হুমায়ুন কবীর রিন্টু : নড়াইলের জমিদাররা ছিলেন প্রচন্ড প্রতাপশালী। অনেক আগেই জমিদারী প্রথা বিলোপ হয়ে গেছে। জমিদারী প্রথা বিলোপের আগেই অনেক এলাকার জমিদাররা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু নড়াইলের জমিদারদের প্রভাব শেষ পর্যন্ত ছিল। নড়াইলে জমিদারীর গোড়াপত্তন করেন জনৈক কালিশঙ্কর রায়। তিনি হিন্দু ধর্মালম্বী প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মুলত: তিনিই ছিলেন নড়াইলের জমিদারীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তার বাবার নাম ছিল রূপরাম রায়। রূপরাম রায় প্রসিদ্ধ গুয়াতলীর ঐতিহ্যবাহী মিত্র বংশের কৃষ্ণরাম মিত্রের দ্বিতীয় কন্যাকে বিয়ে করেন। এরপর রূপরাম রায় তিন পুত্রের জনক হন। তারা হলেন নন্দকিশোর, কালীশঙ্কর ও রামনিধি।
রূপরাম অল্প বয়সে নাটোর রাজ সরকারে চাকুরি নেন। ধীরে-ধীরে বিশ্বাস ভাজন হয়ে উঠেন। তিনি সরকারের উকিল হিসেবে মুর্শিদাবাদ নবাব দরবারে কাজ করার সুযোগ পান। এ কাজ করে তিনি যথেষ্ট অর্থ সম্পাদের মালিক হন। নাটোরের জমিদার রানী ভবানী একদিন রূপরাম রায়কে তাদের উকিল হিসেবে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে পাঠান। নাটোরের রানী ভবানীর দয়ায় রূপরাম রায় নড়াইলের আলাদাতপুর তালুক কিনে নেন। এই তালুকের মধ্যে নড়াইল নামক স্থানে তিনি বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। বসতবাড়ী হতে কিছু দূরে চিত্রা নদীর পাড়ে রূপরাম রায় একটি বাজার গড়ে তোলেন। রূপরামের নামানুসারে বাজারটি রূপগঞ্জ বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সেই নামেই বাজারটি বিদ্যমান রয়েছে। রূপরাম রায়ের তিন পুত্রের মধ্যে কালিশংকর রায় অতি অল্প বয়সে বাবার সাথে নাটোর রাজ দরবারে যাতায়াত করতে থাকেন। বাবার মত কালিশংকর অল্প বয়সে নাটোরের রাজ সরকারে কর্মচারী নিযুক্ত হন। এই কালিশংকর ছিলেন নড়াইল জমিদারীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। কালিশংকর রায় সুঠাম দেহের অধিকারী একজন ধূর্ত ব্যক্তি ছিলেন। নিজ সাফল্যের জন্য ন্যায়-অন্যায় বিচার বিবেচনা তার চরিত্রে ছিলনা। কৌশলে কাজ উদ্ধারে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। করতে তিনি সুনিপুন ছিলেন।
নড়াইল জমিদার বাড়ী ছিল একটি বিরাট এলাকা জুড়ে। বহু সুরম্য অট্টালিকা, নাট্যমঞ্চ, পূজামন্ডপ, কাচারী ভবন, অতিথিশালা ও বিখ্যাত বাঈজিদের সাময়িক বাসস্থানরূপে ব্যবহৃত বিশ্রামাগার এবং বহু সংখ্যক পুকুর দীঘি নিয়ে ছিল এ ব্যাপ্তি। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মধ্যে এতো বড় বাড়ী আর কোন জমিদারের ছিল না বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর জমিদারগণ এ দেশ ছেড়ে ভারতের কোলকাতায় চলে যায়। ১৯৫০ এবং ১৯৫২ সালের দিকে কোলকাতা থেকে জমিদারদের কয়েকজন স্বল্প সময়ের জন্য আসলেও পরবর্তীতে আর আসেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘদিন যাবত সংস্কারের অভাবে পুরাতন অট্টালিকাগুলি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল। বিভিন্ন মালামাল চুরি ও নষ্ট হতে থাকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এখানে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক গঠিত রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এছাড়া সরকারী রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বাসাবাড়ী হিসেবে দীর্ঘকাল দালান বাড়ী ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৮৫ সালের দিকে জমিদার বাড়ীর বিশাল দালান মাত্র ৫ লক্ষ টাকায় সরকার নিলামে বিক্রি করে দেয়। গুঞ্জণ আছে স্থানীয় একটি কুচক্রী মহল নিজেরা ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নিলাম করার ব্যবস্থা করেন। জমিদার বাড়ীর সামনে একটি মন্দির ছাড়া আর কোন স্মৃতি নেই। এখানে গড়ে উঠেছে একটি সরকারী শিশুসদন। এছাড়া জমিদার বাড়ীর প্রায় ১০ একর জমির উপর স্থাপিত হয়েছে জেলা পুলিশ লাইন। জমিদার বাড়ীর পুকুর দীঘি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। চারপশের সীমানা এলাকা দিয়ে অনেক জমি বেদখল হয়ে গেছে। জমিদারদের তৈরি পদ্মপুকুর নামের পুকুরটি ভূমিদস্যুদের নেতৃত্বে ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। জমিদারদের বিভিন্ন ধরণের কাজের জন্য যেমন- বেহারা (পাল্কিবাহক), রাজমিস্ত্রি, লাঠিয়াল বা ঢালী, পূঁজাঅর্চনার জন্য পুরোহিত এবং নানা প্রকার সেবা কাজের জন্য দাস সমপ্রদায়, জমিদার বাড়ীর দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের গ্রামে বসবাস করত। এই সকল সম্প্রদায়ের বংশধরেরা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। অনেকে লেখাপড়া করে অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে। কালের বিবর্তনে জমিদারদের ঐশ্বর্য্য ও বিত্তশালী প্রতীক বিশাল জমিদারী ও সুন্দর প্রাসাদ অট্টালিকার স্মৃতি চিহ্ন বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু জমিদারদের অত্যাচার নির্যাতনের স্মৃতি নড়াইলের মানুষ ভোলেনি।