
হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : নড়াইলের অরূনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবে দিনব্যপী গলফ টুর্ণামেন্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (৮জুলাই) নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নড়াগাতী থানা’র পানিপাড়া এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে অবস্থিত অরূনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবে এ খেলো দেখতে হাজারো দর্শকের ঢল নামে। খেলো শেষে এ দিন সন্ধ্যায় প্রধান অতিথি হিসেবে পুরস্কার বিতরন করেন ও বক্তব্য দেন সাবেক সফল পর্যটন মন্ত্রী এবং বাণিজ্য মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান এম.পি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অরূণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব কমিটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল রশিদ পিএসসি জি (অব:)। অরূনিমা রিসোর্ট এর ডিএমডি ইরফান আহমেদ এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন অরূনিমা রিসোর্ট এর এমডি খবির আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অরূণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মো: হাতেম। পুরস্কার বিতরণ শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে ফারুক খান এমপি বলেন, গলফিং সারাবিশ্বে একটি বিশেষ পর্যটন সেগমেন্ট হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করছে। যদিও গলফ পর্যটন শিল্পের একটি বিশেষ অংশ, এটি বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এবং বৈদেশিক আয় বাড়াতে বিশ্বজুড়ে গলফ’র প্রতি মানুষের আকর্ষন বেড়েই চলেছে। পর্যটনে এটিও উৎসাহ বাড়াচ্ছে। অনেক দেশ বিশ্বমানের গলফ কোর্স এবং গলফ রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করছে। গলফ কেন্দ্রিক বহু মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে। তাই অরূণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব কর্তৃপক্ষ গলফ টুর্নামেন্ট’র আয়োজন করে যে সময় উপযোগি পদক্ষেপ নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনিয়। এ ধরনের উদ্যোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকা খুবই জরুরী। কারণ এ ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ দেশে গলফ’র প্রসার ঘটবে। গলফ’র প্রসার ঘটলে গলফ কেন্দ্রিক পর্যটক বাড়বে। আর তাতে বৈদেশিক আয় বাড়বে। বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন (বিজিএফ) দেশের গলফ কোর্সগুলোর একটি এ্যাপেক্স সংগঠন হিসেবে সারা বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে গলফ পর্যটনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হলো অনেক আন্তর্জাতিক নামীদামী খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করবে। এতে দেশের বৈদেশিক আয় অনেক গুন বেড়ে যাবে।
অরূনিমা রিসোর্ট এর এমডি খবির আহমেদ বক্তব্যে বলেন, বিশ্ব গলফ ২০২২ এর পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বে ৩৮,০০০টি গলফ কোর্স রয়েছে। বর্তমানে শীর্ষ গলফ গন্তব্য বা দেশগুলি হচ্ছে – অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, নিউজিল্যান্ড, জাপান, উত্তর আমেরিকা, পর্তুগাল, চীন, মালয়েমিয়া ইত্যাদি। গলফ সারা বছরব্যাপী খেলা যায় বলে খেলোয়াড়রা যে দেশে গলফ কোর্স রয়েছে, সেই সকল দেশে চলে যায়।
যখন বিদেশী খেলোয়াড়দের সাথে একটি গলফ টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় তখন অনেক গলফ – প্রেমিক, স্পন্সর এবং সমর্থনকারী লোকেরা প্রচুর ভ্রমণ করে। গলফ ট্যুরিজমের মার্কেট সাইজ ২০২১ অনুযায়ী ২১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালে হবে ২৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩৩ সালে এর মার্কেট সাইজ হবে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমান বিশ্বে আনুমানিক ৫৬ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বব্যাপী গলফ খেলে, যার মধ্যে ২৬৭ মিলিয়ন হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর বাইরে ইউরোপে ৫.৫ মিলিয়ন গলফ খেলোয়াড় রয়েছে। কানাডায় গলফ খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫ মিলিয়ন, জাপানে ১৪ মিলিয়ন এবং যুক্তরাজ্যে ৩.৮ মিলিয়ন। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ একমাত্র গলফ খেলার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করে এবং তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। গলফ খেলাকে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ পর্যটক আকর্ষণ করার দ্বিতীয় প্রেরণা হিসাবে অভিহিত করা হয়।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে, ইউএনডিব্লিউটিও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আউট- ডোর এক্টিভিটির উপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং যার মধ্যে গলফ স্পোর্টস এই গুরুত্বের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। যখন একটি গলফ কোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাকরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়, সেই এলাকায় ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরী হয় এবং তা দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গলফকে বলা হয় পরিবেশ ও প্রকৃতি বান্ধব খেলা। গলফ কোর্স প্রকৃতিকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, কারণ তার নিজের জন্যই সবুজ প্রকৃতি এবং জলাশয়ের প্রয়োজন।
