার নেপথ্যে ওই মহাজনদের সক্রিয় ভূমিকা আছে। তবে বাইরের জগৎ এই ভয়াল বাস্তবতা জানে খুব কমই।
দুলাভাই বাহিনীকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা কয়রার একজন জেলে বলেন, বনে ঢোকার আগে তিনি মহাজনের মাধ্যমে টাকা দিয়ে কার্ড করেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ার পর কার্ডের নম্বরটি খাতার সঙ্গে না মেলায় শুরু হয় দুর্ভোগ।
সম্প্রতি সুন্দরবনে মজনু বাহিনীর কাছে পাঁচ দিন জিম্মি থাকার পর মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছেন শ্যামনগরের একজন জেলে হাফিজুর রহমান (ছদ্মনাম)। বললেন, বনদস্যুদের সঙ্গে অনেক কোম্পানি মহাজনের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। মহাজনের কাছে চাঁদা দিয়ে জেলেদের একটি ‘কার্ড’ নিতে হয়।
এই কার্ড আসলে একটি ১০ টাকার নোট, যার নম্বর ডাকাতদের খাতায় লেখা থাকে। হাফিজুর বলেন, ‘ডাকাতেরা আমাকে ধরার পর প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল, কোন মহাজনের জেলে আমি। কিন্তু কার্ড না থাকায় আমাকে আটকে রেখে শেষ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা নিয়েছে।’
দুলাভাই বাহিনীকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা কয়রার একজন জেলে বলেন, বনে ঢোকার আগে তিনি মহাজনের মাধ্যমে টাকা দিয়ে কার্ড করেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ার পর কার্ডের নম্বরটি খাতার সঙ্গে না মেলায় শুরু হয় দুর্ভোগ।
২৫ জুলাই খড়খড়িয়া খালে দুলাভাই বাহিনী আমাদের টহল বোটে গুলি চালায়। ডাকাতদের দমনে এখনই যৌথ অভিযান প্রয়োজন।
সম্প্রতি জামিনে মুক্ত এক বনদস্যু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহাজনদের সঙ্গে ডাকাতদের চুক্তি থাকে নির্দিষ্টসংখ্যক নৌকার জন্য। যাঁদের আগাম চাঁদার টোকেন থাকে, তাঁরা রেহাই পান, আর বাকিদের আটকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
বনদস্যুটি বলেন, আটকে পড়া জেলেদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন মহাজনেরা। দর-কষাকষি করে মুক্তিপণের টাকা পাঠান মূলত তাঁরাই। কিন্তু সেই ‘উপকারে’ জেলে পড়ে যান ঋণের ফাঁদে। পরে দিনরাত মাছ-কাঁকড়া ধরে মহাজনের ঋণ শোধ করতে হয়।
কয়রার মঠবাড়ি গ্রামের আত্মসমর্পণকারী দস্যু আনারুল ইসলামের মতে, কোম্পানি মহাজনেরা দস্যুদের টাকা দিয়ে জেলেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। ডাকাত শুধু জঙ্গলে নয়, ডাঙার ব্যবসায়ীরাও এখন আরেক রকমের ডাকাত।
গত ২৯ জুলাই সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলায় মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অংশগ্রহণকারীরা। সভায় কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমদাদুল হক বলেন, স্থানীয়ভাবে ‘কোম্পানি মহাজন’ নামে পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি বনদস্যুদের সহযোগিতা করছেন বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। তিনি আবু সাঈদ, মিন্টু, নুর হোসেন, মোশাররফ ও আমিরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেন।
তাঁরা প্রত্যেকেই পরে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, অভিযোগটি সত্য নয়। তবে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ঘোষণার আগেও এঁদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ছিল। এমনকি অনেকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আবু সাঈদকে গ্রেপ্তার করে নৌবাহিনী। কয়রা কন্টিনজেন্ট কার্যালয় থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, বনদস্যুদের অস্ত্র সরবরাহ, বনদস্যুদের খাবার সরবরাহ এবং সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগে আবু সাঈদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে গত ৩ আগস্ট বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের পাশে আবু সাঈদের সঙ্গে দেখা হয়। জামিনে মুক্তি পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। একসময় সুন্দরবনে