
জন্মভূমি ডেস্ক : আজ ৫ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যাওয়ার দিন। সারাবিশ্বের মানুষ অবাক বিষ্ময়ে দেখেছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রবল কর্তৃত্বপরায়ণ এক শাসকের দেশ ছেড়ে পলায়নের দৃশ্য। হাজারো প্রাণের আত্মত্যাগের সেই অভ্যুত্থানের একবছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। দিনটিকে অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ ঘোষণা করেছে। তাই দিবসটিকে কেন্দ্র করে আজ মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) থাকবে সাধারণ ছুটি।
দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে সরকার, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া রাজনৈতিক দলের প্রধানরাও শুভেচ্ছা বানী দিয়েছেন।
যেভাবে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা হন প্রধানমন্ত্রী। সাড়ে ১৫ বছরের টানা ক্ষমতায় তিনিই চরম কর্তৃত্ববাদী শাসকে রূপ নেন। সমালোচকদের কাছে তিনি ভিন্নমত দমনকারী, একদলীয় শাসনকারী ফ্যাসিস্ট। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের রাতের ভোটের পরও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন সরকারকে চাপে ফেলতে না পারায় আওয়ামী লীগের শাসন দিনেদিনে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের একক অর্জন– এ বয়ান আরোপ হয় সর্বত্র। রাজনৈতিক বিরোধীদের জঙ্গি, স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিয়ে নির্মমভাবে দমন করা হয়। বিরোধী দলগুলোকে দেশবিরোধী চিত্রিত করে বিএনপি, জামায়াতকে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক এবং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও ক্ষমতাসীনদের হামলা ও পুলিশের কঠোরতায় দমন করা হয়।
দমনের পুরোনো হাতিয়ার কাজে আসেনি
হাইকোর্টে ২০২৪ সালের ৫ জুন চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করলে ধীরে ধীরে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। শিক্ষার্থীরা শুরুতে আলোচনা চাইলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আদালত দেখায়।
১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়। পরের ১৪ দিন তাদের কর্মসূচি ছিল মিছিল, সমাবেশ, স্মারকলিপি প্রদানের মতো নিয়মতান্ত্রিক। ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আখ্যা দেন বলে দাবি করা হয়। এতে ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্লোগান ওঠে, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার’।
আওয়ামী লীগ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভকে আগের মতো পেশিশক্তিতে দমনের পথ বেছে নেয়। এ স্লোগানের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট– পরদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ কথা বলার ১ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়। ছাত্রলীগের বহিরাগত নেতাকর্মী নজিরবিহীনভাবে ছাত্রীদেরও মেরে রক্তাক্ত করে। এতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বুক পেতে দাঁড়ালে নিরস্ত্র এই তরুণকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সব বয়স ও শ্রেণির মানুষ নেমে আসে। শুধু সরকারি চাকুরে ছাড়া সব পেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের সমর্থনে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তা দমনে সব ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে ১৮ থেকে ২১ জুলাই নারকীয় বর্বরতা চালানো হয় বিক্ষোভকারীদের ওপর। কারফিউ জারি করে পুলিশ, বিজিবি, আনসারই নয়, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগও দমনপীড়নে অংশ নেয়। সমকালের হিসাবে, সেই পাঁচ দিনে অন্তত ৩০০ জনকে হত্যা করে শেখ হাসিনার পুলিশ। তাদের অন্তত আড়াই শতাধিক ছিলেন শ্রমজীবী কিংবা সাধারণ মানুষ।
২২ জুলাই থেকে সহিংসতা কমলে আওয়ামী লীগ উচ্চ আদালতের মাধ্যমে কোটা সংস্কার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আলোচনারও প্রস্তাব করে। কিন্তু গণহত্যার বিচার ছাড়া শিক্ষার্থীরা আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই সময়ে শেখ হাসিনা শত শত মানুষের প্রাণহানির চেয়ে মেট্রোরেল, টোলপ্লাজা, সেতু ভবন, বিটিভিতে ধ্বংসে বেশি দুঃখপ্রকাশ করেন। এতে কয়েক দিনের বিরতিতে আবারও ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