কিছু বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে গলফ পর্যটনের হিডেন জোন হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এবং এখানে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় এদশে গলফ ট্যুরিজমের প্রসারের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক তরুণ-তরণীর মধ্যে গলফ খেলায় আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশ বিদেশি গলফ খেলোয়াড়দের ভালো গলফ সেবা দিতে পারে।
গলফ ট্যুরিজমই পারে যুবসমাজকে ধর্মান্ধতা এবং ক্ষতিকারক নেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। বাংলাদেশের ক্রীড়া পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গলফকে অনেক পর্যটন বিশেষজ্ঞগণ গুরুত্বারোপ করেছেন। এখানে অনেক বিনিয়োগকারী আসছেন। গলফ পর্যটনে আরও বিনিয়োগ করা গেলে বাংলাদেশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র নিরসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক লাভবান হতে পারে। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে এস.ডি.জি অর্জনে সহায়তা করবে। এসডিজি-৩ বলেছে, সব বয়সের সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করুন এবং সুস্থ থাকার জন্য খেলাধুলার সাথে প্রাসঙ্গিক নীতিসমূহ প্রচার করুন। খেলাধুলার সাথে যুবকদের সম্পৃক্তকরণ জরুরী কারন তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য এ’টি অপরিহার্য। গলফ খেললে শরীরে ভিটামিন ডি পেতে সাহায্য করে যা কোভিড এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করে। খেলাধুলাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম অর্জনে সহায়তা করে। তাই গলফের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে আমাদের ক্রীড়া পর্যটনের প্রচার করা উচিত।
বর্তমানে বাংলাদেশে ২০টির মতো গলফ কোর্স রয়েছে যার মধ্যে পাঁচটি ১৮ হোলবিশিষ্ট গলফ কোর্স এবং চৌদ্দটি ৯-হোলবিশিষ্ট কোর্স। ১৮ হোল কোর্সগুলো হল- (১) ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, ২ সাভারের সাভার গলফ ক্লাব, (৩) কুমিল্লায় ময়নামতি গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৪) চট্টগ্রামে ভাটিয়ারি গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৫) চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন গলফ ক্লাব। ৯ হোলের গলফ কোর্সগুলো হলো- (১) ঢাকার আর্মি গলফ কোর্স, (২) টাঙ্গাইলের ঘাটাইল গলফ কোর্স, (৩) চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় শাহীন গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৮) খাগড়াছড়িতে চেঙ্গী গলফ কোর্স, ৫ রংপুর গলফ কোর্স, ৬)বগুড়া গলফ কোর্স, ৭) যশোর গ্যারিসন অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব (৮) গাজীপুরে বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি গলফ কোর্স, (৯) মৌলভী বাজারের শমসের নগর গলফ ক্লাব, (১০) শ্রীমঙ্গলে গলফ পাহাড়িকা কোর্স, (১১) কক্সবাজার গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (১২) নড়াইলের অরূণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব, (১৩) পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমি গলফ কোর্স, (১৪) খুলনার জাহানাবাদ গলফ কোর্স, (১৫) সাভারের জিরাভো গলফ কোর্স।
বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন (বিজিএফ) দেশের গলফ কোর্সগুলোর একটি এ্যাপেক্স সংগঠন হিসেবে সারাবছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে গলফ পর্যটনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হলো অনেক আন্তর্জাতিক নামীদামী খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করবে। এতে বৈদেশিক আয় বাড়বে। বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে গলফ-প্যাকেজ অফার করা যেতে পারে। এটি পর্যটন থেকে বর্তমান আয়ের দ্বিগুণ হবে। বৈশ্বিক গলফ ট্যুরিজমের ফিউচার ট্রেন্ডে দেখা যাচ্ছে যে, বার্ষিক ১২ শতাংশ হারে ক্রমশ বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সাথে সাথে বাংলাদেশকে গলফ স্পোর্টসের দিকে নজর দিতে হবে। বিদেশি খেলোয়াড় স্পন্সর এবং আন্তর্জাতিক গলফ ক্লাব সদস্যদের জন্য উন্নতমানের আবাসন, গলফ কোর্সের সুবিধা এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে। গলফ কোর্স শুধুমাত্র ক্লাব সদস্য বা পেশাদারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। কর্তৃপক্ষ সৌখিন বা অপ্রাতিষ্ঠানিক গলফারদের জন্য গলফ ক্লাব খোলা রাখার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সুবিধার জন্য গলফ পর্যটনের উন্নয়ন করা প্রয়োজন। গলফ খেলা আমাদের বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়তা করবে।