তাঁর সামান্য ব্যবসা ছিল; গত বছর সরকার পতনের পর সে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সুন্দরবনে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক কোম্পানি মহাজন কারা, এ নিয়ে উপকূলজুড়ে বিভ্রান্তি আছে। তবে মোংলা, কয়রা, শ্যামনগর ও দাকোপ উপজেলা ঘুরে সাবেক বনদস্যু ও জেলেদের কথায় কয়েকটি নাম বারবার শুনেছি। এগুলো হলো অয়ন কোম্পানি, আবু সালেহ কোম্পানি, হোসেন কোম্পানি, শহিদুল কোম্পানি, কামরুল কোম্পানি, বিপুল কোম্পানি, মিন্টু কোম্পানি, রিয়াসাদ কোম্পানি, খোকন কোম্পানি ও শাহীন কোম্পানি।
এ ছাড়া বিকাশ কোম্পানি মজনু ডাকাতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বেশ আলোচিত। তবে বিকাশ মারা যাওয়ার পর কোম্পানিটির ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এখন তাঁর স্বজনদের হাতে।
বন বিভাগের দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেল ভেঙে পালানো কয়েদি এবং চিহ্নিত আসামিরাও যুক্ত হয়েছে এই দস্যুতায়।
সুন্দরবনের দস্যু দয়াল বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পনের প্রস্তুতি। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি
সুন্দরবনে দস্যু দমনের সূচনা হয় ২০১৬ সালে, যখন সবচেয়ে বড় দল ‘মাস্টার বাহিনী’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয় এবং পুনর্বাসনে রাজি হয়। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) একাধিক কর্মকর্তা জানান, এরপর আরও ৩২টি দস্যু বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৮ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করেন, জমা দেন ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গুলি। অবশেষে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাস্টার বাহিনী, ছোট জাহাঙ্গীর বাহিনী, সুমন বাহিনী, খোকাবাবু বাহিনী, মুন্না বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, দাদা বাহিনী, হান্নান বাহিনী, ছোট রাজু বাহিনী, আল আমিন বাহিনী, সাত্তার বাহিনী, আলিফ বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, শান্ত বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনী, আলম বাহিনী, মজনু বাহিনী ও শরিফ বাহিনী।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সুন্দরবনে আবারও শুরু হয় ডাকাতদের উৎপাত। মুক্তিপণ দিয়ে ফেরা জেলেদের বর্ণনা ও কোস্টগার্ড সূত্রের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি অস্ত্র হাতে অন্তত ১৪টি দস্যু বাহিনী সুন্দরবনজুড়ে তাদের উপস্থিতির জানান দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তালিকায় চিহ্নিত মজনু, করিম শরীফ, দয়াল, রবিউল, আবদুল্লাহ, মামা-ভাগনে, আসাবুর, দুলাভাই, আল আমীন, জাহাঙ্গীর, আফজাল, কাজল-মুন্না, রাঙ্গা ও ছোট সুমন বাহিনী জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এর মধ্যে ৭টি নতুন।
বন বিভাগের দায়িত্বশীল দুজন কর্মকর্তা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেল ভেঙে পালানো কয়েদি এবং চিহ্নিত আসামিরাও যুক্ত হয়েছে এই দস্যুতায়। যেমন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কালিঞ্চি গ্রামের আবদুল্লাহ তরফদার (৪২) নারী পাচার মামলায় কারাগারে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙচুর করা হলে সেখান থেকে পালিয়ে যান আবদুল্লাহ। পরে সুন্দরবনে প্রবেশ করে বনদস্যুতায় নামেন। আবদুল্লাহর সঙ্গে ১০-১২ জনের একটি দল রয়েছে। তাঁদের অধিকাংশ কারাগার থেকে পালানো।
খুলনার কয়রা উপজেলার আনারুল ইসলাম একসময় ছিলেন কুখ্যাত বনদস্যু। ‘আনারুল বাহিনী’ জেলেদের কাছে ছিল বাঘের মতোই ভয়ংকর। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি দলবলসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