মুখে আলোচনার কথা বললেও আন্দোলন দমাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। তাদের বন্দিদশা এবং ১৮ থেকে ২১ জুলাই নির্বিচার হত্যা বাংলাদেশকে সারাবিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। ২৫ জুলাই ইন্টারনেট ফেরার পর একের পর এক হত্যাযজ্ঞের বীভৎস সব ছবি, ভিডিও বিশ্ববাসীর সামনে আসতে শুরু করে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখ হাসিনা ৩০ জুলাইকে শোক দিবস ঘোষণা করেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশ দুই ভাগ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার সমর্থকরা কালো এবং ছাত্র-জনতা বিপ্লবের লাল রং বেছে নেয়।
সেই সময় সেনাবাহিনী জানাতে শুরু করে তারা জনগণের পক্ষে থাকবে। গুলি করবে না আন্দোলনকারীদের ওপর। এ বার্তা স্পষ্ট হওয়ার পর আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেয় জুলাই চলবে। ৩৩ জুলাই তথা ২ আগস্ট উত্তরায় ছাত্র-জনতার প্রতিবাদে হামলা করে আওয়ামী লীগ। দেশের বিভিন্ন স্থানে ফের গুলি করা হয়। ‘৩৪ জুলাই’ শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করা হয়। শেখ হাসিনাকে হটাতে অসহযোগে পরেরদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকার রাজপথে নামে। সারাদেশে এ সংখ্যা কোটি ছাড়ায়। প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শেখ হাসিনার সরকার ও আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হয়। মরিয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সেদিন ভারী অস্ত্র নিয়ে পথে হামলা চালায়। স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত এই দিনে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণ যায়। জনতার প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়। ক্ষমতাসীন দলটি স্বাধীনতার পর কখনও এতটা প্রতিরোধে পড়েনি।
এমন হত্যাযজ্ঞের পর ৩৫ জুলাই মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা দেয় ৬ আগস্ট নয় ঢাকামুখী ছাত্র জনতার মার্চ হবে পরেরদিনই। সেই সময়ে নিশ্চিত হয়ে যায় শেখ হাসিনা আর ক্ষমতায় থাকতে পারছেন না। কিন্তু শেষ সময়ে তাঁর পুলিশের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হয়নি। শেষ চেষ্টা হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ ৩৬ জুলাই বেলা ১১ থেকে পরের এক ঘণ্টায় অন্তত ৭০ জনকে হত্যা করে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, চানখাঁরপুলে। তার পরও লাখো মানুষ উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শাহবাগ থেকে গণভবন অভিমুখী পদযাত্রা অব্যাহত রাখে। জনতার জোয়ারের মুখে দুপুর ১টার দিকে খবর আসে এক ঘণ্টা পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। তিনি ভাষণ দেওয়ার আগে আধাঘণ্টার মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায় শেখ হাসিনার পতন হচ্ছে। দুপুর আড়াইটায় খবর আসে শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ভারতে।
দুর্নীতি, অপশাসনের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিজয়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারি হিসাবেই ৮৬৫ জন শহীদের তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু শহীদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। পূর্ণাঙ্গ নাম-পরিচয় মেলেছে প্রায় ১১ হাজার আহতের। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসায় হাসিনা আমলের দুর্নীতির খবর আসছে। অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র অনুযায়ী ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে।
হাসিনা আমলে ব্যাংক খাতে অবিশ্বাস্য লুটপাট হয়েছে। সরকারি মদতে একের পর এক ব্যাংক দখল করে আওয়ামী লীগ সৃষ্ট ‘আলিগার্ক’। এক এস আলমের বিরুদ্ধেই দুই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ বের করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
হাসিনা আমলে আমলাতন্ত্র সরকারপ্রধানের কর্মচারীতে পরিণত হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়েছিল লাঠিয়াল। আমলারা একের পর এক ভুয়া নির্বাচনে সহায়তা করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকেও বৈধতা দেয়। বিচার বিভাগও সরকারের বর্ধিত অংশে পরিণত হয়েছিল। বিচারপতিরা পুলিশ, আমলাদের মতো রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। শুধু পেশাজীবী নয়, বিজ্ঞানীরাও সরকারের স্তাবকে পরিণত হন। ৫ আগস্টের পর এই পরিস্থিতি দূর হলেও ‘মব জাস্টিজ’, আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রণবতা, দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শিল্পকারখানায় অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্বস্তি দিচ্ছে না। অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বললেও তা এখনও অনেক দূর। খুব শিগগিরিই তা বছর তা অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা সবার।