বিধান চন্দ্র ঘোষ, দাকোপ (খুলনা) : শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই খুলনার দাকোপে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানীয়জলের চরম সংকট। ফলে প্রতিদিন বিশুদ্ধ খোলা পানি বিক্রির দোকানে বাড়ছে পানি কেনার দীর্ঘ লাইন। কিছু লোক আবার দুর দুরান্ত থেকেও সংগ্রহ করছেন এই পানি। আবার বাধ্য হয়েও কিছু লোক ডোবা-নালার পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ নানা পানি বাহিত রোগে ভুগছেন।
সরেজমিন ঘুরে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পৃথক ৩টি দ্বীপের সমন্বয় গঠিত সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা এই উপজেলা। এর চার পাশে নদীতে লবণ পানির প্রচন্ড চাপ থাকায় খরা মৌসুমে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেয়। প্রতি বছরের মত এবারও ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানীয়জলের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির জন্য হা-হুতাশ করছেন। এমনকি চায়ের দোকান, খাবার হোটেল, মিষ্টির দোকানে খরিদ্দারকে বিশুদ্ধ পানি দিতে না পেরে দোকানদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। আবার চলতি রবি মৌসুমে এঅঞ্চলের প্রধান ফসল তরমুজ, বোরো ক্ষেতেও সেচ সংকটে লোকসানের আশঙ্কা অনেক কৃষক। এখানে কোথাও গভীর নলকুপ সফল না হওয়ায় রয়েছে অগভীর নলকুপ যা অধিকাংশ অকেজো। আবার কোন কোন নলকুপের পানিতে লবন, আর্সেনিক যুক্ত এবং অতিরিক্ত আয়রন। এছাড়া এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং (ট্যাংকি) নেই। যে কারনে এলাকার মানুষের খাবার পানির একমাত্র ব্যবস্থা পুকুরের পানি ফিল্টার করে খাওয়া। কিন্তু অপ্রতুল পুকুরগুলোতে পানি স্বল্পতার কারনে প্রায় সকল ফিল্টার বা পিএসএফ গুলি অকেজো হয়ে পড়েছে। এলাকার কতিপয় স্বচ্ছল ব্যক্তিরা বটিয়াঘাটা, খুলনাসহ বাহিরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি কিনে জীবন ধারন করছেন। আর মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম আয়ের মানুষ বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে যে পুকুরে পানি আছে সেখান থেকে সরাসরি পানি নিয়ে পান করছেন। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র অভাবের কারনে একটি বৃহৎ জনগোষ্টির বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার অনুপযোগী পানি খেয়ে জীবন ধারন করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই ডায়রিয়াসহ নানা পানি বাহিত রোগে ভুগছেন বলে জানা গেছে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সুপেয় পানির আধারের মধ্যে ৫ হাজার ৭৪২টি রেইন ওয়াটার হারভেটিং (ট্যাংকি) রয়েছে। আর ২৭টি গভীর নলকূপ ও ২২০টি অগভীর নলকূপ এবং ১৮টি পুকুর সচল রয়েছে। এ ছাড়া ১২টি সোলার পিএসএফ ও ৯টি সোলার ডি স্যালাইনেশন ইউনিট রয়েছে যার অধিকাংশ অচল। মোট ৮ হাজার ৩২৯টি পানির উৎসের মধ্যে ৬ হাজার ৯৩টি চালু রয়েছে। আর অকেজ রয়েছে ২২৩৬টি। তা ছাড়া ৫৭৮৯টি পানির উৎসের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া এনজিও‘র ৯৪টি আরো প্ল্যেিন্টর মধ্যে ৭৪টি অচল রয়েছে বলে জানা গেছে।
নলিয়ান এলাকার রুহুল কুদ্দুস মোল্যাসহ আরো অনেকে জানান, আগে পাশের একটি পুকুর থেকে পানি এনে খাতাম। খরার কারণে সেখানকার পানি শুকিয়ে গেছে। এখন নলিয়ান বাজারে একটি স্পালাইয়ের দোকান থেকে ৩০ লিটারে এক ড্রাম পানি ৪০ টাকা করে কিনে খেতে হচ্ছে। আবার এলাকার কিছু অসহায় গরিব মানুষ সরাসরি পুকুরের অবিশুদ্ধ পানি পান করছেন বলে তিনি জানান।
চালনা বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী আশুতোষ ঘোষ বলেন, পানি সংকটের কারনে খরিদ্দারদের পানি দিতে পারছিনা। পুকুরের পানি খাবার অনুপযোগী হওয়ায় তা দিয়ে পেলেট ধোয়া পালার কাজ চলে। আর খরিদ্দাদের প্রতি লিটার আশি পয়সা পানি কিনে খেতে দিতে হচ্ছে। তার মত অসংখ্য ব্যবসায়ী একই অভিমত ব্যক্ত করেন।
এবিষয়ে চালনা পৌর প্রকৌশলী রতন কুমার মন্ডল বলেন, সুপেয় পানি সংকট নিরসনে ৩২ পৌরসভা পানির প্রকল্পের আওতায় নির্মিত পানি বিশুদ্ধ করণ প্ল্যান্টের পাইপটি পাশর্^বর্তী ভদ্রা নদীতে স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নদীটির আশে পাশে অসংখ্য কৃষক ধান এবং তরমুজ চাষ করায় এবং নদীর পানি সেচ হিসাবে ব্যবহার করার ফলে পানি শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্ল্যান্টের অনেক তার চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় থানায় একটি মামলাও করা হয়েছে। ফলে নানা কারণে প্ল্যান্ট থেকে পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি বাড়ি পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ বন্দ রয়েছে। পানি সরবরাহ শুরু হলে পৌর এলাকায় সুপেয় পানি সংকট অনেকটা নিরসন হবে বলে তিনি মনে করেন।
এব্যাপারে উপজেলা উপ-সহকারি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, এই উপজেলায় নিরাপদ পানির সংকট একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং প্রত্যেক বাড়িতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম (ট্যাংকি) স্থাপন করতে হবে। নলকূপ বসানোর পূর্বে লবণাক্ততা পরীক্ষা এবং লবণাক্ততা কম এমন এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হবে। পুকুর ও খাল খনন ও পুনঃ সংস্কারের মাধ্যমে মিষ্টি পানির উৎস রক্ষা করতে হবে। নিরাপদ পানি ব্যবহারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে। পানি সরবরাহে সরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি এনজিওদের সম্পৃক্ত করা হবে। এসব পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন এবং এনজিওদের অকেজ আরো প্ল্যান্টগুলো সচল হলে এ অঞ্চলের সুপেয় পানি সংকট নিরসন হবে বলে তিনি মনে করেন।
দাকোপে সুপেয় পানীয় জলের চরম সংকট: বিশুদ্ধ খোলা পানি বিক্রির দোকানে দীর্ঘ লাইন

Leave a comment