আনারুল এই প্রতিবেদককে বলেন, পুনর্বাসনের জন্য সরকার এক লাখ টাকা করে দিয়েছিল। কিন্তু একাধিক মামলার কারণে নিয়মিত আদালতে ঘুরতে হয়। সরকারের প্রতিশ্রুত মামলামুক্তির বিষয়টি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, তাঁর মতো স্বাভাবিক জীবনে ফেরা লোকজন ভালো থাকার চেষ্টা করছে। তবে যারা ভালো হতে চায় না, তাদের শত সুযোগ দিয়েও পরিবর্তন হয় না।
গত ১৬ আগস্ট সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা মুন্সিগঞ্জ বাজারে কথা হয় আত্মসমর্পণকারী বনদস্যু আলম সরদারের সঙ্গে। তিনি বললেন, তাঁর পরিচিত অনেক আত্মসমর্পণকারী আবারও দস্যুতায় ফিরে গেছে। দুজন তাঁকে বারবার ফোন করে তাদের দলে যেতে বলেছে, ‘কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমার আর অন্ধকারে ফেরার পথ নেই।’ তিনি বলেন, পুনর্বাসনের টাকায় পুরোনো একটি ইজিবাইক কিনে সেটা চালিয়ে ভালোই আছেন।
কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি, আমার আর অন্ধকারে ফেরার পথ নেই।
কোস্টগার্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, কয়রার আল আমিনও আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু গত ১৮ এপ্রিল তিনি অস্ত্রসহ কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়েন। এরপর জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার দস্যুতায় নামেন। একইভাবে ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করা করিম শরীফও আবার বনে সক্রিয় হয়েছেন। সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় লোকজন জানান, আত্মসমর্পণকারী মিলন পাটোয়ারী মজনু বাহিনীর সঙ্গে দস্যুতায় ফিরেছেন। শ্যামনগরের গাবুরার একজন ভুক্তভোগী জেলের ভাষ্য, এলাকার খোকাবাবুও আবার দস্যুতায় নেমেছেন।
দস্যুতায় ফেরা আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুর সানাসহ (৪২) দুই ডাকাতকে গত বছরের ১২ নভেম্বর সুন্দরবনের ঠাকুরবাড়ি ঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কোস্টগার্ড। তাঁদের কাছ থেকে দুটি একনলা বন্দুক ও চার রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়।
গ্রেপ্তারের পর আসাবুরকে লোকালয়ে আনা হলে নদীর তীরে ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। তখন মুঠোফোনে তোলা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, কোস্টগার্ডের নৌকায় দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে আসাবুর বলছেন, ‘আমি আসাবুর, মৃত্যুর আগপর্যন্ত ডাকাতি করব।’
জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও অস্ত্র হাতে বনে নেমেছেন আসাবুর। গত ৪ আগস্ট সুন্দরবনের শিবসা নদীর শরবতখালী এলাকায় তাঁর সদলবলে অবস্থানের খবর পেয়ে অভিযান চালায় কোস্টগার্ড। আসাবুর পালিয়ে যান, তবে তাঁর দলের দুজন আটক হন। উদ্ধার করা হয় তিনটি একনলা বন্দুক, ১০ রাউন্ড তাজা গুলি ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি।
কিন্তু সুন্দরবনে দস্যুদের হাতে অস্ত্র পৌঁছায় কীভাবে? আত্মসমর্পণকারী কয়েকজন সাবেক বনদস্যু আমাকে বলেছেন, এগুলো আসত মূলত দেশের বিভিন্ন জেলার বৈধ অস্ত্রের দোকান থেকে। বৈধ অস্ত্রের আড়ালে চোরাই পথে চলত অবৈধ বেচাকেনা।
দস্যুদের চাহিদা অনুযায়ী আগাম চাঁদা দিয়ে নৌকা নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছেন দুই জেলে। ৩ সেপ্টেম্বর কয়রা উপজেলার সুন্দরবন–সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদী এলাকায়
দোকান থেকে অস্ত্র বের করার পর গায়ে খোদাই করা বৈধ নম্বর মুছে ফেলে চড়া দামে তা বিক্রি করা হতো বনদস্যুদের কাছে। অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার মূল মাধ্যম ছিলেন খুলনা শহরের ব্ল্যাকার বাচ্চু, হাতকাটা সালেহ, বিকাশ বাবু, গালকাটা মাসুদ ও মজনু। বিকাশ বাবু ও গালকাটা মাসুদ মারা গেছেন।
