সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের ৩ শিক্ষককে আটক করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রতারণা, জালিয়াতি ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে কনিষ্ট শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তকরণের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের চার শিক্ষক আত্মসমর্পন করেছে। এদের মধ্যে অসুস্থ্যতা জনিত কারণে একজনের জামিন মঞ্জুর করে অপর তিন জনকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
আজ সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরার বিশেষ আদালতে আসামীরা আত্মসমর্পন করেন। সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ চাঁদ মো. আব্দুল আলীম আল রাজী শুনানী শেষে তিনজনের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হওয়া আসামীরা হলেন, আশাশুনির নাকতাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ সরদারের ছেলে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, সদর উপজেলার নেবাখালি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে দর্শণ বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ এবং সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ধীরেন্দ্র নাথ সরকারের ছেলে হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক অরুন কুমার সরকার। তাদেরকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। অসুস্থ্যতার মেডিকেল সার্টিফিকেট বিবেচনা করে আদালত জামিন দিয়েছে একই মামলার অপর আসামী দেবহাটার উত্তর পারুলিয়া গ্রামের দেলবার মৃধার ছেলে সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলামকে।
মামলার প্রধান আসামী সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদ পলাতক রয়েছেন।
সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে চার প্রভাষককে এমপিওভুক্ত করার মাধ্যমে ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে উপরোক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস ২০২২ সালের ৯ মার্চ খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয় মামলা (৩/২০২২) দায়ের করেন। যা পরবর্তীতে সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতে ২/২০২২ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দুদকের খুলনা অফিসের সহকারি পরিচালক বিজন কুমার রায় চলতি বছরের ৫ মে আদালতে ওই পাঁচ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত ২৬ অক্টোবর দুদকের দাখিলকৃত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজুলেশন জালিয়াতি করে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ ও ২১জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট সাতক্ষীরায় এসে তদন্ত শুরু করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুকুমার দাসের নিকট থেকে দুদক সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দুর্নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অবগত হন। অভিযুক্ত ২১জন প্রভাষক ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদকে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেওয়া হয় তাদের লিখিত জবানবন্দি। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো: মনিরুল ইসলাম, দর্শণ বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এস্এম আবু রায়হান এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অরুন কুমার সরকারের কাগজপত্র জাল বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়।
২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে সিটি কলেজের এমপিও বঞ্চিত এবং কলেজ থেকে নিয়ম বহির্ভুত ভাবে বিতাড়িত বিধান চন্দ্র্র দাসসহ অন্যান্যদের অভিযোগের পর তদন্ত প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারির পর থেকে এসকল শিক্ষকদের তদন্ত কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হয়। অভিযুক্ত চারজন প্রভাষকের অনার্স শাখায় নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি করে ডিগ্রীর তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি ওই বছরের ২৯ নভেম্বর নিয়োগ বোর্ড গঠণ করা হয়। ৪ ডিসেম্বর এক পরিপত্রে উক্ত বোর্ডের মাউশি প্রতিনিধি হিসেবে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি এলপিআরে যাওয়া অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধী মামলায় তৎকালিন জেলে থাকা আসামী মাওলানাা আব্দুল খালেক মন্ডলকে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি উপরোক্ত চারজন শিক্ষককে ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়। যদিও ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ওই চার প্রভাষকের নিয়োগকালে খালেক মন্ডল সভাপতি ছিলেন না। ২০০২ সালের ২৪ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত খালেক মন্ডল সভাপতি ছিলেন। মামলার বিবরণে জানা যায়, তৎকালিন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হকের সময় ওই চারজন প্রভাষকের নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন দেখালেও শুধুমাত্র কৃষি ডিপ্লোমার শিক্ষক আবু রায়হান ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৫ সালে। অন্য তিন জনের রেজুলেশন তার নয় বলে তদন্তে জানা যায়। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুপালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে সিটি কলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন তালিকায় অধ্যক্ষ হিসেবে ইমদাদুল হক ও সভাপতি হিসেবে তৎকালিন সাংসদ এমএ জব্বারের সাক্ষর দেখা যায়। মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, ব্যান বেইস এর তথ্য অনুসারে মো: মনিরুল ইসলামের প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। এসএম আবু রায়হানের যোগদানের তারিখ ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ। মো: নাসির আহম্মেদ এর প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০১৬ সালের পহেলা ডিসেম্বর ও অরুন কুমার সরকারের যোগদানের তারিখ ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর।এইসব শিক্ষকদের যোগাদানের তারিখ জালিয়াতি করে মনিরুল ইসলাম ও অরুন কুমার সরকারের যোগদান ২০০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, এসমএম আবু রায়হান ও নাসির আহম্মেদ এর যোগদান দেখানো হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। মাউশি’র ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ডিগ্রী স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এই পরিপত্র জারির পরপরই অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ওই চার শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিও ভুক্তির জন্য অফ লাইনে মাউশি বরাবর আবেদন করেন। এরই আলোকে তারা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এমপিও ভুক্ত হন। অধ্যক্ষ আবু সাঈদের যোগসাজসে ওই চার জন শিক্ষক ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বেতন ভাতা বাবদ ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা রুপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে আরও ১২জন শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিও যোগ্য নামের তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই থেকে ১২ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাদেরকে ডেকে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল তথ্য উপাত্ত রেকর্ড করেন। এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আজিম খান শুভসহ চার জনের নামে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও বেতন ভাতা গ্রহণের পরিমান জানতে চাওয়া হয়েছে।