দস্যুতায় ফিরে আসা দয়াল বাহিনীর এক সদস্য বলেন, শহরের বিভিন্ন অবৈধ অস্ত্র কারবারির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। সেগুলো পাশবালিশ বা তোশকের মধ্যে ঢুকিয়ে বাসে করে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় আনা হয়। তিনি বলছেন, অস্ত্র কেনার জন্য তাঁর মূল যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছেন ডাকাত মজনু। মজনুই অস্ত্র কারবারিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন। প্রতিটি অস্ত্র কিনতে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়।
এ বিষয়ে মজনুর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। যাঁদের মাধ্যমে চেষ্টা করেছি, তাঁরা বলেছেন তিনি তাঁর সময়মতো যোগাযোগ করবেন।
সুন্দরবনের যে দস্যুদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা বলছেন, এই দফায় মজনু নতুন দল গড়ে বনে নামার পর অনেকে তাঁর মাধ্যমে অস্ত্র নিয়েছেন। প্রথামতো দেওয়া টাকার একটা বড় ভাগ নেন অস্ত্র জোগানদাতা বাহিনীর প্রধান নিজে।
একজন নব্য ডাকাত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অস্ত্রের দোকানে যাঁরা মেকানিক্যাল কাজ করেন, তাঁরা আসল বন্দুকের মতো বন্দুক বানাতে পারেন। কেউ কেউ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও মালামাল নিয়ে সরাসরি সুন্দরবনে এসে বসে অস্ত্র তৈরি করে দিয়েছেন।
দস্যুজগতে অস্ত্র লুকিয়ে রাখাকে বলে ‘চাপানো’। ড্রাম বা পাইপে সংরক্ষণ করে মাটির নিচে বা খালের তলায় পুঁতে রাখা হয় অস্ত্র। জায়গাটি চেনেন কেবল ডাকাত সর্দার বা তাঁর বিশ্বস্ত কেউ। অনেক আত্মসমর্পণ করা দস্যুকে বলতে শুনেছি, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ারে যাওয়া শতাধিক দস্যুর অনেকেরই অস্ত্র সুন্দরবনে চাপানো আছে। কিন্তু কোথায়, সেটা কেউ জানে না।
সুন্দরবনের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে রায়মঙ্গল নদী, যা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। ভারতের সুন্দরবন থেকে নেমে আসা নদীটি প্রথমে মামদো নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়, পরে মাথাভাঙা ও চুনকুঁড়ি নদীর সঙ্গে মিশে মুন্সিগঞ্জের চুনা নদীতে প্রবাহিত হয়।
চুনা নদীর উৎস খোলপেটুয়া, যেটার মধ্যবর্তী দ্বীপ-জনপদ গাবুরা। এর পূর্বে কয়রার বেদকাশী, আর দক্ষিণে খোলপেটুয়া থেকে নেমে গেছে কলাগাছিয়া নদী। কলাগাছিয়া খানিকটা পথ পেরিয়ে মিশেছে মালঞ্চ নদীতে।
মানুষজন বলছেন, এই অঞ্চলজুড়ে দস্যুবাহিনীর আনাগোনা চলে। মল্লাখালী, পুরাতন ঝাপসি, শিবসা নদী, বাওয়ানী খাল, মুচিরদোয়ানি, কামারখোলা, আদাচাইসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আস্তানা রয়েছে। ছোট বাহিনীগুলো কখনো নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে দস্যুতা চালায়। তবে এলাকা দখলের লড়াই এবং অস্ত্রের মালিকানা নিয়েও গোলাগুলি এবং সংঘাতও ঘটে।
মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা জেলেরা বলেছেন, দস্যুদের প্রতিটি নৌকায় থাকে একাধিক সশস্ত্র সদস্য এবং একজন বাবুর্চি। দস্যুরা সকাল আর বিকেলে খান। একদল খেতে বসলে বাকিরা পাহারায় থাকেন।
প্রতিটি বাহিনীতে একজন কিছুটা লেখাপড়া জানা মুহুরি থাকেন। তিনি দলনেতাকে দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দেন। দস্যুরা চাঁদা ও মুক্তিপণ নেন মূলত বিকাশে। তাঁরা যোগাযোগ রাখার জন্য উঁচু গাছে মাচা বানিয়ে মুঠোফোন ব্যবহার করেন।
তাদের ভাষায় ‘ধরা লোক’ মানে অপহৃত জেলে, ‘টাওয়ার’ মানে ফোনে কথা বলার জায়গা এবং ‘জামিন’ মানে মুক্তিপণ পরিশোধ হওয়া। এক বনদস্যু বলেন, ‘জেলেদের ভয় দেখাই, মারধর করি, কিন্তু এতটাই নয় যে তারা মাছ ধরতে আসা বন্ধ করে দেয়। কারণ, এ জেলেরা আমাদের চালিয়ে রাখে।’
বনজীবী জেলেরা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, শুধু বনদস্যুদেরই নয়, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বনরক্ষীদেরও নিয়মিত ‘নজরানা’ দিতে হয়।
গত ১৫ আগস্ট সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীনের সঙ্গে দেখা হয় কয়রা সদরে। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুন্দরবনে চোর-ডাকাত, শিকারি—সব অপরাধ দমন তো আপনাদের দায়িত্ব। কীভাবে সামলান?’
নাসির উদ্দীন বললেন, ‘ডাকাতদের চাপ এত বেশি যে এখন শুধু বেঁচে ফিরতে পারলেই স্বস্তি। যদি ডাকাত না থাকত, অন্য অপরাধ সহজেই দমন করা যেত।’
আরেকজন বনরক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চোখের সামনে অপরাধ দেখি, কিন্তু না দেখার ভান করতে হয়। এখনকার দস্যুরা বনকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, গালিগালাজ করে। অল্প জনবল আর খালি হাতে আমরা তাদের কীভাবে ঠেকাব?’
বনজীবী জেলেরা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, শুধু বনদস্যুদেরই নয়, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বনরক্ষীদেরও নিয়মিত ‘নজরানা’ দিতে হয়।
সুন্দরবনের ডাকাত রাঙ্গা বাহিনীর দুই সহযোগীকে অস্ত্রসহ আটক করে কোস্টগার্ড। এ সময় তাদের কাছে জিম্মি থাকা নয় জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন কার্যালয়ে
সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘গত ২৫ জুলাই খড়খড়িয়া খালে “দুলাভাই বাহিনী” আমাদের টহল বোট ঘেরাও করে গুলি চালায়। বেপরোয়া হয়ে ওঠা ডাকাতদের দমনে এখনই যৌথ অভিযান প্রয়োজন।’
গত ২০ জুলাই শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির চারজন বনরক্ষী বিষ দিয়ে মাছ ধরা আটকাতে গেলে দস্যুদের হামলার শিকার হন। সরকারি পোশাক ছিঁড়ে তাঁদের মারধর করা হয়। ১০ জুলাই কয়রা টহল ফাঁড়ির বনকর্মীরা একইভাবে হামলার শিকার হন।
কয়রা ফাঁড়ির কর্মকর্তা সজল মজুমদার বলেন, ‘দুটি নৌকায় বসে বিষ ছিটাচ্ছিল। আমরা কাছে গেলে নৌকা ফেলে তারা বনের ভেতর পালায়। পরে ছায়ার মতো হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে ফিরে এসে হামলা করে।’ তিনি বলেন, নেতৃত্বে ছিল আত্মসমর্পণকারী দস্যু কয়রার হারুন।
প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে ডাকাতদের উপদ্রবকে কিছুটা উদ্বেগজনক বলেছেন। তবে তিনি বলেন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এক সমন্বিত বৈঠকে র্যাব, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও বন বিভাগকে দ্রুত যৌথ অভিযান শুরু করতে বলেছেন।
কোস্টগার্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ১৮ জন দস্যুকে গ্রেপ্তার এবং ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১২টি।
গত ছয় মাসে সুন্দরবনে দস্যু দমনে কোস্টগার্ডের টানা অভিযান চলেছে। কোস্টগার্ড ১২ সেপ্টেম্বর বনের আদাছগি এলাকা থেকে রাঙ্গা বাহিনীর দুই সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক এবং নয়জন জিম্মি জেলেকে উদ্ধার করে। ৬ সেপ্টেম্বর পশুর নদসংলগ্ন এলাকা থেকে অস্ত্রসহ আটক হয়েছিল সুমন বাহিনীর চার সদস্য।
কোস্টগার্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ১৮ জন দস্যুকে গ্রেপ্তার এবং ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২২৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১২টি।
কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনের ভেতরে সক্রিয় দস্যুদের রুখে দেওয়ার পাশাপাশি দস্যু নির্মূলে ধারাবাহিক ও নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতিমধ্যে অপহৃত বহু জেলে ও বাওয়ালিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
৮ সেপ্টেম্বর বনদস্যু কাজল-মুন্না বাহিনীর তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে শ্যামনগর থানার পুলিশ। উদ্ধার করে জিম্মি দুজন জেলেকে এবং মুক্তিপণের ৭৪ হাজার টাকা।
গত ২৩ জুন শ্যামনগরের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় জনতা অস্ত্রসহ দুই দস্যুকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত